Alapon

ভাষা এবং আন্দোলন প্রসঙ্গে (০১)



“... ১৯৪৯ সাল থেকে ঢাকার ছাত্রমহলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। পূর্ববর্তী বৎসর ঢাকায় কায়েদে আজমের ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর পরই এই প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়েছিল। কায়েদে আজম বুঝতে পেরেছিলেন যে, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা সফল হওয়া সম্ভব নয়। ঢাকায় বক্তৃতার পর তিনি এ সম্পর্কে আর কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করেন নাই। এর কয়েক মাস পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ফলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন সাময়িকভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। প্রশ্নটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের ঘোষণা হিসাবে খাজা নাজিমুদ্দীনের এক বক্তৃতায়। সম্ভবতঃ ১৯৫২ সাৱে জানুয়ারীতে ঢাকায় এক জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দীন আকস্মিকভাবে ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এতেই আবার ধামাচাপাপড়া আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়।
ঢাকার ছাত্রসমাজেই সর্বপ্রথম এই প্রশ্ন অত্যন্ত উগ্র আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। ক্রমে মফস্বল শহরগুলির স্কুল-কলেজের ছাত্ররাও এ বিষয়ে সচেতন হয় এবং তাদের কণ্ঠ উর্দুর সঙ্গে বাঙলাকেও রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করতে হবে এই রবে মুখর হয়ে ওঠে। অতি অল্পদিনের মধ্যেই সারা পূর্ব-পাকিস্তানের রাস্তা-ঘাটে হাটে-বাজারে অগণ্য জনসমাবেশের মুখে উচ্চারিত হতে থাকে : “রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই”।
তদানীন্তন প্রাদেশিক নুরুল আমিন সরকার এই প্রশ্নটিকে খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। তারা সম্ভবত এটাকে একটা পাসিংফেজ হিসাবেই গণ্য করেছিলেন। কিন্তু এটা যে পাসিংফেজ ছিল না, অল্পদিনেই ক্রমবর্ধমান ছাত্র-বিক্ষোভের ভিতর দিয়েই তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠল। ঢাকার স্কুল এবং কলেজগুলিতে এই উপলক্ষে ধর্মঘটের হিড়িক পড়ে গেল। শহরের রাস্তায় রাস্তায় ছাত্র-বিক্ষোভের মিছিলের পর মিছিল বের হতে লাগল। ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্যের মাত্রা ক্রমে বেড়েই চলল। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের গ্রেফতারও যে না চলল, এমন নয়। প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশনের সময়ে ১৪৪ ধারা জারি করে ছাত্র-মিছিলের আইন পরিষদ-ভবনের সান্নিধানে যাওয়া নিষিদ্ধ হল।
অবস্থা চরমে উঠল ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী, মুতাবিক ১৩৫৭ সালের ৮ই ফাল্গুন তারিখে। সেদিন ঢাকার স্কুল-কলেজগুলিতে হরতাল ঘোষণা করা হয়েছিল এবং এক বিরাট ছাত্র-মিছিল ছাত্র জনতার উপর আইন পরিষদ-ভবনের সম্মুখে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল পুলিশের গুলী ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। শোনা যায়, পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে গমনকারী কয়েকজন মোটরবরাহী পরিষদ-সদস্যকে নাকি ছাত্র-মিছিলের তরফ থেকে পথে আটকাবার চেষ্টা হয়েছিল। এতেই গোলমাল পেকে ওঠে। পুলিশ বাধা দিতে চেষ্টা করে। ছাত্র-মিছিলের উপর পুলিশ নাকি লাঠিচার্জ করে এবং কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতারও করা হয়। ফলে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পায় এবং জনতার পক্ষ থেকে নাকি পুলিশের উদ্দেশে ঢিল ইত্যাদি ছোঁড়া হয়। ক্রমে অবস্থা একরূপ আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।
পুলিশ প্রথমে কাঁদুনে গ্যাস এবং পরে বেপরোয়া গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফলে জনতার বেশ কিছুসংখ্যক লোক হতাহত হয়। হতাহতের সংখ্যা কি ছিল এবং তাদের মধ্যে ছাত্রই বা কতজন ছিল সে-সম্পর্কে নানা ধরণের কথা শুনা গিয়েছিল। সঠিক হিসাব যে-কারণেই হোক পাওয়া যায় নাই - পাওয়ার উপায় ছিল না।
এ-সংবাদ যখন পেলাম, তখন আমি ‘আজাদ’ অফিসে কর্মরত অবস্থায় ছিলাম। এই মর্মন্তুদ খবরে এতই বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম যে, আমি তখন তখনই আমার আইন পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করে গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নুনের কাছে এক পত্র পাঠিয়ে দিলাম। পদত্যাগের কারণ হিসাবে তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, নিরস্ত্র জনতার উপর বেপরোয়া পুলিশী গুলীবর্ষণকে আমি জাতীয় সরকারের শাসনব্যবস্থার এক চরম কলঙ্কময় ঘটনা বলে মনে করি। এ সরকারের আইন উপদেষ্টা দলের একজন সদস্য হিসাবে সংশ্লিষ্ট থাকতে আমি দারুণ মনঃপীড়া অনুভব করছি। কাজেই এর সংশ্রব ত্যাগ করতে আমি বাধ্য হলাম।
পুলিশী গুলীবর্ষণ ও আমার ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপদত্যাগের খবর নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় আজাদের এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। গুলীবর্ষণের নিন্দা করে সে-সংখ্যায় অগ্নিবর্ষী ভাষায় যে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে ঢাকার নাগরিক মহলে, বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল বলে শুনেছি। পরদিন গুলীবর্ষণে নিহতদের স্মৃতিতে যে শোকসভা আহ্বান করা হয়, তাতে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছাত্রবন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন এসে আমাকে সে সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য এমন চেপে ধরেন যে, শোক-বিহ্বল চিত্ত নিয়েও আমার পক্ষে তাদের অনুরোধ রক্ষা না করে উপায় ছিল না। মেডিক্যাল কলেজের পাশে, বর্তমানে যেখানে শহীদমিনার অবস্থিত, সেখানেই পরদিন সে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ সে স্থানেই পুলিশী গুলীবর্ষণে কয়েকজন নিহত হয়েছিলেন। আমার চিত্ত সে-সময় এতই শোক-বিহ্বল ছিল যে, সভায় দীর্ঘক্ষণ ধরে ভাষণ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি সংক্ষিপ্ত ভাষণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমার মর্মবেদনা প্রকাশ করেছিলাম এবং যতদূর মনে পড়ে, পরদিন ‘আজাদে’ তা প্রকাশিত হয়েছিল।
এর পরদিন সংবাদ পেলাম, আর একজন এম-এল-এ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি জনাব আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তিনি অবশ্য আমার মতো এম-এল-এ-শীপ ত্যাগ করেন নাই, শুধু লীগ পার্লামেন্টারী দলই ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার অনেক বন্ধু আমাকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনিও কেন তেমন করলেন না? এম-এল-এ-শীপ ত্যাগ না করলেও পারতেন। আমি তাদের বলেছিলাম : না, আমি তা পারতাম না। লীগ টিকেটে যেহেতু আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম, তাই পরিষদে আসন বজায় রেখে সেখানে লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সাথে অসহযোগিতা করা আমি নীতিবিরুদ্ধ বলে মনে না করে পারি নাই। তাদের আরো বলেছিলাম, লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি ত্যাগ করেছি বটে, কিন্তু তাই বলে জাতীয় প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগ ত্যাগ করি নাই। কারণ যে-প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের জন্ম সম্ভব করেছে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমার এ কথায় তখন আমার অধিকাংশ বন্ধুই সায় দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু কিছুসংখ্যক বন্ধুদের কাছে আমার এ কথা যে ভালো লাগে নাই তা আমার বুঝতে দেরী হয় নাই। পরবর্তীকালেও দেখেছিলাম, আমি যেহেতু পার্লামেন্টারী পার্টি ত্যাগ করেছি, তাই মুসলিম লীগের সাথেও আমার সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে গেছে, এরূপ ধারণা অনেকের ছিল। কিন্তু তা যে সত্য নয়, তার প্রমাণ, আমি পরবর্তী নির্বাচনেও মুসলিমলীগ-টিকিটে সদস্যপদপ্রার্থী হয়েছিলাম।
বাঙলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতিলাভ করুক বা না করুক, কিন্তু এ-ভাষার সময়োপযোগী সংস্কার যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে তা তখন পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্বজ্জন মহলে গভীরভাবে উপলব্ধ হয়েছিল। প্রাদেশিক সরকারও তা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। শুধু বাঙলা ভাষা সংস্কার নয়, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা-ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাও প্রাদেশিক সরকার উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ফলে সরকারী উদ্যোগে দু’টি সংস্কার কমিটি কমিটি গঠিত হয় — (১) শিক্ষা-সংস্কার-কমিটি এবং (২) ভাষা-সংস্কার-কমিটি। উভয় কমিটিতে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব সভাপতি ছিলেন। আমাকে ভাষা-সংস্কার-কমিটিতে সদস্য হিসাবে নেয়া হয়েছিল। শেষােক্ত কমিটিতে ছিলেন মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল, আবুল হাসান, মোঃ হাবিবুল্লাহ বাহার, ডক্টর এনামুল হক এবং আরো কয়েকজন। কমিটির দু'একটি বৈঠকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাঙলা বিভাগের তদানীন্তন হেড গণেশবাবুকেও যোগ দিতে দেখেছি।
মওলানা মোঃ আকরম খাঁ সাহেবের বাড়ীর বৈঠকখানা ঘরেই সাধারণতঃ ভাষা সংস্কার-কমিটির বৈঠক বসত। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে কয়েকটি বৈঠকে ভাষা-সংস্কার-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। পাকিস্তানী ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাঙলা ভাষাকে নবরূপ দেয়ার জন্য এর কোন্ কোন্ বিষয়ে সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে কমিটির সভায় তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হত। আমি ছিলাম এর বহুল সংস্কারের পক্ষপাতী। বর্ণমালা থেকে শুরু করে ব্যাকরণ পর্যন্ত এর আদ্যন্ত সংস্কার দরকার, কমিটির অধিকাংশ সদস্যেরও অভিমত ছিল এই ধরনের। আমাদের মতে, বাঙলা ব্যাকরণ নামে যা প্রচলিত রয়েছে, তা সংস্কৃত ব্যাকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। বাঙলা ভাষাকে যেহেতু সংস্কৃতের দুহিতা, কিংবা দৌহিত্রী বলে আমরা স্বীকার করি না, তাই সংস্কৃত ব্যাকরণকে আমরা বাঙলা ব্যাকরণ বলে মানতে পারি না। আমাদের এই ধরনের অভিমত শুনে গণেশবাবু অবশ্য একটুখানি আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন এই বলে যে, ব্যাকরণ সম্পর্কে আমরা যেনো কোনো অভিমত প্রকাশ না করি, কারণ সে সম্পর্কে অধিকারী মাত্র তাদের মতো সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিরাই ! আমরা এর উত্তরে গণেশবাবুকে জানিয়েছিলামঃ দেখুন গণেশবাবু, বাঙলা ভাষাকে সংস্কৃতের আওতা থেকে মুক্ত করে আমরা যেভাবে এর সংস্কার করতে চাইছি, তাতে আপনার মতো সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি কোন কথা না বললেই সম্ভবতঃ শোভন হয়। এরপর গণেশবাবু আর বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্য করেন নাই এবং তাকে ভাষা-সংস্কার-কমিটির পরবর্তী কোনো বৈঠকে আর দেখাও যায় নাই।
যাহোক, কয়েকটি বৈঠকে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর আমরা ভাষা-সংস্কার সম্পর্কে যে সুপারিশ সর্বসম্মতিক্রমে প্রণয়ন করেছিলাম, তাতে বর্ণমালার সংস্কার করা হয়েছিল বিপুল এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের অনেক বিধিনিষেধই উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্বরবর্ণের ঈ, ঊ, ঋ, ৯, ঐ, ঔ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের ঙ, ঞ, ণ অন্তস্ত য, ষ, ক্ষ প্রভৃতি বর্ণ একদম বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। ডক্টর শহীদুল্লাহ ‘য়্যা’ নামক নতুন একটি বর্ণ সংযোজনের সুপারিশ করেছিলেন। ব্যাকরণ সম্পর্কেও বিপুল সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সংস্কৃত ব্যাকরণের খোল-নলচে বদলিয়ে বাঙলা ব্যাকরণের একটা নবরূপ দানের সুপারিশ আমরা করেছিলাম।
বাঙলা ভাষা-সংস্কার-কমিটির এই সুপারিশ দীর্ঘদিন কি কারণে যেনো সরকারী দফতরে ধামাচাপা পড়ে থাকে। দীর্ঘ সাত-আট বছর পরে সে সুপারিশ লোকচক্ষুর গোচরে আনা হয় বটে, কিন্তু তা নানা কারণে কার্যকরী করার সরকারী চেষ্টা হয় না। তবে তারও বহুদিন পরে বাঙলা একাডেমী ভাষা-সংস্কার সম্পর্কে একটি কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করে এবং তাদের সুপারিশ অনুসরণ করার জন্য শিক্ষা ও সাহিত্যপ্রতিষ্ঠানগুলিকে আহ্বান জানায়। বাংলা একাডেমীর সুপারিশের সাথে ভাষা-সংস্কার-কমিটির সুপারিশের খুব বেশী তফাৎ ছিল বলে মনে হয় না।
... ভাষা-আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তান আইন-পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হন, যার সারমর্ম ছিল এইরূপ : পূর্বপাক সরকার কেন্দ্রীয় গণ-পরিষদকে রাষ্ট্রভাষা-সম্পর্কিত পূর্বপাকিস্তানবাসীর মনোভাব যথাসময়ে জানাবেন। বাঙলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া না হলে বিক্ষুব্ধ পূর্বপাকিস্তানবাসী যে শান্ত হবে না এ-সত্যও তারা গণপরিষদকে অবহিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। তা তারা করেছিলেন এবং গণপরিষদে এ-ব্যাপার নিয়ে তুমুল আলোচনাও তখন হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ-সম্পর্কে কোনো ফয়সালা হয় নাই। তবে মনে হয়, গণপরিষদের সবাই এ-কথা ক্রমে সুস্পষ্টরূপেই বুঝতে পেরেছিলেন যে বিষয়টাকে ধামাচাপা দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। তাই পরবর্তী কালে বাঙলা ভাষাকে অন্যতর রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা পাক-বাঙলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে যে একটা নতুন চিন্তাধারা ও নয়া জীবনবোধের উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নাই। সাহিত্যসেবীরা ক্রমে উপলব্ধি করছিলেন যে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা শুধু এদেশবাসীর রাজনৈতিক জীবনেরই একটি পরিবর্তন সূচিত করে নাই, বরং এর সাহিত্যক্ষেত্রেও এ একটা নয়া জীবনবোধের বাস্তবতা ও স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর নিয়ে এসেছে। কিন্তু যারা পাকিস্তান-আন্দোলনের গভীর মূলে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন, শুধু মাত্র তাদের উপলব্ধিতেই এ সত্য ধরা পড়েছিল। তারা সংখ্যায় খুব বেশী ছিলেন বলে আমার মনে হয় নাই। বরং পাকিস্তান নিছক একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু নয়, সাধারণভাবে এ ধারণাই ছিল রাজনীতিবিদদের অধিকাংশের এবং সাহিত্যসেবীদের অনেকের। এই কারণেই তখনকার সাহিত্যসেবীদের একশ্রেণীর মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত ছিল যে, দেশ ভাগ হয়েছে বটে, কিন্তু ভাষা ভাগ হয় নাই। মনে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনৈক পণ্ডিত ব্যক্তির লেখায় আমরা তখন পড়েছিলাম : ‘বাঙলা দেশ ভাগ হয়েছে বটে, কিন্তু বাঙলা ভাষা একই রয়েছে।’ এটা যারা বলতে পেরেছিলেন তারা যে পাকিস্তানকে একটা রাজনৈতিক ভাগাভাগি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন নাই, তা স্বতঃই বোঝা যায়। কিন্তু বৃহত্তর দেশবাসী জানে, পাকিস্তানের উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক স্বাতন্ত্রই ছিল না, রাজনীতির সাথে জাতি, দেশ, সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কিত স্বাতন্ত্রও এর মূলে সক্রিয় ছিল।
তখনকার এক সাহিত্য-সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে আমি বলেছিলাম ‘পলাশীর বিপর্যয়ে জাতি হিসাবে জীবন্মৃত হয়ে পড়ার ফলে আমরা আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের তামদ্দুনিক বৈশিষ্ট্যের কথা, ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের শিক্ষানীতির গণতান্ত্রিক ও অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির বিশিষ্টতার কথা। আমরা ভুল পথে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। এইসব ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা জাতিকে দিয়েছে সত্যকার পথের সন্ধান। জাতির চিত্তলোক ফুঁড়ে উত্থিত হয়েছে পাকিস্তানের বাণী। এক মুহুর্তে জাতি স্বস্থতা ফিরে পেয়েছে। পরাণুকরণের আলেয়ার পশ্চাদ্ধাবন ত্যাগ করে সে স্বকীয়তাকে বরণ করেছে।’
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান লীগ সরকারের ভূমিকা খুব সুচারু ছিল না, সে-কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তার কারণ হয়ত প্রধানতঃ উপরতলার রাজনৈতিক চাপ, আর কিছুটা এখানকারই একশ্রেণীর লীগনেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মানসিক বিভ্রান্তি, দুর্বলতা ও সুবিধাবাদিতা। কারণ যাই হোক, এই আন্দোলনের ফলে তখনকার লীগসরকার জনপ্রিয়তা একেবারে হারিয়ে ফেলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এর পক্ষে ইন্ধন যোগানোর লোকেরও অভাব তখন ছিল না। ক্ষমতা ও গদীলোভী কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তো ছিলেনই, তার উপরে পাকিস্তান আন্দোলনকে যারা গভীরভাবে বুঝতে পারেন নাই বা বুঝতে চেষ্টা করেন নাই, তারাও এর মূলে ইন্ধন যোগানোর সুযোগ ত্যাগ করলেন না। ফলে লীগ সরকার-বিদ্বেষ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। ক্রমে সরকারবিদ্বেষ এমন চরমে পৌছল যে সোজাসুজিভাবে মুসলিম লীগ-বিদ্বেষেই তা পরিণতি লাভ করল। সরকার-বিদ্বেষ একেবারে জাতীয় প্রতিষ্ঠান-বিদ্বেষে পরিণত হল।
এটা ছিল নয়ারাষ্ট্র পাকিস্তান ও পাকিস্তানী জাতির পক্ষে চরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। যে প্রতিষ্ঠান নয়া রাষ্ট্রের পত্তন সম্ভব করেছে, তার পক্ষে এত অল্পদিনে জনপ্রিয়তা হারিয়ে বসা নয়া জাতি ও শিশু-রাষ্ট্রের পক্ষে একটি গুরুতর দুর্লক্ষণ বইকি। অতীতে কোনো নয়ারাষ্ট্রেই এমনটি দেখা যায় নাই। নবীন তুরস্কে রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠাতা কামালের দল ও প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর জনপ্রিয়তা হারায় নাই। লেনিনের কম্যুনিষ্ট পার্টি এখনো সোভিয়েট রাশিয়ার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে — এমন কি, ভারতের কংগ্রেস দল এই সেদিন পর্যন্তও দীর্ঘ কুড়ি বৎসর জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সুপ্রতিষ্ঠিত হতে না হতেই মাত্র পাঁচ বৎসরের মধ্যেই পাকিস্তানের পত্তনকারী মুসলিম লীগ ভাগ্যচক্রে জনপ্রিয়তা একেবারে হারিয়ে ফেলল। তার ফলে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা কতটা চরমে পৌঁছেছিল, সে দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস এখন সর্বজনবিদিত।
সে-সময় অনেক পূর্ব-পাকিস্তানী জনসাধারণের এই বিশৃঙ্খল মনোভাব ও আচরণকে তাদের রাজনীতি-সচেনতা বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল। পশ্চিম-পাকিস্তানী জনসাধারণের চাইতে পূর্ব-পাকিস্তানী জনসাধারণ যে অধিকতর রাজনীতিসচেতন, এ বিশৃঙ্খল আচরণ নাকি তারই প্রকাশ, এ ধরণের প্রচারণার বাহুল্য তখন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আমি কখনো এ ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারি নাই। আমার মনে হয়েছিল, রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতারই এ আরেক রূপ এবং রাজনীতি-সচেতনতা নয়, বরং হুজুগপ্রিয়তাই এর মূলে সক্রিয়॥”
— আবুল কালাম শামসুদ্দীন / অতীত দিনের স্মৃতি ॥ [ নওরোজ কিতাবিস্তান - সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮ । পৃ: ৩২৯-৩৩৯ ]

~কায় কাউস

পঠিত : ৩৫৯ বার

মন্তব্য: ০