Alapon

উদার মানসিকতার মানুষ হবার অপেক্ষায়...

আল বিরুনি বলেছিলেন, ‘যে শহরের রাস্তাগুলো সংকীর্ণ, সেই শহরের মানুষের মনও সংকীর্ণ হয়’।


এই বাণী দেখে এখনোই কেউ বলে বসবেন না, ‘ঠিক কথা! পুরান ঢাকার রাস্তাগুলোও ছোট, বাসার মালিকের মনও ছোট।’


আমি এমন কিছু লিখতে বসিনি।


আল বিরুনি কেন এই কথাটি বলেছিলেন, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি।


ধরুন, আপনি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এ বন্ধুসহ খেতে গেছেন। খাওয়া শেষে বিল এল, ২০০০ টাকা। আপনি দাঁত বের করা হাসির সহিত গল্প করতে করতে সেই বিল পরিশোধও করে দিবেন। তার সাথে ওয়েটার মহাদয়কে ৫০ - ১০০ টাকা বকশিসও দিবেন। মুখের দু’পাটি দাঁত বের করে ২০০০ টাকা বিলের সাথে বকশিস দিতে আপনার কিন্তু একটুও কার্পণ্য বোধ হবে না। কেন জানেন?


চাইনিজ রেস্টুরেন্টের আলো-আঁধারি পরিবেশ, অধিক পরিচ্ছন্ন শ্রী আর বেয়ারার ন্যাক-টাই আপনাকে স্পর্শ করবে। চাইনিজ রেস্টুরেন্টের বৈভব আপনার অবস্থাকে তার পর্যায়ে উন্নিত করবে। সেকারণেই আপনার কার্পণ্য বোধ হবে না।


কিন্তু খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, রিক্সায় চেপে বাসার নিচে চলে আসার পর, রিক্সার ভাড়া পরিশোধ করবার সময়ই ঘটে বিপত্তি। রিক্সাওয়ালা হয়তো ৫ টা টাকা বেশিই চেয়েছে। তখনই আপনার-আমার আসল রূপটা বেরিয়ে আসে। রাস্তার ধুলাবালি আর ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা জ্যাম, আমাদের সেই রূপকে টেনে হিচড়ে রিক্সাওয়ালারও নিচে নামিয়ে আনে।


এটিও পরিবেশের বৈভবের কারণে হয়ে থাকে।


আবার ভাববেন না, আমি রিক্সাওয়ালাদেরকে ছোট করার জন্য বলছি। এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে পরিবেশ। আমাদের চারপাশের পরিবেশটা যেমন হবে, আমার মনের সংকীর্ণতা-উদারতাও তেমনি হবে। তাহলে আমাদের সমাজের পরিবেশটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মতো চাকচিক্যময় হবে কীভাবে?


এর উত্তর একটাই ‘শিক্ষা’। এই শিক্ষাকে আবার ক্লাসে ফাষ্ট-সেকেন্ড হওয়া ভালো ছাত্র হবার তথাকথিত শিক্ষা মনে করে বসবেন না। এই শিক্ষা নিয়ে কবি আল মাহমুদ চমতকারভাবে বলেছিলেন-


‘ক্লাসের সবচেয়ে নীরস গোমরামুখো ছেলেটি ছিল সবচেয়ে ভালো ছাত্র। সে হাসত না। দিনরাত তার একমাত্র কাজ ছিল উঁবু হয়ে অঙ্ক নিয়ে পড়ে থাকা। কিম্বা পড়া মুখস্ত করা। তাকে সবাই ঠেলত বেশি নম্বরের দিকে। পড়তে পড়তে তার চোখ দুটি ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। বড় হয়ে সে নিশ্চয়ই মানুষ হয়েছিল। আমরা কেউ জানি না সে কতবড় মানুষ হতে পেরেছিল। শুধু এটুকু আন্দাজ করি অনেক মানুষের ভিড়ে সে হারিয়ে গিয়েছে।' ( কবির মুখ- আল মাহমুদ)


উঁবু হয়ে পড়া মুখস্ত করা সেই শিক্ষার কথা বলছি না। আমি বলছি, ‘বই পড়ার কথা’। আবার এই বই পড়া সেই পড়াও কিন্তু নয়। আমাদের সমাজের অনেক মানুষই বলে থাকেন, তার নাকি প্রিয় শখ ‘বই পড়া’।


মানুষ শখের কাজটি কখন করে জানেন?


যখন তার হাতে কোনো কাজ থাকে না! সমস্ত মৌলিক কাজ সমাপ্ত করে যখন তার হাতে ফ্রি টাইম থাকে, তখনই সে শখের কাজগুলো করে। ‘প্রিয় শখ’ এর ব্যাপক অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘ফাও কাম’। আমাদের অধিকাংশের কাছেই বই পড়া একটা প্রিয় শখ অর্থাৎ ফাও কাম।


বই পড়াকে আমরা যতদিন না আমাদের মৌলিক কাজের ভিতরে অর্ন্তভুক্ত রতে পারব , আমাদের সমাজের পরিবেশ ততদিন উন্নত হবে না। বই পড়াকে যখনই আমাদের মৌলিক কাজে পরিণত করব, তখনই আমাদের সমাজের পরিবেশ পরিবর্তন হওয়া শুরু করবে। এক সময় এই সমাজ চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোর মতো চাকচিক্যময় রূপ ধারণ করবে।


আর এভাবেই আমরা উদার মানসিকতার মানুষ হতে পারব। সেই উদার মানসিকতার মানুষ হবার অপেক্ষায়...

পঠিত : ৬৬৮ বার

মন্তব্য: ০