Alapon

মুহাম্মদ আল ফাতিহ: রাসুলের ভবিষ্যতবাণী পূর্ণকারী অটোমান সুলতান...



উন্মত্ত সমুদ্রের ঝড়বিদ্ধস্ত জাহাজে রাত নেমে এলে সাধারণ যাত্রীরা যখন অন্ধকারে শঙ্কিত হয়, তখন একজন দক্ষ নাবিক সেই একই রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশে খুজে নেয় কাঙখিত পথের দিশা। সমুদ্রের স্রোতে জাহাজের দিক বদলাতে থাকে, আর সময়ের স্রোত বদলে দেয় মানুষের মন। এই বদলে যাওয়া ইতিহাসের পাতায় ক্ষণে ক্ষণে এমন বিদ্যুৎ চমকে ওঠে যা উলটে দেয় সময়ের ঘড়ি, পালটে দেয় সমস্ত হিসাব, পৃথিবী নামক জাহাজ ধেয়ে চলে এক নতুন দিগন্তে।

আজকের এই গল্প সেই মহানায়কের যিনি সমস্ত পরিসংখ্যান পালটে দিয়ে, প্রাচ্যের রোম খ্যাত দুই মহাদেশ ও দুই সাগরের শহর জয় করে উড়িয়েছিলেন তাওহীদের পতাকা।
পূরণ করেছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যতবাণী।
“নিশ্চয় একদিন মুসলিমরা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। কতই মুবারক সেই সেনাপতি, আর কতই মুবারক সেই সেনাদল”!

এক, আবির্ভাব

১৪৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে মার্চ, অটোমান সুলতান ২য় মুরাদের গ্রীক দাসি হুমা খাতুনের গর্ভে জন্ম নেন মুহাম্মদ। সাধারণত, অটোম্যান সুলতানের সন্তানদের ৫ বছর বয়সেই দেশ শাসনের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য রাজধানী থেকে দূরে কোনো রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অভিভাবক হিসেবে সাথে যান সন্তানের মা এবং একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। কিন্তু, মুরাদের ভাইদের সাথে চলমান গৃহ যুদ্ধের কারণে মুহাম্মদকে মাত্র ২ বছর বয়সেই পাঠিয়ে দেয়া হয় রাজধানী থেকে দূরে। মুহাম্মদ যখন আবার রাজধানীতে ফিরলেন, তখন তিনি ছিলেন তার ভাইদের মধ্যে সবথেকে অযোগ্য যুবরাজ!

৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ ছিলেন অত্যন্ত দাম্ভিক ও জেদি। কারোর কথা শুনতেন না। তার নিজের মতের বাইরে কিছুই করতেন না।
পিতার কাছে সকল সন্তানের জন্যে সমান ভালোবাসা থাকলেও, সুলতানের উত্তরাধিকার হতে পারেন শুধু যোগ্যতম যুবরাজ। সুলতান মুরাদের সন্তানদের মধ্যে যোগ্যতার বিচারে সবার নিচে নাম ছিলো মুহাম্মাদের। অথচ, শিশু বয়সেই মুহাম্মাদ এর বাকি তিন ভাই ইন্তেকাল করেন। যোগ্যতর সন্তানদের হারিয়ে সুলতান মুরাদ বাধ্য হলেন মুহাম্মাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে।

দুই, শিক্ষাজীবন:

মুরাদ তার একমাত্র উত্তরাধিকারীর তারবিয়াতের জন্য নিয়োগ দিলেন দুইজন বিশিষ্ট শিক্ষক–শায়েখ আহমদ আর কুরআনি এবং শায়েখ আক শামসুদ্দিনকে।

ইমাম কুরআনির জ্ঞানের জন্য তাকে মানুষ সেই যুগের আবু হানিফা বলে চিনতো। মুহাম্মদ সুলতানের পুত্র। শিক্ষকের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই দম্ভভরে হাসলেন। দাম্ভিকতার হাসি দেখে শিক্ষক হাতে নিলেন বেত। প্রহার করতে লাগলেন সুলতানপুত্রের উপর। পরবর্তীতে, মুহাম্মদ যখন সুলতান হয়েছিলো, তখন তার শিক্ষক এই প্রহারের কারণ হিসেবে বলেছিলেন, “আপনি ছিলেন হবু সুলতান। জুলুমের কষ্ট যদি আপনি না বোঝেন তবে কীভাবে আপনার প্রজাদের জুলুম থেকে বাচাবেন!”

এই শাসনের অভূতপূর্ব ফল হলো। উভয় শিক্ষকের দক্ষতায় মুহাম্মাদ অর্জন করলেন জ্ঞানের এক মহাসমুদ্র। তিনি একদিকে শিখছিলেন কুরআন, হাদিস, ফিকহ ইত্যাদির জ্ঞানগর্ভ পাঠ। অন্যদিকে, সুন্নি, শিয়া, ক্যাথলিক ইত্যাদি মতবাদ। মাত্র ১২ বছর বয়সে হয়েছিলেন কুরআনের হাফিজ। আরবি, ফারসি, তুর্কি, গ্রীক, ল্যাটিনসহ ৭ টা ভাষায় অনর্গল কথা বলার দক্ষতা অর্জন করেন। সমরবিদ্যাতেও হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত। দূর্গ, জাহাজ এবং কামান নির্মাণেও প্রতিভার সাক্ষর রাখেন।

অন্যদিকে, এক মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা চলছিল শায়েখ আক শামসুদ্দিন এর অধীনে।
শায়েখ শামসুদ্দিন তাকে নিয়ে গেলেন সমুদ্রের পারে। গিয়ে পানিতে নামালেন। কন্সটান্টিনোপলের দিকে আঙুল তুলে বললেন, “অবশ্যই তুমি একদিন কন্সটান্টিনোপল জয় করবে, ইনশাআল্লাহ”।

তিন, সিংহাসন

সন্তানের বহুমুখী প্রতিভা দেখে সুলতান মুরাদ অভিভূত হলেন। মাত্র ১২ বছরের বালক মুহাম্মদকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে গেলেন নির্জনবাসে আল্লাহর ইবাদত করতে।
মসনদে বসলো বালক মুহাম্মদ।

যেসব শত্রুরা মুরাদের ভয়ে তটস্থ থাকতো তারাই আক্রমণ করে বসলো অটোমানদের। শুধু শত্রু নয় বরং, আক শামসুদ্দিন এর ছায়াতলে থাকা মুহাম্মদকে পছন্দ করেনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমীরও! উজিরে আজম খলিল পাশা ছিলেন তাদের অন্যতম।

ঘরে ও বাইরে থেকে চাপ ও ষড়যন্ত্রের শিকার ১৪ বছরের বালক সুলতান মুহাম্মদ পিতাকে চিঠি লিখলেন যেন তিনি ফেরত এসে সাম্রাজ্যের হাল ধরে বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করেন। কিন্তু, মুরাদ তার নির্জনবাসে অবিচল। ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চিঠি দিলেন, “সুলতান তুমি, আমি নই”।

মুরাদ যতই নির্জনে বসে থাকুন, শত্রুরা বসে নেই। থেমে নেই আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ। মুহাম্মদ বিপদ আচ করে পিতাকে আবারো চিঠি লিখলেন। শক্ত ভাষায় বললেন,
“যদি আপনি সুলতান হন তবে নিজের রাজ্যকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করুন। আর, যদি আমি সুলতান হই তবে আমি আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছি ফিরে এসে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন”।

এই চিঠির পর মুরাদ সম্বিত ফিরে ফেলেন। আবারো সিংহাসনে আরোহন করলেন; আমৃত্যু। যুদ্ধে শত্রুরা পরাজিত হয়ে ফেরত গেল। আর মুহাম্মাদ ফেরত গেলেন আরো বেশি দক্ষ হয়ে উঠার শিক্ষা অর্জনে।

এর কয়েক বছর পর, একদিন যখন মুহাম্মদ দুরন্ত ঘোড়ার সাওয়ার, তার কাছে খবর গেলো, পিতা সুলতান মুরাদ আর নেই! ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সাথীদের নিয়ে রওনা দিলেন রাজধানীতে।

মুরাদের মৃত্যুতে খ্রিস্টান বিশ্বে চলছে মহাসমারোহ। পুত্র মুহাম্মদ তখন পিতার লাশের পাশে বসে কাদছেন। মা হুমা খাতুন এসে বললেন, “ওঠো, তোমাকে অনেক কিছু করতে হবে”। শত্রুরা যখন নিশ্চিন্তে মদ্যপানে ব্যস্ত সেই সময় পথহারা জাহাজের নাবিক জেগে উঠলেন।
মুহাম্মদ আরো একবার সিংহাসনে!

গত বারের বালক মুহাম্মদের অনভিজ্ঞতার আলোকে শত্রুরা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সেইসাথে আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে জানিসারি সিপাহিরা বেতন বাড়ানোর নামে বিদ্রোহ করে বসলো।

তবে, এবার আর মুহাম্মদ সেই ১৪ বছরের বালক নন। বরং, ২১ বছরের নওজোয়ান। রক্তে মিশে থাকা অতীতের উদ্দাম আর তীব্র জেদের সাথে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা।
কঠোর হস্তে দমন করলেন সব বিদ্রোহ। জানিসারি ইউনিট ভেঙে দিয়ে নতুন করে গড়লেন। বিদ্রোহী নেতাদের সরিয়ে নিয়োগ দিলেন বিশ্বস্তদের। অন্য সৈন্যদের ও নতুন করে প্রস্তুত করলেন। প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন এমন এক অভিযানের, যা একইসাথে পূরণ করবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যতবাণী এবং উসমানের সেই স্বপ্ন যার কথা তার প্রতিটা উত্তরাধিকার জানে, কন্সটান্টিনোপলের আংটি হাতে তাদের পরতেই হবে!

চার, কন্সটান্টিনোপল!

এই সেই শহর যার সম্পর্কে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “সমস্ত পৃথিবী যদি একটা দেশ হতো তবে তার রাজধানী হতো কন্সটান্টিনোপল”।

কন্সটান্টিনোপল ছিলো এমন এক নগরী যা শত শত বছর ধরে ছিলো অজেয়। খ্রিষ্টানদের চেতনা ও বিশ্বাসের সঙ্গে যার সম্পৃক্তি ছিল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। নাম দেন ‘নোভারোমা’ বা নতুন রোম। তবে কালের পরিক্রমায় তা হয়ে দাঁড়ায় কনস্টান্টিনোপলে। ৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট থিউডোসিয়াস তার দুই পুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। ফলে পশ্চিম রোম এবং পূর্ব রোম সাম্রাজ্য নামে দুইটি সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নাম হয় বাইজান্টাইন। কনস্টান্টিনোপল হয় তার রাজধানী। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও নগরীটি পরিচিতি লাভ করে।

প্রায় ত্রিভূজাকৃতির এই শহরের সিংহভাগ বেষ্টিত ছিলো পানি দিয়ে। উত্তরে গোল্ডেন হর্ণ, পূর্বে বসফরাস প্রণালি এবং দক্ষিণে মার্মারা সাগর। গোল্ডেন হর্ণের জলপথ দিয়ে চতুর্থ ক্রুসেডাররা শহর দখল করেছিল। এরপর থেকে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য এ পথে বসানো হয়েছে শক্তিশালী বিশেষ চেইন। এই চেইনকে এড়িয়ে কোন জাহাজের পক্ষে শহরে প্রবেশ করা অসম্ভব। চেইন টেনে শত্রু জাহাজের তলা ফাটিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া যায় খুব সহজেই। ফলে এদিক থেকে শহর একদম নিরাপদ।

এটি কেবল যে প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত ছিল তা নয়, এর চারদিকে ছিল ৪০ ফুট উঁচু ও ৬০ ফুট পুরুত্বের এক অজেয় দেওয়াল। দেওয়ালে ৫০ মিটার অন্তর অন্তর একটি করে ওয়াচ টাওয়ার ছিল, যেখানে থেকে সহজেই শত্রু সৈনিকের উপর গোলাবর্ষণ করা যেত, গরম পানি ঢেলে দেওয়া যেত। সাথে ছিলো বাইজেন্টাইনদের অদম্য অস্ত্র গ্রীক ফায়ার; এমন রাসায়নিক আগুন যা পানিতে নিভানো যায়না।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যতবাণীর পরে পার হয়ে গেছে ৮০০ বছর। অনেক মুসলিম বাহিনী চেষ্টা করেছে জয় করতে।

মুসলিমরা প্রথমবারের মতো কন্সট্যান্টিনোপল আক্রমন করে খলিফা মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর সময়ে। সেই সময়ে জীবিত সাহাবীরা ছিলেন সবথেকে বেশি আগ্রহী। হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারী ছিলেন অন্যতম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিযরতের পর মদীনায় এসে প্রথম যার বাড়িতে প্রথম অবস্থান করেন ইনি ছিলেন সেই সাহাবী।

যুদ্ধযাত্রার সময় তার বয়স ছিলো ৮০ বছর। শরীর দুর্বল, চোখেও কম দেখেন। সবাই তাকে বলছিলো, আল্লাহ আপনাকে ছাড় দিয়েছেন। আপনি কেন তাও যুদ্ধে যেতে চান?
তিনি জবাব হিসেবে বলেন কুরআনের সেই বিখ্যাত জিহাদের আয়াত, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ো, হালকা কিংবা ভারী, যেকোন অবস্থায়... (সূরা আত-তাওবা ৪১)
৬৭৩ সালে মুসলিম বাহিনী বের হলো কন্সটান্টিনোপল বিজয়ের জন্য। তিনদিক থেকে ঘেরাও করে এগোতে থাকেন কন্সটান্টিনোপলের বিখ্যাত দেয়ালের দিকে। প্রায় দেয়াল পর্যন্ত পৌছে গেলেও শক্ত থিওডেসিয়ান দেয়াল এবং গ্রীক ফায়ারের জন্যে দেয়াল অতিক্রম করা অসম্ভব প্রতীয়মান হচ্ছিলো। মুসলিম বাহিনী যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন
তিনি মুসলিম কমান্ডারকে ডেকে বলেন যাতে তাকে শত্রু সীমানার যত ভেতরে পারা যায় তত ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং কনস্টান্টিপোলের দেয়ালের কাছে তাকে দাফন করা হয়। দুদিন পর তার মৃত্যু হলে, মুসলিম সৈনিকরা তার ইচ্ছাপূরণ করে।

পাচ, যুদ্ধপ্রস্তুতি

সালতানাতের ক্ষমতা গ্রহণের পরই মুহাম্মদ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান বাণিজ্যপথ দখল করেন। সাইবেরিয়া ও ওয়ালেসের সাথে চুক্তি নবায়ন করে নেন।

বসফরাস প্রণালীর ইউরোপ তীরে “রুমেলি হিসারি” নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। ইতিহাস বলে, এই দূর্গ তৈরিতে সুলতান নিজে অংশ নিয়েছিলেন। অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে ১ বছরের কাজ মাত্র ৩ মাসে সম্পন্ন করে বাইজেন্টাইন সম্রাটকে অবাক করে দিয়েছিলেন। বসফরাস প্রণালীর এশিয়া তীরে আনাদোলু হিসারি নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন মুহাম্মদের দাদা সুলতান বায়জিদ ইয়েলদিরিম-বজ্রপাত। এই দুর্গ দুটি “থ্রোট কাটার” হয়ে কেটে দেয় বসফরাসের গলা। অটোমানদের অনুমতি ছাড়া কোনো জাহাজ আর বসফরাসের চলতে পারে না। চললেই দুই দূর্গ দুপাশ থেকে গোলা বর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয় জাহাজ।

এরসাথে তিনি প্রস্তুত করলেন অস্ত্র ও সৈন্য।

হাঙ্গেরির বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার আরবান কে ডেকে তৈরি করেন দানবীয় কামান ব্যাসিলিকা। ৬০ টা ষাড় ও ৩০০ সৈনিক কে বহন করতে হতো এই বৃহৎ কামান। ২৭২ কেজি ওজনের একটি গোলা প্রায় এক মাইল দূরে তীব্র গতিতে ছুড়ে মারতে পারতো এই কামান।

কন্সটান্টিনোপলের প্রাচীন থিওডেসিয়ান দেয়াল ভাঙ্গার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত কামান তখন আর একটিও ছিল না কোথাও। এর বাইরেও আরো অনেক রকম কামান তার নিজের ডিজাইনে তৈরি করান। সাথে ছিলো ৪০০ যুদ্ধজাহাজ, চলন্ত মিনারের মতো নব্য আবিষ্কার।
রাতে সুলতান মুহাম্মদ বেড়িয়েছিলেন নগরের বাজার ভ্রমনে। দোকানে ফল কিনতে গেলে দোকানি বললেন, “আমি আজ আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট রোজগার করেছি। আপনি দয়া করে অন্য দোকানিদের থেকে কিনুন”। পরবর্তী দোকানিও একই কথা বললেন! সুলতান বুঝলেন, এই দুনিয়াত্যাগী প্রজাদের সাথে নিয়েই তিনি সমুন্নত করতে পারবেন কালিমার পতাকা।

ছয়, আল ফাতিহ:

১৪৫৩ সালের ২ এপ্রিল ১২ হাজার জানিসারি, ২০ হাজার অশ্বারোহী, একলাখ পদাতিক, সৈন্য নিয়ে কন্সটান্টিনোপলের বাইরের স্থলভাগে তাবু ফেলেন সুলতান মুহাম্মদ। জলভাগে ছিলো যুদ্ধজাহাজ। শত্রুদের দেওয়া হয় ইসলামের দাওয়াত বা জিজিয়া। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য না পেয়ে বাইজেন্টাইন সম্রাট এবারো আত্মবিশ্বাসী হয়ে দেয়ালের ভরসায় ছেড়ে দিলেন কন্সটান্টিনোপল কে।

কিন্তু, ৬ এপ্রিল থেকে দানব কামান ব্যাসিলিকার আক্রমনে পুরো শহর থরথর করে কাপতে শুরু করলে, শহরের প্রতিটা মানুষের মনে ঢুকে যাচ্ছিলো ভয়। সাহায্যের জন্য সম্রাট আবেদন জানাতে লাগলেন। তবে, সাহায্য আসার সমস্ত পথ আটকে দিয়েছিলো সুলতাম মুহাম্মাদ। জেনোয়া ও ভেনিস থেকে বিশাল ৪ টি যুদ্ধজাহাজে নৌসাহায্য আসলে অটোম্যানরা তীব্র আক্রমণ করেও যখন হার মানলো তখন সুলতান ধরলেন এক নতুন পথ।
কাঠের গুড়িতে মোষের চর্বি মাখিয়ে করা হলো পিচ্ছিল। তার উপরে জাহাজ বসিয়ে টেনে নেওয়া হলো পাহারের উপর দিয়ে। এক রাতে গোল্ডের হর্ণের শেকলের ওপাশে নিয়ে যাওয়া হলো ৭০ টা জাহাজ, তাও আবার মাটির উপর দিয়ে! এই প্রক্রিয়াটি এত গোপনভাবে সম্পন্ন হয় যে সুলতান মুহাম্মদ বলেছিলেন, "আমার দাড়ির একটি চুলও যদি আমার পরিকল্পনার কথা জানতে পারে তবে আমি সেটাকে তুলে ফেলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব!"

এতো কিছুর পরেও অটোমানরা কোনোভাবেই চূড়ান্ত সফলতা পাচ্ছিলোনা। কামান ব্যাসিলিকার কিছু দুর্বলতা ছিলো। একবার গোলা বর্ষণের পর ঠান্ডা হতে অনেক ঘন্টা সময় নিতো। সেই ফাকে বাইজেন্টাইন সৈন্যরা দেওয়ালের সেই জায়গা মেরামত করে ফেলতো। এরপর সূলতান নির্দেশ দেন সুরঙ্গ খননের। সুরঙ্গে অর্ধেক ঢোকার পরে গ্রীক ফায়ারে মারা যায় হাজারো জানিসারি সৈন্য।

এভাবে প্রায় দুইমাস অবরোধের পর রসদ ও খাদ্যাভাবে সৈন্যরা অনেকটা অবসাদে নিপতিত হচ্ছিলো, সুলতান নিজেও দ্বিধায় ভুগছিলেন। কিন্তু, এমন সময় তার উস্তাদ শায়েখ আক শামসুদ্দিন স্বপ্নে হযরত আইয়ুব আল আনসারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)এর কবর দেখলেন। নির্দিষ্ট স্থানে খুঁজে হযরতের হাতে পাওয়া গেলো এক টুকরো কাগজ যাতে লেখা আছে, “কোনো সেনাবাহিনী যদি এই কবর খুজে পায়, তাকে যেন কন্সটান্টিনোপলের একটু মাটি দেয়”!

এই ঘটনায় সৈন্যরা আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলো। ২৮শে মে জল ও স্থলে সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মাঝরাত থেকে শুরু হয় প্রবল আক্রমণ। হাজার হাজার সৈন্য মারা যাচ্ছিলো কিন্তু উদ্যম হারাচ্ছিলোনা। ক্বারীরা তিলাওয়াত করছিলো জিহাদের আয়াত আর সৈন্যরা এগিয়ে যাচ্ছিলো দেওয়াল বরাবর। এক কাতার পরে গেলে এগিয়ে যাচ্ছিলো পরের কাতার।

অবশেষে,

৫৩ দিনের অক্লান্ত যুদ্ধের পর ২৯শে মে শুক্রবার জানিসারি দের সর্দার হাসান উলুবাদি উঠে পরেন দেওয়ালে। উড়িয়ে দেন কালিমা খচিত পতাকা। তার মনে তখন একটাই বাক্য, “এই শহরে যে সবার আগে প্রবেশ করবে সে জান্নাতে যাবে”!

আর সুলতান! তিনি এখন আর শুধু সুলতান মুহাম্মদ নন, তিনি এখন সেই মুবারক সেনাপতি; আল-ফাতিহ-বিজয়ী।

সাত, ইসলামবুল

“ক্যাথলিকদের লম্বা টুপির থেকে তুর্কিদের পাগরী আমাদের কাছে বেশি পছন্দনীয়”— পোপ কর্তৃক অর্থোডক্স চার্চের সকলকে ক্যাথলিকিকরনের যেই প্রস্তাব বাইজেন্টাইন সম্রাটের কাছে এসেছিলো তার জবাবে সাধারণ জনতা একথা-ই বলেছিলো।

তাদের ধারণা অবশ্য ভুল ছিলোনা। প্রথম ক্রুসেডে সজাতি হয়েও রোমান ক্যাথলিকরা তাদের অত্যাচার করেছে, গুড়িয়ে দিয়েছে সমস্ত স্থাপনা। সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কন্সটান্টিনোপল জয়ের পর অনুসরণ করেছিলেন তার উলটো পথ, যেপথে হেটেছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবীরা(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)।

শহরে প্রবেশ করলেন সুলতান। এতো সুন্দর একটা শহরকে যুদ্ধস্তুপ হিসেবে দেখে এতো কষ্ট পেয়েছিলেন যে, নিষিদ্ধ করেছিলেন সব ধরণের লুটতরাজ। ঘোষণা করেছিলেন, “নিজ ঘরে এবং চার্চে অবস্থানকারী প্রতিটা নাগরিক নিরাপদ”। এক সৈন্যকে আয়া সোফিয়ার দেওয়াল থেকে একটা মূল্যবান পাথর খুলতে দেখে তলোয়ারের এক খোচায় সাবধান করে দিলেন। শহরের সব চার্চকে চার্চ হিসেবে রাখলেও এই চার্চকেই মসজিদে রূপান্তরিত করেন। তারপর থেকেই আয়া সোফিয়া দাঁড়িয়ে আছে খ্রিস্টান বিশ্বে মুসলিমদের বিজয় গৌরবের নিদর্শন হয়ে। আয়া সোফিয়ায় ঢুকে নির্দেশ দিলেন জুম্মার আজান দিতে, আদায় করলেন সালাত। কন্সটান্টিনোপল নাম বদলে শজরের নাম দিলেন ইসলামবুল-ইসলামের শহর!

কন্সটান্টিনোপল বিজয়ের পরের সাতাশ বছরে তিনি অগণিত যুদ্ধ করেন একে একে জন হুনিয়াদি, ইস্কান্দার বেগ, কাউন্ট ড্রাকুলা, ম্যাথিয়াস করভিনাস আর স্টিফেন দ্য গ্রেট ও উজুন হাসানের সাথে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এশিয়া মাইনর, সার্বিয়া, আলবেনিয়া, ইতালি ও ক্রিমিয়া পর্যন্ত।

সুলতান শুধু একজন দক্ষ সমরবিদ ছিলেননা। সেইসাথে ছিলেন ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক।
কন্সটান্টিনোপল কে রাজধানী বানিয়ে তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধের ধারা অক্ষুন্ন রাখার সাথে সাথে মন দিয়েছেন সেই সাম্রাজ্যের আর্থসামাজিক উন্নয়নে।

তিনি গড়েছিলেন নতুন প্রশাসন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র। প্রতিষ্ঠা করেছেন বিখ্যাত সব মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসায়িক সংগঠন ও দুঃখীদের লঙ্গরখানা। একজন নাগরিকও বেকার ছিলোনা, সবাই ছিলো সুশিক্ষিত এবং সশিক্ষিত। ২৫ বছরের মাঝে তিনি কন্সটান্টিনোপলকে বানান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নগরীতে। আর উসমানীয় সাম্রাজ্যকে নিয়ে যান এক অনন্য শিখরে।

আট, অবসান:

পশ্চিম বিশ্বে সুলতানের জয় করা বাকি ছিলো শুধু পোপের শহর-রোম! রোম আক্রমণ করতে তিনি জেদিক পাশার অধীনে এক বিশাল বাহিনী পাঠান। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সেই বাহিনী অটরান্টো দূর্গ দখল করে অপেক্ষা করতে থাকে সুলতানের। সুলতান নিজেও প্রস্তুতি নিতে থাকেন যাত্রার। এই কথা ছড়িয়ে পরে সব জায়গায়।

পোপ নিজে এতো ভীত হয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি রোম ত্যাগ করার মতো ভাবনাও করতে থাকেন! সম্পদের মোহ ত্যাগ করে জীবন বাচানোই ছিলো তার একমাত্র লক্ষ্য।
কিন্তু, এমনই সময় ঘনিয়ে এসেছিলো সুলতানের মৃত্যুর পরোয়ানা!
৩ মে ১৪৮১ পারিবারিক অসুখ আর্থারাইটিসে সুলতান পরলোকগমন করেন।
পোপের কাছে ভেনিসের দূতের চিঠি গেলো, “দ্য গ্রেট ইগল ইজ ডেড!”

এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপে তিনি বিশ্বজয় করেছিলেন যে, তার মৃত্যুর পর খ্রিষ্টান বিশ্বে আনন্দের জলসা চলেছিলো। বেলা ১২ টার সময় পোপের নির্দেশে বাজানো হয়েছিলো আনন্দজ্ঞাপক ঘন্টা, “নুনবেল”। আর ইস্তাম্বুলের মসজিদে মসিজিদে চলেছিলো প্রজাদের দু'আর আসর আর কান্নার রোল! রহিমাহুল্লাহু।

শেষ জীবনে তিনি বারবার তিলাওয়াত করতেন সূরা নাসর।

“যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, আর আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহ্র দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার রবের প্ৰশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী।

- শেখ সুমাইয়া তাবাচ্ছুম

পঠিত : ১৬৩৪ বার

মন্তব্য: ০