Alapon

|| আত্মপরিচয় হারাতে থাকা মুসলিমদেরকে জাগ্রত করার নায়ক ইমাম হাসান আল বান্না (রহ.)||



আজ ১২-ই ফেব্রুয়ারি। মিশরের অধিবাসী ইমাম হাসান আল বান্না (রহ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী। হাসান আল বান্না জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৬ সালের ১৪ অক্টোবর। মুসলিমরা যখন রাজনৈতিক, আদর্শিকসহ নানাভাবে সংকীর্ণতার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলো, নিজেদের মন-মানসিকতা, ঈমান-আকিদা যখন সাম্রাজ্যবাদ-বস্তুবাদ-নাস্তিকতার সংস্কৃতিতে তলিয়ে যাচ্ছি্লো, যখন তাঁরা নিজেদের মত-পথ, নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলতে বসেছিলো; হুবহু সে সময়ই ইসলামী রেনেসাঁর আওয়াজ নিয়ে আবির্ভুত হন বিগত শতাব্দির অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম হাসান আল-বান্না (রহিমাহুল্লাহ)!

বিংশ শতাব্দির ইসলামি রেনেসাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ইমাম ইসলামকে বাস্তবে মানুষের একমাত্র জীবনব্যবস্থা ও কুরআনকে এই ব্যবস্থার একমাত্র সংবিধান বলে মনে করতেন। এবং সেটা তিনি ব্যক্তিগত দাওয়াতের মাধ্যমেও মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। তিনি পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ, ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদ এবং মিশরের কিছু দুনিয়াদার-দরবারি আলেমদের সমালোচনা করেন।

এরপর এক সময় তিনি বস্তুবাদ, নাস্তিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদের অসারতার বিরুদ্ধে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠা করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ইখওয়ানুল মুসলিমিন নামক একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সংগঠনের মানহাজ বা কর্ম্পদ্ধতি সম্পর্কে পীস টিভির এক সময়কার জনপ্রিয় আলোচক শাইখ ডক্টর আব্দুস সালাম আজাদী বলেন ;

“সালাফিয়্যাতের দাওয়াত, সুন্নিদের পথ, সুফীদের বাস্তবতা, রাজনৈতিক মঞ্চ, শারীরিক ভাবে ফিট থাকার একটা দল, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতি চর্চার একটা লীগ, এটা একটা অর্থনৈতিক কোম্পানি এবং একটা সমাজ দর্শন।”

ইমাম হাসান আল বান্না ( রহ.) তাঁর দলের বৈশিষ্ট উল্লেখ করে বলেছেন :

১। সকল ধরণের মত পার্থক্যের ক্ষেত্রগুলো থেকে দূরে থাকা।

২। সমাজ নেতা ও বিত্তশালী বড়দের থেকে সরে থাকা।

৩। নানা রকমের দল ও সংস্থা থেকে বেঁচে থাকা।

৪। নতুনত্ব আনা এবং প্লান তৈরি ও নানা পদক্ষেপে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাওয়া।

৫। উৎপাদন ও কাজের দিকটাকে প্রচার ও বাগড়ম্বরতার চেয়ে প্রাধান্য দেয়া।

৬। যুবকদের ই প্রাধান্য দিয়ে তাদেরকে কাছে রাখা।

তাঁকে এবং তার দলকে যখন জালিমশাহীর তরফ থেকে ক্ষমতালোভী বা এই সংক্রান্ত অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে, তখন তিনি সরল-সাবলীল একটা কথা বলেন। তা আজো আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীনের বিধান প্রতিষ্ঠাকামি মু'মিনদের মনে অনুরণ তোলে। তাঁর সে ঘোষণাটি হলো—

“আমি তোমাকে ডাকছি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে, ডাকছি কুরআনের দিকে, যদি এটাকে তোমরা রাজনীতি বলো, তাহলে হ্যাঁ এটাই আমাদের রাজনীতি!”
ওনার এমন অসংখ্য ঈমান জাগানিয়া বিখ্যাত উক্তি আছে। তারমধ্যে আরো একটা হোলো—

"যখন তুমি দেখবে জেলের কুঠুরিগুলো তোমার জন্য তৈরি, ফাঁসির মঞ্চগুলো তোমার জন্য প্রস্তুত , তখন তুমি জানবে— তোমার দেয়া দাওয়াত ফলপ্রসূ হচ্ছে।"
দাওয়াতি কাজ ছিলো ইমাম বান্নার নেশার মতো। কী জন্যে তিনি দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্যে ব্যাকুল ছিলেন, তা তার একটা কথা থেকেই ফুটে ওঠে। তার সেই প্রবল আকাঙ্ক্ষা হোলো :

"ইসলামের প্রতিটি বিধিনিষেধ এমন কঠিন বলয় সৃষ্টি করেছে , যা মানবজাতিকে সবধরনের ধংসাত্বক বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু মানবজাতী কি সমাজে (পুণরায়) আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করবে?"

১৯৪৯ সালের এইদিনই দাওয়াতি কাজ শেষে ইমাম হাসান আল বান্না বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে ত্বাগুতের দল ওনার ওপর গুলি চালায়। বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়া হয় ওনার বুককে । বাতিলের সেই বুলেটের নির্মম আঘাতেই শাহাদাতের কোলে ঢলে পড়েন তিনি। শাদাতের অমিয় সুধাপানে ধন্য হয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন রব্বে কারিমের দরবারে। তাঁর লাশের প্রতিও ছিলো সাম্রাজ্যবাদীদের প্রবল ভয়। মানুষজনকে ঠিকমতো জানাযায়ও অংশগ্রহণ করতে দেয়া হোলো না।
তরুণ-যুবকদের প্রতিও ছিলেন তিনি যথেষ্ট সতর্ক-সচেতন। বিশ্ব-ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম এই সিপাহসালার যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেন—

“হে যুবকেরা প্রস্তুত হও ! তৈরী হও !! আজ যদি প্রচেষ্টা না চালাও, তবে ভবিষ্যতে কাজ করার জন্য কর্মশক্তি পর্যাপ্ত হবে না।”

ইমাম হাসান আলবান্নার দ্বারা প্রভাবিত বিশ্ব ইসলামি ব্যক্তিত্বদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ;
হাসান আলহুদায়বী, সাইয়িদ কুতুব, মুহাম্মাদ কুতুব, মুস্তাফা মাশহুর, ইউসুফ আলক্বারাদাওয়ী, সাইয়েদ সাবেক্ব, মুহাম্মাদ আহমাদ আররাশেদ, মুহাম্মাদ আলগাযালী, যায়নাব আলগাযালী, যাগলুল আলনাজ্জার, লেবাননের ফাতহী ইয়াকান, ফিলিস্তিনের আহমাদ ইয়াসিন, কুয়েতের আব্দুল্লাহ আলমুত্তাওয়াহ, সিরিয়ার ডঃ মুস্তাফা আসসিবাঈ, সাঈদ হাওয়া, ইরাকের মুহাম্মাদ মাহমূদ আসসাওয়াফ, আলজিরিয়ার মাহফূয নাহনাহ, সুদানের হাসান আলতুরাবী, পাকিস্তানের মাওলানা মাওদূদী, ভারতের আবুল হাসান নাদাওয়ী, মালায়েশিয়ার নিক আব্দুল আযীয প্রমুখ।

আত্মপরিচয় হারাতে থাকা মুসলিমদেরকে জাগ্রত করার এই ইমামের বাবাও ছিলেন একজন বড়ো মানের ইসলামি ব্যক্তিত্ব। তাঁর বাবার নাম ছিলো আবদুর রাহমান আল বান্না।

ইমাম বান্না একজন হাফেজে কুরআন ছিলেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু হয় আট বছর বয়সে মাদরাসা আর-রাশাদ আদ-দ্বীনিয়াহ নামক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এভাবে একপর্যায়ে তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটি “আল-আজহার ইউনিভার্সিটি” ভর্তি হন। ১৯২৭ সালে তাঁর সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা ইমাম হাসান আল বান্নার প্রতি রহম করুন। ইমাম বান্না, ইমাম মওদূদীদের কারণেই আজকে লাখো-কোটি মুসলিম আল্লাহদ্রোহী শক্তিদের মোকাবেলায় নিজেদেরকে আল্লাহর দ্বীনের কাছে আত্মসমর্পন করার মধ্য দিয়ে, আত্মপরিচয় নিয়ে নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রত্যয়ে জেগে ওঠেছে। এবং সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাঁরা কাজও করে যাচ্ছে অবিরত। যদিও ধীরে ধীরে এইসব মানুষদের মধ্যেও টুকটাক বিচ্যুতির জন্ম হয়েছে।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইমাম হাসান আল-বান্নার (রহঃ ভুলচুকগুলো ক্ষমা করে দিন। তাঁর কবরকে ফিরদৌসের সবুজ-শীতল বাগান হিসেবে কবুল করুন, এবং আমাদেরকেও ইমামের মতো একজন মুখলিস দা'ঈ ইলাল্লাহ হিসেবে কবুল করুন। আ-মী-ন!

|| আত্মপরিচয় হারাতে থাকা মুসলিমদেরকে জাগ্রত করার নায়ক ইমাম হাসান আল বান্না (রহ.)||

-রেদওয়ান রাওয়াহা
১২-০২-২১

পঠিত : ৩৫৮ বার

মন্তব্য: ০