Alapon

ভবিষ্যতবাণী : কেন এই অকারণ ঝুঁকি?



ভবিষ্যতবাণী করা মানেই কিন্তু ভয়াবহ ঝুঁকি নেয়া। একটা ভবিষ্যৎবাণী ভুল প্রমাণিত হওয়াই একজন ব্যক্তির অসততা আর মিথ্যাবাদীতা প্রকাশ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ, মানুষ ভবিষ্যত জানে না, জানতে পারে না। কাজেই, একজন ধূর্ত বুদ্ধিমান মানুষ, যে কিনা একইসাথে লোভী ও মিথ্যাবাদী, সে কখনোই ভবিষ্যতবাণী করে নিজের সততা আর বিশ্বস্ততাকে নিজের জীবদ্দশাতেই এরকম ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে ফেলে দিবে না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস থেকে এরকম অসংখ্য হাদীস থেকে ভবিষ্যতবাণীর সত্যতা আর প্রমাণ নিয়ে ‘কে উনি?’ বইতে বি-শা-ল আলোচনা থাকায় এখানে আর হাদীসের ভবিষ্যতবাণীগুলো উল্লেখ করছি না। নীচে শুধু কুরআন থেকে ভবিষ্যতবাণীগুলোই আলোচনা করা হবে। যেখানে একজন বুদ্ধিমান সৎ পাঠকের জন্য একটা ভবিষ্যতবাণী তুলে ধরাই যথেষ্ট, সেখানে আমি কুরআন থেকে অন্তত তিনটা ভবিষ্যৎবাণী তুলে ধরছি, যেন অন্তরের মাঝে সত্যটা আরো তিনগুণ বেশি গেঁড়ে বসে, জ্ঞান ও বুঝের ঘাটতিও যেন পুরোপুরি মিটে যায় আল্লাহর ইচ্ছায়।
রোমানদের জয়লাভ
পারসিয়ানরা তখন বেশ পরাক্রমশালী। রোমানদের হারিয়ে নাস্তানাবুদ করে দিল। জেরুজালেমসহ বিজিত সাম্রাজ্যের অধিকাংশ ভূখণ্ড থেকে রোমানদের উচ্ছেদ করে দেওয়া হলো।
তখন ৬১৫ কি ৬১৬ খ্রিস্টাব্দ। মক্কাতে কুরাইশদের তীব্র অত্যাচারে মুসলিমরা নির্যাতিত, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত, রক্তাক্ত। কুরাইশরা মূর্তিপূজা করত বলে আগুনের পূজারী পারসিকদের বিজয়ে তাদের উল্লাস আর আনন্দিত হওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক। উল্টোদিকে পথভ্রষ্ট হয়ে গেলেও শেষ নবি ঈসা আলাইহিস সালাম-এর অনুসারী হওয়ায় রোমান খ্রিস্টানদের প্রতিই ছিল নির্যাতিত মুসলমানদের আকুণ্ঠ সমর্থন। রোমানদের নির্মম পরাজয়ের এই টানটান উত্তেজনার সময়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু আয়াত অবতীর্ণ হলো। আয়াতগুলোর বাংলা অনুবাদের প্রতিটা কথা খুঁটিয়ে দেখা যাক :
“রোমানরা নিকটবর্তী দেশে পরাজিত হয়েছে এবং নিজেদের এ পরাজয়ের পর কয়েক বছরের[1] মধ্যে তারা বিজয় লাভ করবে৷ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আগেও আল্লাহরই ছিল৷ পরেও তাঁরই থাকবে৷ আর সেদিনটি হবে এমন দিন যেদিন আল্লাহ-প্রদত্ত বিজয়ে মুসলমানরা আনন্দে উৎফুল্ল হবে৷” [সূরা রুম : ২-৪]
মুসলিমদের কাছে আল্লাহর দেওয়া এই ভবিষ্যৎবাণী শুনে বিস্ময়ে মক্কার অবিশ্বাসীদের চোয়াল ঝুলে পড়ে। বলে কী এরা! পারসিয়ানদের মতো পরাক্রমশালীরা হারবে! তাও কিনা আবার রোমানদের কাছে! রোমানরা এইভাবে গো-হারা হেরে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরেও! এর চেয়ে অবিশ্বাস্য কথা এই সময়ে আর কীই-বা হতে পারে? কয়েক বছর কেন, কয়েক যুগেও যে ওদেরকে পরাজিত করার চিন্তা পুরোপুরি হাস্যকর! রোমানরা নাকি আবার এমন দিনে বিজয়ী হবে যেদিন আল্লাহ-প্রদত্ত বিজয়ে মুসলমানরাও আনন্দে উৎফুল্ল হবে! কী হাস্যকর! হাহাহাঃ!
আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন এসব আয়াত শুনলেন, তখন মক্কার চতুষ্পার্শ্বে এবং মুশরিকদের সমাবেশ ও বাজারে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করলেন, তোমাদের আনন্দিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কয়েক বছরের মধ্যে রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে। মুশরিকদের মধ্যে উবাই ইবনে খালফ বলে বসল,
“তুমি মিথ্যা বলছ। এরকম হতেই পারে না।”
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, “আল্লাহর দুশমন, তুই-ই মিথ্যাবাদী। আমি এই ঘটনার জন্যে বাজি রাখতে প্ৰস্তুত আছি। যদি তিন বছরের মধ্যে রোমকরা বিজয়ী না হয়, তবে আমি তোকে দশটি উষ্ট্রী দেব।”
দশটি উষ্ট্রী মানে কিন্তু দশটা দামী গাড়ি! ভাবা যায়?
উবাই এতে সম্মত হল। একথা বলে আবু বকর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে ঘটনা বিবৃত করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝিয়ে বললেন, এখানে তো তিন বছরের সময় নির্দিষ্ট করা হয়নি। কুরআনে এই জন্যে بضع শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে এই ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি (সা) আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিলেন,
“তুমি যাও এবং উবাইকে বল যে, আমি দশটি উষ্ট্রীর স্থলে একশ উষ্ট্রী বাজি রাখছি, কিন্তু সময়কাল তিন বছরের পরিবর্তে নয় বছর (কোন কোন বর্ণনা মতে সাত বছর) নির্দিষ্ট করছি।”
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আদেশ পালন করলেন এবং উবাইও নতুন চুক্তিতে সম্মত হল। [তিরমিযী: ৩১৯৩, ৩১৯৪][2]
এই বি-শা-ল বাজি ধরার ৫ বছর পর মক্কার কাফিরদের তীব্র অত্যাচারে জীবন বাঁচাতে মুসলমানরা মদীনাতে হিজরত করতে বাধ্য হয়। এমনকি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও তারা খুন করে ফেলতে যায়। আল্লাহর রহমতে তিনিও নিরাপদে মদীনাতে চলে যেতে সক্ষম হন। এক আল্লাহর কথা জানাতে গিয়ে ঘর-বাড়ি ছাড়তে হলো। ছাড়তে হলো আত্মীয়-পরিজন। ব্যবসা-ক্যারিয়ার, ধন-সম্পত্তি সব ফেলে যেতে হলো মুসলমানদের। ঠাই মিলল মদীনায়।
কিন্তু মদীনায় গিয়ে ঠাই মিললেও, শান্তি মিলল না। হিজরতের দুই বছর পর মক্কার অবিশ্বাসীরা সুপ্রস্তুত সশস্ত্র ১০০০ সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করে বসে হাতেগোনা মুসলমানদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যে। বদরের প্রান্তরে মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান জান বাজি রেখে এই বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র সৈন্যদলের মুখোমুখি হয়। এই সামান্য ক’জন সৈন্য নিয়েও মুসলমানরা ছিলেন অকুতোভয়। তারা জানতেন, বিজয়ের সাথে সৈন্য সংখ্যার কোনো সম্পর্কই নেই, বরং বিজয় আসে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে। সেই আল্লাহর উপরেই ছিল তাদের সবটুকু ভরসা। আর আল্লাহও তাদেরকে সাহায্য করলেন।
এই বেখাপ্পা অসম যুদ্ধে মুসলিমরাই জিতে গেল।
কী আজীব আর অসাধারণ এক বিজয়!
যে বিজয় শুধুমাত্র এক আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে এবং এসেছে।
বদরের যুদ্ধে আল্লাহ-প্রদত্ত বিজয়ে মুসলিমরা যখন আনন্দে উৎফুল্ল ঠিক সেইদিনই তাদের কাছে আরেকটা অসাধারণ খবর পৌঁছল। পারসিয়ানদের হারিয়ে দিয়ে রোমানরাও বিজয়ী হয়েছে।
সাত বছর আগে নাজিল হওয়া কুরআনের বাণী যে সত্য হবেই হবে এটাতো জানা কথাই। এই বাণী যে একমাত্র সেই আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে যিনি সকল ক্ষমতা আর কর্তৃত্বের নিরঙ্কুশ অধিকারী। যিনি অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের সব জানেন।
যিনি ইবাদাতের জন্যে একমাত্র যোগ্য সত্তা।
--------------------------

রেফারেন্সঃ
[1] আরবীতে “بضع سنين” এর অর্থ হচ্ছে “তিন থেকে দশ বছর” । এ আয়াতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে, অনধিক নয় বছরের মধ্যে রোমানরা পারসিকদের উপর বিজয় লাভ করবে।

পঠিত : ২০৪ বার

মন্তব্য: ০