Alapon

|| সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা মহানবী সা....


কথাবার্তা মানুষের বিশ্বাস ,চরিত্র ও মর্যাদাকে পুরোপুরিভাবে উন্মোচিত করে। কথাবার্তার বিষয় ও শব্দ চয়ন ,বাক্যের গঠন, শব্দের উত্থান-পতন বলার ভঙ্গি ও বর্ণনার তেজস্বিতা এসব কিছু বুঝিয়ে দেয় বক্তা কোন পর্যায়ের ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
রাসুল সা ছিলেন একজন উচ্চ মানের বক্তা। তিনি মানবজাতির জন্য একটা বিরাট ও মূল্যবান বার্তা বয়ে এনেছিলেন এবং এর জন্য বক্তৃতা ছিল অপরিহার্য। তৎকালীন আরবরা এমনিতেই সুবক্তা হতো। বিশেষত কুরাইশগণ হতো অসাধারণ বক্তৃতা শক্তির অধিকারী। আরব ও কোরাইশদের বক্তৃতা পরিবেশ থেকে রাসুল সা অনেক ঊর্ধ্বে থাকতেন। আল্লাহর দেয়া মহান বাণী কে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া আরবদের সাথে বাগ্নিতা মোকাবেলায় রাসুল সা এর সুবক্তা হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।

রাসুল সা ছিলেন একজন প্রচারক, আহ্বায়ক এবং একটি আন্দোলনের নেতা। এজন্য প্রচার ,শিক্ষা দান সংস্কার ও সংশোধন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তৎপরতা চালানোর জন্য তিনি উত্তম বাগ্নিতা প্রদর্শন করতেন।

সমাজের প্রয়োজন ও তার সার্বিক পরিবেশ অনুসারে তিনি ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য দিতেন। মসজিদে বক্তব্য দিলে নিজের লাঠির উপর ভর করে দাঁড়াতেন, আর যুদ্ধের ময়দানে ভাষণ দিলে কামানের উপর হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন। আল্লাহর প্রশংসা ও মহত্ত্ব ঘোষণার মধ্য দিয়েই প্রতিটি ভাষণ শুরু করতেন। তার জিহ্বা কখনো ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস এর মত, কখনো প্রবল স্রোতের মতো ,কখনো ধারালো তরবারি মত সক্রিয় হয়ে উঠত। তার মানসিক অসংকোচ, শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, অর্থের বিশুদ্ধতা মানুষকে অধিকতর প্রভাবিত করতে সক্ষম হতো।
বক্তৃতার সময় তার শরীর ডান দিকে ও বাম দিকে ঈষৎ ঝুঁকে যেত। প্রয়োজন মতো হাত নাড়াতেন। বক্তৃতার গুরত্ব শ্রোতাকে অনুধাবন করার জন্য কখনো এক বাক্য তিনবার উচ্চারণ করতেন। কখনো কখনো যার হাতে আমার প্রাণ, বা যার হাতে মুহাম্মদ এর জীবন তার শপথ ,এই বলে শপথ করতেন। তার মনের ভাবাবেগ তার স্বরে ও চেহারায় সমভাবে প্রতিফলিত হত।
কথাবার্তার সাথে মুচকি হাসি উপহার দিতেন। এ মুচকি হাসি, তার গাম্ভীর্যতাকে কঠোরতায় পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করত। কোন জিনিসকে ইশারায় বুঝালে পুরো হাতকে নাড়াতেন। বিস্ময় প্রকাশ করার সময় কখনও হাতের তালু উল্টিয়ে দিতেন, কখনো মাথা দোলাতেন এবং ঠোট দিয়ে চেপে ধরতেন, আবার কখনো উরু চাপড়াতেন।

রাসুল সা ছিলেন সর্বাপেক্ষা সুভাষী মানুষ। তার ভাষার সাহিত্যিক মানও যেমন উচ্চ ও উৎকৃষ্ট, তেমনই সহজবোধ্য ও সরল। সহজবোধ্য ভাষা ব্যবহার করলেও কখনো নিচু ও অশালীন শব্দ ব্যবহার করতেন না। কোনো কৃত্রিমতা ও ব্যবহার করতেন না। নিজের দাওয়াত ও নিজের লক্ষ্য পূরণে নিজস্ব ভাষা ও একটি স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি তৈরি করে নিয়েছিলেন।

রাসুল সা এর বক্তৃতা সাধারণ মানুষের কাছে চুম্বকের মত আকর্ষণ করতো। তাদের চিন্তার রাজ্যে এক প্রচণ্ড আলোড়ন ও পরিবর্তন সূচিত হত। তার উন্নত বাচনভঙ্গি শ্রোতাদের মনকে প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করত। তার বক্তব্যের প্রভাব এতটাই ছিল যে কোরাইশ নেতৃত্ব বর্গ‌‌‌ পর্যন্ত এর প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারেনি। রাসুল সা যখন বক্তব্য দিত তখন তারা কানে তুলো গুঁজে থাকত। তাদের মনে হত এই না হয় আমরা মুহাম্মদের কথার ছলে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে ফেলি।
রাসুলের বক্তব্যের মূল টার্নিং পয়েন্ট ছিল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতই ছিল তার বক্তব্যের মূলভাব।
রাসুল সা বক্তব্য দানের ক্ষেত্রে শ্রোতার কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর দিতেন। তিনি শ্রোতার মন-মানসিকতা ,যোগ্যতা ও অবস্থার প্রতি নজর রেখে এবং পরিবেশ -পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে উপদেশ দিতেন যাতে করে শুধুমাত্র যুক্তি প্রমাণ দ্বারা তৃপ্ত করে নয় বরং আবেগ অনুভূতি সৃষ্টি করে শ্রোতার মন জয় করা যায়। শ্রোতা যেন এ কথা মনে না করে যে উপদেশদাতা তাকে তাচ্ছিল্য করছে এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জানান দিচ্ছে। বরং সে অনুভব করবে উপদেশদাতা তার মনে তার সংশোধনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এবং আসলে সে তার ভালো চায়।

রাসূল তার জীবনে অনেক ভাষণ দিয়েছেন। তার মধ্যে দুটি ঐতিহাসিক ভাষণ হচ্ছে মক্কা বিজয়ের পর এবং বিদায় হজের সময়। বিদায় হজের ভাষণটি সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত।
মাত্র ১০৮ লাইনের অর্থাৎ ১০০০ শব্দে গঠিত। কিছু কিছু বিষয়ের উপস্থানের মাধ্যমে বিদায় হজের ভাষণ তার বক্তব্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।যেমন:
১.এবারই তোমাদের সাথে আমার শেষ দেখা, বলে সাহাবাদের আবেগকে সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে এসেছেন।

২. আমার কথা ধারণ করলে কখনও গোমরা হবেনা" বলে তিনি তাঁর বক্তব্যের ওজন তুলে ধরেছেন।

৩. “হে আল্লাহ। আমি কি তোমার বাণী পৌঁছেদিয়েছি" বলে তিনি তাঁর বক্তব্যের মূল্য ও ওজন তুলে ধরেছেন।
৪. তোমরা কি জান এটা কোন মাস? ইত্যাদি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তিনি বক্তব্যের ইমেজকে সবার ভিতর ছরিয়ে দিয়েছেন এবং সবাইকে বক্তব্যে অংশগ্রহনের সুযোগ দিয়েছেন। “
৫. "আমার পরে কোন নবী নেই বলে তিনি বুঝিয়েছেন এটাই বিশ্বের জন্য মানবতার জন্যসবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ।
৬.হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো বলে তিনি আবারও তিনি তাঁর বক্তব্যের ওজনকে তুলে ধরেছেন।
৭ কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। · বলে তিনি বুঝিয়েছেন এটি তাঁর রেসালাতের দায়িত্ব পালনের সাথে সম্পৃক্ত একটি অতীর মূল্যবান ভাষণ। যে জন্য আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন জনতাকে। এইভাবে তিনি সাতটি কায়দায় তাঁর বক্তব্যের সময় সর্বদা জনতার আবেগকে তুঙ্গে ধরে রেখেছেন।
এগুলো ছিল তার বক্তব্যের সহজাত বৈশিষ্ট্য। রাসুল সা রিসালাতের মহান দায়িত্ব তার সারা জীবন পালন করেছেন। আল্লাহর প্রদত্ত বিধানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সফলভাবে ।মানুষকে আহ্বান করেছেন কল্যাণের দিকে। আল্লাহর মহান বাণী তার কন্ঠনিঃসৃত বক্তব্যের মাধ্যমে আরও আকর্ষণীয় করে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। একজন সুবক্তা সকল বৈশিষ্ট্যই তার মাঝে বিদ্যমান ছিল।

|| সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা মহানবী সা....

তথ্যসূত্র,
*আর রাহীকুল মাখতুম: পৃষ্ঠা-৫৭৪,৫৮০
*মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা: পৃষ্ঠা-৮০-৮৭
*মুহাম্মদ দ্যা ম্যান এন্ড দ্যা প্রফেট: পৃষ্ঠা-৭৩৮
*সীরাত ইবনে হিশাম: পৃষ্ঠা:১৩৯,৩৫৪-৩৫৬
*তাফহীমুল কোরআন: সূরা নাহল।টিকা:১২২,১২৩

পঠিত : ৯৫৫ বার

মন্তব্য: ১

২০২২-০৪-২২ ১১:২৩

User
ইবনে ইসহাক

মাশাল্লাহ ভাই

submit