Alapon

"স্ত্রীর কাছে স্বামীর জ্ঞানার্জন"



"স্ত্রীর কাছে স্বামীর জ্ঞানার্জন"

কেউ যদি বলে ‘আমি আমার স্ত্রীর পরামর্শে এই কাজটি করেছি’ বা ‘আমি আমার স্ত্রীর কাছে এই বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেছি’ তাহলে তার কথা শুনে তার বন্ধুরা কী বলবে? সমাজের লোকজন যদি শুনে, তাহলে কী বলবে?
তারা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে বলবে- ‘তুমি স্ত্রীর কাছ থেকে জ্ঞান নাও? তুমি স্ত্রীর পরামর্শে চলো?’
মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে স্ত্রীর পরামর্শ নেয়া, অজানা বিষয় স্ত্রীর কাছ থেকে জেনে নেয়া খুব স্বাভাবিক ছিলো। এটা শুনলে কেউ ঠাট্টা করতো না। অনেক স্বামী তার স্ত্রীকে যেমন পড়ান, তেমনি অনেক স্বামী তাঁর স্ত্রীর কাছেও পড়েন; স্ত্রীর কাছ থেকেও জ্ঞানার্জন করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক সাহাবী দম্পতি ছিলেন আসমা বিনতে আবি বকর ও যুবাইর ইবনে আউয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাঁদের মোট ৮ জন সন্তান ছিলো। আটজনের মধ্যে দুজন ছিলেন আল-মুনজীর ইবনে যুবাইর ও উরওয়া ইবনে যুবাইর রাহিমাহুল্লাহ।
উরওয়া ইবনে যুবাইর রাহিমাহুল্লাহর একজন ছেলে ছিলেন। তাঁর নাম হিশাম ইবনে উরওয়া রাহিমাহুল্লাহ। হিশাম ইবনে উরওয়া ছিলেন বিখ্যাত তাবেয়ী আলেম। তাঁর ছাত্র ছিলেন ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম সুফিয়ান আস-সাওরী রাহিমাহুল্লাহ। [আকরাম নদভী, আল-মুহাদ্দিসাত, পৃষ্ঠা ১৪৩]
অন্যদিকে, আল-মুনজীর ইবনে যুবাইর রাহিমাহুল্লাহর একজন মেয়ে ছিলেন ফাতিমা বিনতে আল-মুনজীর রাহিমাহাল্লাহ। তিনিও ছিলেন একজন তাবেয়ী। তিনি ছিলেন ফিক্বহে পারদর্শী। ফলে, তাবেয়ীদের মধ্যে ‘ফক্বীহা’ উপাধি লাভ করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী নিয়ে সর্বপ্রাচীন সীরাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে একটি ‘সীরাত ইবনে ইসহাক’। সীরাত ইবনে ইসহাকের রচয়িতা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন ফাতিমার ছাত্র। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ফাতিমা বিনতে আল-মুনজীরের কাছ থেকে হাদীস শুনেন। [আকরাম নদভী, আল-মুহাদ্দিসাত, পৃষ্ঠা ১৪৩]
হিশাম ইবনে উরওয়া ও ফাতিমা বিনতে আল-মুনজীর সম্পর্কের দিক থেকে ছিলেন চাচাতো ভাই-বোন। তাঁদের দাদা-দাদী এক। ফাতিমার সাথে উরওয়া ইবনে যুবাইর রাহিমাহুল্লাহর বিয়ে হয়।
স্বামী-স্ত্রী দুজনই ছিলেন হাদীস-ফিক্বহে পারদর্শী। ফাতিমা রাহিমাহাল্লাহর হাদীসের শিক্ষিকা ছিলেন তাঁর নানী আসমা বিনতে আবি বকর রাদিয়াল্লাহু আনহা ও উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা। ফলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামীর চেয়ে ফাতিমার বেশি হাদীস মুখস্ত ছিলো।
ফাতিমার স্বামী হিশাম ইবনে উরওয়া কিছু হাদীস স্ত্রীর কাছে শিখেন। স্ত্রীর কাছ থেকে তিনি হাদীস বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণিত এমন হাদীস ‘সিহাহ সিত্তায়’ পাওয়া যায়।
যেমন:
...হিশাম ইবনে উরওয়া বর্ণনা করেন ফাতিমা বিনতে মুনজীর থেকে, তিনি বর্ণনা করেন আসমা বিনতে আবি বকর থেকে, তিনি বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে:
“পরচুল সংযোজনকারিণী ও সংযোজন প্রার্থীনীদের আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন।” [সহীহ মুসলিম: ৫৪৫৮]
...হিশাম ইবনে উরওয়া বর্ণনা করেন ফাতিমা বিনতে মুনজীর থেকে, তিনি বর্ণনা করেন আসমা বিনতে আবি বকর থেকে, তিনি বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে:
“তুমি হিসাব করে দান করবে না, নতুবা আল্লাহ তোমাকে হিসাব করে দিবেন।” [সুনানে আন-নাসাঈ: ২৫৫০]
হিশাম ইবনে উরওয়া রাহিমাহুল্লাহ এতো বড়ো একজন আলেম হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্ত্রীর কাছে জ্ঞানার্জন করেন। কারণ, ঐ বিষয়ে তাঁর স্ত্রীর জ্ঞান ছিলো। স্ত্রীর কাছে জ্ঞানার্জন করতে তিনি হীনমন্যতায় ভুগেননি। সেটা বলতেও তিনি সংকুচবোধ করেননি। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আন-নাসাঈ সেসব হাদীস তাঁদের কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন।
অনেকেই স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণকে অপমানজনক মনে করেন। তারা মনে করেন, ‘আমার স্ত্রী আমাকে পরামর্শ দিলে আমি বেঁচে থেকে কী করবো? আমাকে স্ত্রীর পরামর্শ শুনতে হবে? এতোই খারাপ দিন আসলো?’
সমাজের কেউ যদি শুনে যে, অমুক স্ত্রীর পরামর্শে এই কাজটি করেছে, তাহলে তো তার ইজ্জত যায়-যায় অবস্থা! সবাই তাকে নিয়ে মজা করে।
অথচ আমাদের চেয়ে উত্তম যিনি, তিনিও স্ত্রীর পরামর্শ নিয়েছেন, স্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে কোনো কোনো কাজ করেছেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিলো সাহাবীদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। সবাই আশা করে এসেছিলেন কা’বা ঘরে তাওয়াফ করবেন। কিন্তু, সন্ধি করে সেবারের যাত্রা স্থগিত করা হয়। পরেরবার যাবেন। সাহাবীরা সেটা মেনে নিতে পারছেন না। সবচেয়ে কঠোর আপত্তি জানান উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু।
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে কুরবানি করার ও মাথা মুণ্ডনের নির্দেশ দেন। তিনি তিনবার নির্দেশ দেন, কিন্তু সাহাবীরা কেউ উঠলেন না। তারা খুব হতাশ ছিলেন।
সেই সফরে উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফরসঙ্গী ছিলেন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের আচরণের কথা তাঁকে বললেন। উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁকে পরামর্শ দেন,
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যদি তাই চান, তাহলে আপনি বাইরে গিয়ে তাঁদের সাথে কোনো কথা না বলে উট কুরবানি করুন ও ক্ষুরাকার ডেকে মাথা মুণ্ডন করুন।”
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীর কথামতো তাই করলেন। তাঁকে দেখে সাহাবীরা এবার উঠে দাঁড়ালেন এবং তারাও তাঁর অনুসরণ করলেন। [সহীহ বুখারী: ২৭৩১]
জ্ঞানার্জন বা পরামর্শ নেয়াটা নবিজী-সাহাবী-তাবেয়ীগণ লজ্জার বিষয় হিশেবে দেখতেন না। পরামর্শ বা জ্ঞান স্ত্রীর কাছ থেকে আসলে তারা মেজাজ দেখিয়ে বলতেন না ‘তুমি আমাকে জ্ঞান দেবার কে?’
পরামর্শ বা জ্ঞান যৌক্তিক হলে তারা গ্রহণ করতেন, প্রচার করতেন। এতে তাঁদের পুরুষত্ব যায়-যায় বলে কেউ ধিক্কার জানাতো না। কারণ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজে এটা ছিলো স্বাভাবিক। যেসব সমাজে জ্ঞানকে সংকীর্ণ জায়গা থেকে দেখা হয়, সেগুলোতে এসব ব্যাপারে নিন্দা, তিরস্কার জানানো হয়।

~আরিফুল ইসলাম

পঠিত : ২৭২ বার

মন্তব্য: ০