Alapon

আমরা কাউকে কী দেখে মু'মিন মনে করবো?




আল্লাহ মুসলমানদের যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন তা অবিশ্বাস্য! তিনি বলেন - (وَ لَا تَقُوۡلُوۡا لِمَنۡ اَلۡقٰۤی اِلَیۡکُمُ السَّلٰمَ لَسۡتَ مُؤۡمِنًا ۚ) কেউ যদি তোমার দিকে সালাম ছুঁড়ে দেয় ''আল্কা ইলাইকুমুস সালাম..." তিনি বলেন নি "ওলা তাকুলু লিমান ইউসাল্লিমু আলাইকুম" "যে তোমাদের সালাম দেয় তাকে বল না ..." না, এমনকি কেউ যদি তোমাদের দিকে সালাম ছুঁড়ে দেয় ''লাস্তা মু'মিনান" তাকে বল না যে "তুমি মু'মিন নও।" (4:94)
ব্যাপারটা হল, কখনো কখনো রাস্তা দিয়ে পরস্পরকে অতিক্রম করার সময় বলতে পারি না আপনি আমি মুসলিম কিনা। আমরা চিনতে পারি না। আপনি পাশ কাটার সময় পরীক্ষা মূলকভাবে বললেন - আসসালামু আলাইকুম। অপর জন জবাব দিল, ওয়ালাইকুমুস সালাম। এখন আপনি জানেন সে মুসলিম। আমরা আরও জানি আমাদের ধর্মে বিশ্বাসের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। ইসলাম, ঈমান, ইহসান। ইসলাম হল, এই লোকটি অন্তত শাহাদাহ গ্রহণ করেছে, এটি প্রাথমিক স্তর। পরের স্তর হল ঈমান। ঈমানের অবস্থান হল অন্তরে। শক্তিশালী বিশ্বাসীদের অন্তরে ঈমান থাকে, তাদের বলা হয় মু'মিন।
এই আয়াতের ক্ষেত্রে আমি আপনি আশা করেছিলাম আল্লাহ হয়তো বলবেন, কেউ যদি তোমাদের সালাম দেয় তাহলে মনে করবে তারা মুসলিম। কিন্তু আল্লাহ বলছেন, "কেউ যদি তোমাদের প্রতি সালাম ছুঁড়ে দেয় তাহলে তাকে বল না, তুমি মুমিন নও।" ''লাস্তা মু'মিনান।"
বিষয়টা আসলেই অসাধারণ! এখন যে লোকটি আমার পাশ অতিক্রম করে গেল আমি শুধু তাকে মুসলিমই মনে করবো না বরং আমি মনে মনে ধরে নিবো সে একজন আন্তরিক বিশ্বাসী যার মাঝে মুনাফিকির সম্ভাবনা নেই। এই লোকের ভেতরে মুনাফিকির কোন সম্ভাবনা নেই। সে যে মুনাফিক নয় এ ব্যাপারে আমার কাছে একমাত্র যে প্রমাণটি রয়েছে তাহলো, সে বলেছে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ। শুধু এটাই। এটাই কুরআনের অভিমত। জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন দেখা দিবে এমন পরিস্থিতিতেই এই নিয়ম! সে সময় ভুল হলে আপনি মারা যেতে পারেন।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, সে সালাম দিয়েছে ঠিকাছে, কিন্তু আমি নিশ্চিত নই। আল্লাহ বলছেন তোমার নিশ্চিত হওয়ার জন্য সালামই যথেষ্ট। যদি কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়ে জীবনও হারান, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু কারো ঈমানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা তোমার জন্য আরও বড় বিপদ। সেটা তোমার দুনিয়া আখিরাহ দুইটাই বরবাদ করবে।
আমরা ইন্টারেস্টিং একটি সময়ে বসবাস করছি যেখানে একজন মুসলিমের সালাম আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। একজন মুসলিম আপনাকে সালাম দেয়ার পরেও কীভাবে সে পোশাক পরেছে, তাকে কেমন দেখায়, তার দাঁড়ির সাইজ কত বড় বা তার হয়তো দাঁড়ি নেই, বা তার কথায় হয়তো আঞ্চলিক টান আছে, সে কোন পরিবেশ থেকে এসেছে এসব দেখে আপনি বুঝে ফেলেন “আহারে! সে তো একটা মুনাফিক। আহ! সে এতো পথভ্রষ্ট!” কেউ কেউ বলবে, ওয়ালাইকুমুস সালাম, কিন্তু একইসাথে মনে মনে ভাববে, "এই লোক নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে। এটাই একমাত্র সান্ত্বনা যে সে মুসলিম।"
আমরা এতো বেশি বিভক্ত, কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করে আমরা তখন সাথে সাথে পরীক্ষা করতে শুরু করি সে কোন ধরণের পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত। কেউ সালাম দিলেই আপনি তাকে বিশ্বাসী মনে করেন না। আর সে আমার সাথে যে ঈমান শেয়ার করে তা আমার প্রতি আল্লাহর একটি রহমত, এই ধরণের চিন্তা আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে। ঐ দিনগুলো হারিয়ে গেছে যখন কোন মুসলিম ভাই অপর কোন মুসলিম ভাইকে সালাম দিতো, তখন সবধরনের শত্রুতা জানালা দিয়ে পালাত..."ফাআল্লাফা বাইনা কুলুওবিকুম, ফাআসবাহতুম বিনি'মাতিহি ইখওয়ানান" তিনি তোমাদের পরস্পরের অন্তরে ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছেন ফলে তোমরা ভাইয়ে ভাইয়ে পরিণত হয়েছ, শুধু তাঁর অনুগ্রহে। এই সালামই তোমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল।
কোন মুসলিম দেশে বা সমাজে বসবাস করা যে কত বড় নিয়ামত মুসলমানরা তা বুঝতেও পারে না। তারা এটাকে কোন নিয়ামতই মনে করে না। আমি যুক্তরাষ্ট্রের এমন অনেক শহরে গিয়েছি যেখানে মুসলমান নেই বললেই চলে। কিছুদিন পূর্বে এক ভাইয়ের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল যে ওকলাহোমা সিটিতে পঁয়তাল্লিশ বছর যাবত বসবাস করছে। আর ওকলাহোমা সিটিতে বেশি সংখ্যক মুসলমান বাস করে না, বিশেষ করে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। তিনি হয়তো কোন দোকানে গিয়েছেন কিছু কিনতে এমন সময় শুনতে পেলেন কে যেন কুরআন তিলাওয়াত করছে। দৌড় দিয়ে তার কাছে গিয়ে বললেন,
- আসসালামু আলাইকুম।
- সে তখন বলে, না, আমি মুসলমান নই।
- ও আপনি তাওরাত তিলাওয়াত করছিলেন! আমি বুঝতে পারিনি।
তারা হয়তো পরিবারসহ কোথাও যাচ্ছিলেন পথে হিজাব পরা কাউকে দেখলেন, তাড়াতাড়ি গাড়ি থামিয়ে বললেন - আসসালামু আলাইকুম। তারা খুবই উৎসাহী হয়ে পড়তেন যে তারা আরেকজন মুসলিমের সাক্ষাৎ পেয়েছেন! যাক, এখানে এমন একজন আছে যে আমাদের কালেমায় বিশ্বাস করে। কোন মুসলিম আশে পাশে না থাকলে ব্যাপারটা কেমন হত তা আমার আপনার পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন। কারণ, আলহামদুলিল্লাহ্‌, আমাদের আশে পাশে প্রচুর মুসলমান রয়েছে।
এই মুসলমানের অনেকেই আমাদের থেকে আলাদা। তাদের চিন্তাপদ্ধতি ভিন্ন, তারা হয়তো অন্য মাজহাব অনুসরণ করে, তাদের পোশাক-আশাক অন্য রকম, তারা ভিন্ন স্কলারদের পছন্দ করেন, আমরা যে মসজিদে যাই তারা সেখানে যায় না, তারা আমার পছন্দের সংগঠনের চেয়ে ভিন্ন কোন মুসলিম সংগঠন পছন্দ করে, তারা জাতিগত দিক থেকে ভিন্ন জাতির। এই ব্যাপারগুলো কোনটাই কোন ইস্যু হওয়ার কথা ছিল না। বস্তুত, জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন দেখা দেয় এমন পরিস্থিতিতেও এগুলো কোন ইস্যু হওয়ার কথা নয়। আর আমাদের জীবন তো হুমকির সম্মুখীন নয়। তথাপি, আমরা এগুলো নিয়ে মতবিরোধ তৈরি করি। আমাদের সালাম এখন যথেষ্ট নয়।
আমাদের পরস্পর সালাম বিনিময় এই ব্যাপারটার প্রতি ইঙ্গিত করে যে, একে অন্যের ঈমান বিচার করার কোন অধিকার আর আমাদের নেই।
উপদেশের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। কেউ যদি ভুল কিছু করে আপনি তাকে উপদেশ দিতে পারেন। আপনি সবচেয়ে সম্মানজনক উপায়ে তার ভুল দেখিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এটা তাদের ঈমান বিচার করা নয়। যেমনঃ "ভাই, আমি মনে করি আপনি ঐ মুরুব্বির সাথে উচ্চ আওয়াজে কথা বলেছেন, আমার মনে হয় আপনার এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি।" "ভাই, আপনি মনে হয় ভুল দিকে ফিরে নামাজ পড়ছেন, ঐটা কাবার দিক।" ছোট-খাটো ভুল ধরিয়ে দেয়া ঈমান বিচার করা নয়। এটা তো এমনিতেই আমাদের করার কথা। এটা জাস্ট নাসিহা। কিন্তু এর সাথে কারো চেহারা-সুরত দেখে চরম পর্যায়ের বিদ্বেষমূলক বিচার করার সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন না। সাহাবায়েকেরাম (রা) নানান বর্ণের ছিলেন। চেহারা-সুরতের দিক থেকে সবাই এক রকম ছিলেন না। তারা নানা রকম গোত্র থেকে এসেছিলেন। তাই এসব দেখে অন্যকে বিচার করার কোন অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি।
এই আয়াতের আলোকে সর্বশেষ যে কথাটি শেয়ার করতে চাই, আমরা যদি অনায়াসেই একে অন্যের ঈমান বিচার করে বসি, আমরা যদি মনে করি সালাম দেয়া যথেষ্ট নয়, তাহলে আমাদের সম্পর্কে আল্লাহর মন্তব্য হলঃ যদিও আমাদের দেখতে মুসলিম মনে হয় এবং আমরা মনে করি যে আমরা মুসলিম, তারপরেও আমাদের প্রচেষ্টা আসলে পার্থিব, তাবতাগুনা আরদাল হায়াতাদ দুনিয়া। তোমরা দুনিয়ার প্রেমে পড়ে গেছো, ঈমান তোমাদের কাছে আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। দুনিয়া তোমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আর তখনই তোমরা সহজেই অন্য মুসলমানদের বিচার করে বসবে, নিজেদের মাঝে বিভক্তি তৈরি করবে এবং অন্য মুসলিমদের দিকে নিচু দৃষ্টিতে তাকাবে।
আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের এমন মানুষে পরিণত করুন, যাদের একে অন্যের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা রয়েছে। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের এমন মানুষে পরিণত করুন, যারা সত্যিকার অর্থে আমাদের রাসুল (স) এর কথার মর্ম উপলব্ধি করতে পারে যখন তিনি সুন্দরতম উপায়ে বলেছেন - 'আফসুছ সালাম' সালাম ছড়িয়ে দাও। কারণ আপনি যখন সালামকে তার প্রকৃত অর্থে ছড়িয়ে দিবেন তখন আপনি আসলে যা ছড়িয়ে দিলেন তা হল, ভ্রাতৃত্ববোধ। আপনি আসলে যা ছড়িয়ে দিলেন তা হল, উম্মাহর মাঝে সম্প্রীতি এবং একে অন্যের প্রতি কোমলতা। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আমাদের অন্তরকে একে অন্যের প্রতি কোমল করে দিন এবং এমনকি আমরা যখন কাউকে সংশোধন করতে যাই, তখন যেন সবচেয়ে সম্মানজনক এবং ভালবাসাময় উপায়ে তা করি।

// কাউকে মু'মিন মনে করার জন্য তাঁর সালামই যথেষ্ট//
~ উস্তাদ নুমান আলী খান

পঠিত : ৩২৭ বার

মন্তব্য: ০