Alapon

ফতেহ বাঙ্গালাহঃ বাংলা এবং বাংলার বিজয়




ফতেহ বাঙ্গালাহঃ বাংলা এবং বাংলার বিজয়
সাজ্জাদুর রহমান

০১ - অমোঘ শাস্ত্রসন্দেশ

তের শতকের শুরুর দিকে,
দরবারী পণ্ডিতরা চিন্তিত এবং ভয়ার্ত মুখে রাজার সামনে দণ্ডায়মান। তারা আসন্ন বিপদ নিয়ে রাজাকে কিছু বলতে চায়। রাজা লক্ষ্ণণ সেন মূলত দুটি কাজে এখানে এসেছেন। একেতো, নদীয়া জায়গাটি গঙ্গা নদীর শাখা ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত একটি তীর্থস্থান, সমূহ পূণ্যলাভের সম্ভাবনা। এক বৃদ্ধ রাজার জন্য পূণ্যের চেয়ে বড় সওদা আর কি হতে পারে! দ্বিতীয়ত, উপকূলবর্তী সুন্দরবন এলাকার খাড়ি অঞ্চলের ডুম্মন পালের বিদ্রোহ দমন। এই পালদের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে উৎখাত করেই বাংলার শাসনক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল দক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আসা সেন বংশীয়রা। তারা ছিল বৌদ্ধ ধর্মানুসারী। ক্ষমতা পেয়েই সেনরা তাদের উপরে চালিয়েছিল অকথ্য নির্যাতন। পালদের সময়ে জারি থাকা উদার সমাজব্যবস্থায় তারা নিয়ে এসেছিল জাতিভেদের মত নৃশংস প্রথা। এখন আবার এই ডুম্মন পাল মহারাজাধিরাজ উপাধি নিয়ে বিদ্রোহী হয়ে শাসন শুরু করেছে। আবার খবর আসছে তুর্কিদের অগ্রযাত্রার। রাজপণ্ডিতগণ এসে সেই আশংকার কথাই শুনালেন, “বাংলাদেশ তুর্কীদের অধিকারে যাবে”।

“এক তুর্কী বীর বাংলাদেশ জয় করবে। সে দেখতে হবে অসুন্দর এবং আকৃতিতে ছোট। তার দুটি হাত হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হবে”। শাস্ত্রের কথা এভাবেই হুবহু রাজাকে শুনানো হল। পণ্ডিতরা পরামর্শ দিল শাস্ত্র মেনে রাজাকে স্বপরিবারে নদীয়া ছেড়ে পূর্ববাংলায় নিরাপদ কোনো স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিতে। তবে শাস্ত্র থেকে শত্রুর বর্ণনা পেয়ে লক্ষ্ণণ সেন চাইলেন সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে। সত্ত্বর বিহারে লোক পাঠানো হল। প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত মুসলিমদের শাসনানুগত হয়েছে একই ভাবে কিছুদিন হল বিহারও একই পথেই হেটেছে এক তুর্কী বীরের মাধ্যমে। বিহার থেকে ফিরে গিয়ে রাজার কাছে শাস্ত্রের কথার সত্যতা যাচাই করল প্রেরিত লোকটি। বিহারবিজয়ী বীর আসলেই আকৃতিতে ছোট, দেখতে অসুন্দর এবং তার হাতদুটো লম্বায় ছিল হাঁটুপর্যন্ত।

পণ্ডিতগণ এরকম সত্য বচন দেখে শীঘ্র নদীয়া ছেড়ে পালাল। লক্ষ্ণণ সেন রয়ে গেলেন। রাজাসুলভ আচরণ থেকেই দেশকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিলেন। তার রাজধানী ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই ডিফেন্স প্যারাডাইজ রাষ্ট্র। বর্তমান যুগের যুদ্ধবিশেষজ্ঞরাও এর স্বীকৃতি উচ্চকন্ঠেই দিয়ে থাকেন। তারা বিশেষভাবেই বলেন, “বাংলাদেশে বিশেষ করে বর্ষাকালে ট্যাংক নিয়ে কোনো শত্রুদল কিছুতেই সুবিধা নিতে পারবে না, এই রাষ্ট্র সার্বমৌসুমিক গেরিলা যুদ্ধের জন্য অসাধারণ ভূসত্ত্বার অধিকারী”। এর প্রমাণ আমরা মুক্তিযুদ্ধ থেকেই পায়। নদীমাতৃক এই দেশে পাক সেনারা বারবারই ঘোল খেয়েছে আমাদেরকে হোচট খাওয়তে গিয়ে। লক্ষ্ণণ সেনও একই রকম ভাবলেন।

বাংলাকে আক্রমণ করা যেত পশ্চিম দিক থেকেই। দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর, পূর্বে আসাম, ত্রিপুরা, চট্টগ্রামের পাহাড় এঁকে রক্ষা করত। তৎকালীন বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে গঙ্গার ধারে রাজমহলের পার্বত্য গিরিপথে তেলিয়াগড় দূর্গ অত্যন্ত সুদৃঢ় এবং দূর্ভেদ্য ছিল, একইসাথে ছিল সিকড়িগড় দূর্গও। এগুলো জয় করে বাংলা দখল করতে আসা সহজকম্ম ছিল না! তেলিয়াগড়ের দক্ষিণদিকে সারা পশ্চিম সীমান্তই ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। দুর্গম এই অঞ্চলকে বলা হয় ঝাড়খন্ড। আবার তেলিয়াগড়ের উত্তর-পশ্চিম দিকে দিয়ে প্রবাহিত ছিল কুশী সহ আরোও কয়েকটি খরস্রোতা নদীর ধারা। স্রোতস্বিনী গঙ্গার মূল ধারা বয়ে যেত তেলিয়াগড় ঘেঁষেই। তাই এসব দিক বিবেচনায় যেকোনো আক্রমণের জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল তেলিয়াগড় দূর্গ। নচেৎ জঙ্গল অতিক্রম করতে হত, নইলে নদীতে দেখাতে হত নৌ শক্তির পরাক্রম, যেখানে বাংলাদেশ অবশ্যই অদ্বিতীয় ছিল।

লক্ষ্ণণ সেন নদীয়াতে অবস্থান করেই তেলিয়াগড়ে সৈন্যসংখ্যা বাড়ালেন। নিশ্চিত হলেন কেননা বিহারে অবস্থিত তুর্কী বাহিনীর নৌশক্তি বলতে কিছু নেই। তাই তারা গঙ্গা দিয়ে আক্রমণ করার সাহস করবে না। বিশাল এবং দূর্গম ঝাড় অঞ্চল দিয়ে আসবার কথা তো পাগলও ভাববে না। সবমিলিয়ে তেলিয়াগড় সুরক্ষিত মানেই বাংলা সুরক্ষিত। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে রাজা একাকীই পুণ্যার্জনে ব্যাপৃত হলেন।


০২ - বীর উত্থান পর্ব

হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল সবাই। হাতির পা গলে গিয়ে পিছনের দুপায়ে শিকল পেঁচিয়ে ফেলেছে লোকটা। বিশালাকার পায়ের পেষণ একটুর জন্য এড়িয়ে গেছে। শিকলে পা আটকালেও এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। এবার যেন মুখোমুখিই হতে হল দুজনকে। মানুষ আর পাগলা হাতি! জমিন কেঁপে উঠা নাদে আবার দৌড়াতে শুরু করল হাতিটি। উপায় না পেয়ে ভারী হাতুড়িটা তুলে নিয়ে মাথা বরাবর ঠিক মাঝ জায়গাটা লক্ষ্য করে সজোরে ছুড়তে হল! নিক্ষেপ যথার্থ, লক্ষ্যভেদ। হাতিটি কাত হয়ে লুটিয়ে পড়ল ধুলোমাখা ময়দানে।

পাগলা হাতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে একজন মানুষ! সাহসিকতা এবং শক্তি পরীক্ষার জন্য! দিল্লীর শাসক সুলতান কুতব-উদ-দীন আইবেকের কানে কুমন্ত্রণা দিয়েছে কিছু আমীর এবং সভাসদ। তারই প্রেক্ষিতে এই আয়োজন। হয়ত এমনি কিছু মূহুর্তের সাক্ষী হতে হয়েছিল বখতিয়ারকে কেননা তিনি সেটি জিতে এসেছিলেন। শুধু শক্তির জোরে নয়, বুদ্ধি এবং সাহসিকতার পরাকাষ্ঠায়। চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল! সুলতানও যথাযোগ্য পুরষ্কার দিলেন।

বিহার বিজয়ের পর তিনি অনেক ধন-রত্ন নিয়ে সুলতানের কাছে আসেন। এতেই হিংসার বশবর্তী হয়ে কিছু আমীর তার নামে কুৎসা রটায়। তবে এতে তার সুনামই বেড়ে গেল সবার চোখে। দলে দলে আরো অনেক সৈন্য তার পতাকার নিচে সমবেত হল।

এই বখতিয়ার তুর্কীদের খলজী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। আফগানিস্তানের গরমসিরে তার বাসস্থান। দারিদ্রতার কষাঘাতে নিষ্পেষিত হয়ে জীবিকার উদ্দেশ্যে ভারত উপমহাদেশে অভিযানরত সুলতান মুঈজ-উদ-দীন মোহাম্মাদ এর সেনাবাহিনোতে যোগ দিতে উপস্থিত হন। সৈন্য হওয়ার জন্য শর্ত ছিল নিজ ঘোড়া এবং যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অন্তত ঢাল ও তরবারী থাকা লাগবে। গজনী থেকে দুঃখপ্রাপ্ত তবে আশায় ভরপুর চোখগুলো এবার ফিরল দিল্লিতে। সুলতান কুতব-উদ-দীন আইবেকের দরবারে। চেহারা-সুরতে নিতান্তই সাধারণ এবং ছোট বখতিয়ার এখানেও নিজেকে চেনানোর সুযোগ পেলেন না। তবে বাদায়ুনে পৌঁছলে মালিক হিজবর-উদ-দীন নগদ বেতনে চাকুরী দিলেন। অসন্তুষ্টচিত্ত সে এবার নিজেই ইস্তফা দিয়ে অযোধ্যার উদ্দেশ্যে বের হলেন। মালিক হুসাম-উদ-দীন যেন পাকা জহুরীর মত তাঁকে তুলে নিলেন, দুইটি পরগনার জায়গীরও দিলেন এবং মুসলিম রাজ্যের পূর্বসীমান্তে সীমান্তরক্ষী হিসেবে নিয়োগ করলেন। বখতিয়ার এখানে এসে যেন স্বপ্নছোঁয়া আকাশটাকে ধরতে পারলেন!

আশেপাশে হিন্দু রাজ্যগুলো থাকায় তিনি ইনসাফ কায়েমের নিয়তে রাজ্য বিস্তার অভিযান শুরু করলেন। হিন্দুদের মাঝে পারস্পারিক দ্বন্দ্ব, বিরোধ, জাতিভেদ প্রথার নির্মম বাস্তবতা, অস্থিরতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, জনগণের ইনসাফহীনতায় বসবাস সবকিছুই তাঁর বিজয়গুলোকে ত্বরান্বিত করল। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল তার বীরত্বগাঁথা, দিল্লির মসনদেও পৌঁছল। সবাই এসে ভীড় করল তার চারপাশে, সৈন্যসংখ্যা বাড়ল, মনোবল বাড়ল। তার সম্প্রদায়ের লোকজনও এসে সাথে যোগ দিল। তার অগ্রযাত্রা চলমান রইল। মানুষ ভরসা পেল “ইখতিয়ার-উদ-দীন মোহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী” নামে।


০৩ - নদীয়ানামা

বাংলাকে বখতিয়ারের হাত থেকে রক্ষার জন্যই লক্ষ্ণণ সেনের যাবতীয় প্রস্তুতি ছিল। সে ভেবেই রেখেছিল বখতিয়ার তেলিয়াগড় দূর্গ আক্রমণ এবং বিজয় না করে বাংলার মাটি মাড়াতে পারবে না। সাহসীরা ভিন্ন কিছু করে না, বরং তারা একই কাজ ভিন্নভাবে করে। একইভাবে বখতিয়ারও ভিন্নরকম কিছুই করলেন।

একজন দূর্দান্ত বীর হিসেবেই শুধু সুনাম ছিল না বখতিয়ার খলজীর, কৌশলী জেনারেল হিসেবেও ছিলেন সমান বিখ্যাত। আগেই যখন জানতে পারলেন লক্ষ্ণণ সেনের নেওয়া প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা তখন ভাবলেন আলাদা কিছু করতে হবে। কঠিন, দূর্গমকে আপন করে নিতে পারে তারাই যারা প্রকৃতই চেষ্টা করে। তিনিও একই পথে গেলেন। নৌশক্তি না থাকার দরুণ যেহেতু গঙ্গার পথের কথা ভাবাই যাবে না, সুরক্ষিত এবং সুদৃঢ় প্রতিরক্ষার জন্য তেলিয়াগড়ও দূর্ভেদ্য তখন ঝাড়খণ্ডই ভরসা। তবে ঝাড়খণ্ড তো অন্যান্য সাধারণ অঞ্চলের মত না, এখানে সৈন্যবিন্যাস থেকে শুরু করে যুদ্ধের পুরো পরিকল্পনাটাই আলাদাভাবে সাজাতে হবে।

সৈন্যবাহিনীকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিলেন শুরুতেই। অগ্রগামী দলে থাকলেন তিনি সহ মাত্র আঠারজন সওয়ার নিয়ে। ঘন ঝোপঝাড়বিশিষ্ট জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আগানোও সম্ভবপর ছিল না। পরিকল্পনামতই তারা এগিয়ে যেতে থাকল নদীয়া পানে, বুকে গঙ্গার সব ধারার পরিমাণ সাহস আর চোখে ইনসাফের রোশনী নিয়ে।


০৪ - বিজয়ের শুরু

অন্যান্য সাধারণ দিনের মতই ছিল সেদিন। তবে মুসলিমদের কাছে ছিল পবিত্র রমজান মাস, ১৯ তারিখ। নদীয়ার সব কাজকর্ম চলছিল, ব্যবসায়ীদের আনাগোনা, রাজার সেনাদের তটস্থ পাহারা আর চারদিকে চাপা আতঙ্ক। বনের দিক থেকে ছোট ছোট দলে বের হওয়া ঘোড়ারোহীদের অবশ্য ব্যবসায়ী ভিন্ন অন্যকিছু ভাবার সুযোগ ছিল না, কেননা রাজার গুপ্তচররা তখনো খবর পাঠায়নি বখতিয়ার খলজী তেলিয়াগড় আক্রমন করেছে।

শত্রুকে এরকম অপ্রস্তুত অবস্থাতে পেলেই তো বিজয় হয় সহজ এবং সাবলীল। জঙ্গল থেকে বের হয়েই তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটালেন রাজপ্রাসাদের দিকে। ততক্ষণে আরো এরকম ছোট ছোট সেনাদল আসতে দেখে সবার যা বুঝার তা বুঝা হয়ে গিয়েছে। মন্দ খবর দ্রুত ছড়ায়। কোনো রাজার জন্য যদি সেই খবরবাহী হয় বখতিয়ার খলজী তবে তা ছুটে বাতাসের বেগে। প্রাসাদের দরজায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তিনি শুনতে পেলেন রাজা পালিয়েছেন। অপরদিকে লক্ষ্ণণ সেন ধরেই নিলেন তেলিয়াগড় হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে নইলে এভাবে মুসলিম বাহিনী চলে আসা কখনোই সম্ভব ছিল না।

রাজা পালিয়ে গেলে রাজসৈন্যদলও অস্ত্র ফেলে দিল। বিনা যুদ্ধে নদীয়া মুসলিম শাসনানুগত হল। বখতিয়ার খলজী তিনদিন অবস্থান করে গনীমত নিয়ে লক্ষ্ণণাবতীর (গৌড়) উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানেও কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হল না তার। এখানেই রাজধানী স্থাপন করে নতুন রাজ্য সূচনা করলেন। লক্ষ্ণণাবতীই মুসলিম লেখকদের ভাষায় লাখনৌতি নামে অভিহিত হত।


০৫ - সভ্যতার হাতছানি

ভারত উপমহাদেশে মুসলমান রাজ্য তিনভাগে বিস্তার হতে দেখা যায়।
মুহাম্মাদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু ও মুলতান বিজয়।
গজনীর সুলতান আমীর সবুক্তগীন এবং তার ছেলে সুলতান মাহমুদের দশম শতাব্দীর শেষ দিক হতে পুনঃ পুনঃ আক্রমণের মাধ্যমে লাহোর পরিবেষ্টিত এলাকা গজনী সাম্রাজ্যে একীভূত হয়।
সুলতান মুঈজ-উদ-দীন মোহাম্মদ অর্থাৎ মোহাম্মাদ ঘুরীর নেতৃত্বে। এবারে শুধুই আক্রমণ নয় বরং দিল্লিকে কেন্দ্র করে মুসলিম সালতানাতও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয় এই পর্যায়ের অংশ।

খেয়াল রাখতে হবে সেন শাসনামল ছিল একটি বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। তাদের আগে কয়েকশত বছর রাজত্ব করা বৌদ্ধদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। তাদের নিজেদের মাঝেও ছিল তীব্র জাতিভেদ, বর্ণ-বৈষম্য। ব্রাক্ষ্মণদের ছিল দেবতাদের মত সম্মান, এরপরে ক্ষত্রীয়, পরে বৈশ্য এবং সর্বশেষ ছিল শূদ্ররা। বৈশ্যরা ছিল পেশাজীবি। বৌদ্ধ এবং শূদ্রদের উপর চলত চরম মাত্রার নিগৃহ। রাজ্যে সকল সুযোগ-সুবিধা ছিল ব্রাক্ষ্মণ এবং উচ্চশ্রেণীর জন্য। এসবের ফলে এই বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে সেটিই মূলত বখতিয়ার খলজীর এই বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। আমাদের মুক্তির নিশান হিসেবে আবির্ভূত হয়।

বখতিয়ার খলজী বিজয় করেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি এখানে একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমরা যদি ইসলামী সভ্যতা গঠনের উপাদানগুলি দিয়ে বিশ্লেষণ করি তবে বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝে আসবে।

ইসলামী সভ্যতা দাঁড়িয়ে থাকে কয়েকটি বিষয়ের উপর (২)।
বিশ্বাস
জ্ঞান
আদালত
সুন্দর সমাজব্যবস্থা
সমৃদ্ধ আর্থিকব্যবস্থা

খলজী কর্তৃক বাংলা বিজয়ের পর এ অঞ্চলে মুসলিমদের অবস্থান শুরু হয়। তবে এর আগে থেকেই আরব ব্যবসায়ীদের দ্বারা এ অঞ্চল সমাদৃত হয়েছিল। বাংলার সাথে অষ্টম শতাব্দী থেকেই আরবদের যোগাযোগের খবর পাওয়া যায়। বাংলা বিজয়ের ফলে দেখা যায় এ অঞ্চলীয় শিক্ষা, সাহিত্য বিস্তারে মুসলিমদের অবদান অবিস্মরণীয়। মুসলমান আমলেই বাংলা ভাষা সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে। বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি এবং বিকাশও এ আমলেই হয়। বাংলা বিজয়ের আগে সংস্কৃত ভাষাকে দেবভাষা হিসেবে নেওয়া হত, সাহিত্য বলতে ছিল শুধুমাত্র দেব-দেবীর গুণকীর্তন। সাহিত্য শুধু জ্ঞানই নয়, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম হাতিয়ারও। সাহিত্য সংস্কৃতিকে ধারণ করে বেড়ে উঠে। বলা যায়, মুসলমানরাই এই বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি কিভাবে চলবে তা নির্ধারণ করেছিল। আজকালকার হাজার বছরের ঐতিহ্যের নামে অধুনা যেসব প্রথাগুলো চলমান সেগুলো নিতান্তই কাঁচা, সভ্যতা বিনির্মাণে কোনো অবদান রাখতে পারছে না কিংবা পারবেও না।

বখতিয়ার খলজীর সময়ে তাকালেও আমরা দেখি তিনি মাদরাসা, খানকাহ, মসজিদ, ইত্যাদি বিজয়ের পরেই নির্মাণ করেছিলেন। এগুলোই ছিল আমাদের সামাজিক শক্তির ভিত্তি। এই বিজয়ের পর সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি রাজ্যকে কয়েকটি প্রশাসনিক ইউনিটে ভাগ করেন। সেগুলোকে বলা হত “ইকতা”, প্রতিটিতে থাকত একজন “মুকতা” বা শাসনকর্তা। আর্থিক ব্যবস্থায় আসলে দেখা যায় তিনি এ অঞ্চল বিজয় করলেও নিজ হাতে সার্বভৌমত্ব তুলে নেননি, বরং মুদ্রা প্রচলন করেন সুলতান মোহাম্মাদ ঘুরীর নামে। এখানে আমরা আরেকটা জিনিস খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি সেটি হচ্ছে আমাদের উম্মাহ কনসেপ্ট। তিনি সবার উপরে একতাবদ্ধ থাকাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তার সুযোগ ছিল এই দূর্ভেদ্য বাংলা অঞ্চল সার্বভৌম শাসক হিসেবে শাসন করার।

সবমিলে আমরা দেখতে পাই এই বিজয়ের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে একসময় গিয়ে স্বাধীন বাংলা সালতানাতও প্রতিষ্ঠা হয়। ১৩৩৮ সালে ফখর-উদ-দীন মোবারক শাহ সোনারগাঁওকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগেও কয়েকবারই লাখনৌতিসহ এ অঞ্চলে স্বাধীনতা ঘোষণা এসেছিল, তবে সেগুলো স্থায়ী হয়নি। সোনারগাঁও এর স্বাধীনতা ঘোষণার ফল ছিল প্রায় দুইশত বছর। পরবর্তীতে লাখনৌতির সুলতান শামস-উদ-দীন ইলিয়াস শাহ সাতগাঁও, সোনারগাঁও এবং লাখনৌতিকে একত্র করে পুরো বাংলাকে নিয়ে সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ প্রতিষ্ঠা করেন। শাহ-ই-বাঙ্গালাহ এবং সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ উপাধি নিয়ে তিনি শাসন করেছিলেন।

এই হচ্ছে আমাদের বিজয়গাঁথা, আমাদের সভ্যতার, আমাদের ঐতিহ্যের প্রসারের শুরুর ঘটনামালা। এই বিজয় বৈষম্য দূর করে এনেছিল বিশ্বাস, জ্ঞান, আদালতসমৃদ্ধ এক সভ্যতার বার্তা। আমাদের শপথ হোক সোনালী সুখের সেই সুন্দর সমাজ আবার ফিরিয়ে আনার।

তথ্যসূত্রঃ
বাংলার ইতিহাস - প্রফেসর আব্দুল করিম।
ইসলামী সভ্যতা এবং রমজান (বক্তব্য) - ড. হাফিজুর রহমান।

পঠিত : ৬১৪ বার

মন্তব্য: ০