Alapon

'বড় কাটরা'



ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ শোষণ পরবর্তী সময়ে এসে ইসলামী সভ্যতার ৭০০ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজতে গেলে আমাদের হতাশ হতে হয়। ২০০ বছর শোষণের ফলশ্রুতিতে ইসলামী সভ্যতার কোন চিহ্নই আমরা খুঁজে পাইনা। বাংলা অঞ্চলে ইসলামী সভ্যতার ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে কেবল কিছু স্থাপত্য টিকে আছে। এর মধ্যে বড় কাটরা অন্যতম।

মুঘল আমলে নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকীর্তির মধ্যে বড় কাটরা উল্লেখযোগ্য। মুঘলদের সময়ে দুটি কাটরা নির্মিত হয়, যার মধ্যে বড় কাটরা একটি। ঢাকার চকবাজারের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এটি অবস্থিত। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪৪ সালে দেওয়ান মীর আবুল কাসিম এই ইমারতটি নির্মান করেন। তিনি ছিলেন শাহ সুজার প্রধান স্থপতি। এ কারণে তাকে 'মীর-ই-ইমারত' নামে ডাকা হতো।

বড় কাটরায় ফারসি ভাষায় লিখিত দুইটি শিলালিপি রয়েছে। একটিতে এই ভবন নির্মাণের সময়কাল ১০৫৩ হিজরি (১৬৪৩-১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) এবং অপরটিতে ১০৫৫ হিজরি (১৬৪৫-১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দ) উল্লেখ করা হয়েছে।

অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটক তখন এর স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হতেন। তাদের অনেকের লেখনীতেই বড় কাটরার কথা উঠে এসেছে। শাহ সুজা ঢাকায় এলে কাটরার উত্তর অংশে থাকতেন। নওয়াব শায়েস্তা খাঁ ও মীর জুমলা এখান থেকেই দেশ শাসন করতেন। ১৭৬৫ সালে নিমতলী প্রাসাদ নির্মাণের আগ পর্যন্ত এই কাটরাতেই দরবার বসতো। পরবর্তীতে শাহ সুজা সেটি মীর কাসিমকে সরাইখানা হিসেবে ব্যবহারের দায়িত্ব দেন এ শর্তে যে, "এ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীগণ কাটরায় অবস্থানের প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তির কাছ থেকে কোন প্রকার ভাড়া গ্রহণ করবেন না।"
ঢাকার বড় কাটরায় অবস্থিত সরাইখানাটির ব্যয় নির্বাহের জন্য ২২টি দোকান ওয়াকফ করা হয়েছিল।

উত্তর ভারতের 'ক্যারাভ্যান সরাই'-এর ঐতিহ্য অনুকরণে বড় কাটরা নির্মিত হয়। প্রথমে এটি একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনকে পরিবেষ্টন করে নির্মিত হয়েছিল যার চারদিকে ছিল মোট ২২টি কক্ষ। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি প্রবেশপথ ছিল। কাটরার সম্মুখভাগ বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে এবং এ কারণে এর দক্ষিন অংশ সুনিপুণ পরিকল্পনায় নির্মিত। মুঘল রীতিতে এর শিল্পবিন্যাস করা হয়েছিল। ইমারতটির সুউচ্চ তিনতলাবিশিষ্ট প্রবেশপথ অষ্টভুজাকৃতির কেন্দ্রীয় কক্ষকে ধারণ করে আছে। এই কেন্দ্রীয় কক্ষ বা হল কামরার উপরের ছাদ ছিল গম্বুজাকৃতির এবং তাতে পলেস্তরার উপর নানা রকম লতাপাতার সুন্দর অলংকরণ ছিল। ত্রিতল প্রবেশপথের দুই পাশে দুটি প্রহরীকক্ষ। কাটরার ইমারতের অবশিষ্ট অংশ দ্বিতল এবং সম্প্রসারিত অষ্টভুজাকৃতির বুরুজকে ধারণ করে আছে। উনিশ শতকে প্রাচ্যবিদ জেমস অ্যাটকিনসন এই ইমারতটিকে "গ্র্যান্ড ও সুন্দর আর্কিটেকচারের মজাদার স্তুপ" হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। দক্ষিণ ব্লকের দুই কোণে দুটি টাওয়ার রয়েছে। অষ্টকোণাকৃতির টাওয়ার দুটির ফাঁকা প্যানেল অলংকরণ সম্বলিত। কোণার কক্ষসমূহ থেকে এ টাওয়ার দুটিতে যাওয়া যায়।

একসময় স্থাপত্য সৌন্দর্যের কারনে বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি ভগ্নাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। মালিক পক্ষের আপত্তির কারনে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক ভবনটি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় নি। এছাড়াও ভবনে অবস্থানকারীদের অনেকেই বহুবার এর বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এক সময় বড় কাটরার তোরণে ফার্সি ভাষায় শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজী লিখিত একটি পাথরের ফলক লাগানো ছিল। যেখানে এই সরাইখানার নির্মাতা ও এর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় নির্বাহের পন্থা সম্পর্কে জানা যায়। ফলকে লেখা ছিল:
"সুলতান শাহ্‌ সুজা সব সময় দান-খয়রাতে মশগুল থাকিতেন। তাই খোদার করুণালাভের আশায় আবুল কাসেম তুব্বা হোসায়নি সৌভাগ্যসূচক এই দালানটি নির্মাণ করিলেন। ইহার সঙ্গে ২২টি দোকানঘর যুক্ত হইল- যাহাতে এইগুলির আয়ে ইহার মেরামতকার্য চলিতে পারে এবং ইহাতে মুসাফিরদের বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা হইতে পারে। এই বিধি কখনো বাতিল করা যাইবে না। বাতিল করিলে অপরাধী শেষ বিচার দিনে শাস্তি লাভ করিবে। শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজি কর্তৃক এই ফলকটি লিখিত হইল।"

ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও বড় কাটরা ইমারতটি বাংলায় মুঘল স্থাপত্যের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন এবং এখনো এটি স্থপতির অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। বড় কাটরা সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে জাঁকাল মুঘল সৌধ। বর্তমানে এটি জামি হোসাইনি আশরাফুল উলুম, বড় কাটরা মাদরাসার তত্ত্বাবধানে রয়েছে। উক্ত এলাকায় বর্তমানে প্রবেশ তোরণযুক্ত ইমারতের নিদর্শন চিহ্নের বিদ্যমান ধ্বংসাবশেষের মাঝে বড় কাটরার প্রকৃত কোনো অবয়ব চোখে পড়ে না আর। চার্লস ডি অয়েলির আঁকা স্কেচ থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে এককালে এটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত নিদর্শন রূপে বিদ্যমান ছিল। আজ তা কেবলই ইতিহাস।

পঠিত : ৩৯৪ বার

মন্তব্য: ০