Alapon

দেহঘড়ি ও প্রাসঙ্গিক সত্য


চিকিৎসায় নোবেলজয়ী তিন মার্কিন জিনবিজ্ঞানী- জেফরি সি হল, মাইকেল রোজব্যাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং। ফলের উপর বসে, এমন এক মাছির দেহঘড়ি নিয়ে গবেষণা করেন তারা। লক্ষ করেন প্রকৃতির সাথে মাছির দেহঘড়ির মিল। দেহঘড়ি সময়মতো মাছিকে ঘুম পাড়ায়, জাগিয়ে তোলে। তারা দেখান, প্রত্যেক প্রাণীর দেহের ভেতরে রয়েছে একটি ঘড়ি, যা বাইরের জগতের সাথে ভেতরের জগতের বন্ধন তৈরি করে। এ ঘড়িই নির্মাণ করে সক্রিয়তার এক অনিঃশেষ চক্র। এর প্রভাবে নির্ধারিত হয় দেহের অনুভূতি ও ব্যথা, তাপমাত্রা ও রক্তপ্রবাহ, মানসিক ক্রিয়া ও শারীরিক কার্যক্ষমতা। রাত। অন্ধকার ঢেকে ফেলেছে সব কিছু। দেহঘড়ি বলে দিচ্ছে এখন ঘুমাতে হবে। দিন। বাইরে থৈ থৈ করছে আলো। দেহ বুঝতে পারে, কোনো ঘুম নয়, এখন কাজ করতে হবে। যে দিবসটি অন্ধকারে আচ্ছাদিত, সেই দিবসেও দিনের কাজ করতে আমাদের নির্দেশ দেয় এই দেহঘড়ি।

দেহঘড়ির চক্র যথাযথভাবে চলার মানে হলো দেহকলা আপন আইন মেনে চলছে, আমাদের হরমোন, জিন আর অন্য সব শারীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে চলছে। খাবার হজম হচ্ছে। রক্তচাপ বাড়ছে-কমছে। জ্বর আসছে, আবার আসছে সুস্থতা। এ ঘড়ি ঠিক না থাকলে বিগড়ে যাবে শরীর। বদলে যাবে আমাদের বিপাকক্রিয়া, হৃৎক্রিয়া, মন ও মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতা। হবে ডায়াবেটিস। ঝামেলা করবে হৃৎপিণ্ড। দেহ ও মনে হতে থাকবে জটিলতার বিস্তার।


বৈজ্ঞানিকভাবে যাকে বলে সারকেডিয়ান রিদম, তা মূলত গঠিত হয় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার সুপারকিয়াসমেটিক নিউরন নিয়ে। দিন-রাতে সমস্ত শরীরে যেসব সিগন্যাল বা নির্দেশাবলির আদান-প্রদান চলতে থাকে, এখান থেকেই তা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি মূলত দেহের মহাঘড়ি। শরীরে রয়েছে ছোট ছোট আরো বহু ঘড়ি। প্রতিটি অঙ্গ এবং কোষের রয়েছে নিজস্ব ঘড়ি। সবগুলো ঘড়িকে একই তাল ও লয়ে সমন্বিত রাখার কাজটি করে হাইপোথ্যালামাসে থাকা সেই মহাঘড়ি। কোষ-ঘড়ির একটার সাথে আরেকটা তাল ও লয়ে সমন্বয় না থাকলে দেখা দেবে বিপদ!

এ ঘড়ি দেহময় জারি রাখে এক অদৃশ্য ছন্দ, শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া। সপ্রাণ জীব মাত্রই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত, দেহঘড়ির বাহক। যেখানে জীবন আছে, সেখানে আছে দেহঘড়ি। প্রাণীর গঠন ও আকার যাই হোক- যদি সে সূর্য থেকে নিজের শক্তি সংগ্রহ করে, তাহলে তার দেহঘড়ি থাকবেই। আলো ও অন্ধকারের সূত্র মেনে এই ঘড়ি কাজ করবে। সূর্যঘড়ি অনুসরণ না করেও একটি প্রাণী দেহঘড়ির নির্দেশে কাজ করতে পারে। লজ্জাবতী পাতা অন্ধকারেও নিজেকে গুটিয়ে নেয় এবং মেলে ধরে দেহঘড়ির নিয়মেই।

প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দেহঘড়ি একবার চক্র পূরণ করে এবং জীবিত বস্তুর অস্তিত্বকে এক অদৃশ্য ছন্দে বেঁধে দেয়। কিন্তু দেহঘড়ির এই চলমানতা কিভাবে নিশ্চিত হয়? কোথায় তার মূল শক্তি? তার চলমানতার সাথে সম্পর্ক হরমোন-সংশ্লিষ্ট একটি প্রক্রিয়ার। জৈবিক চক্রের সাথে জড়িত এই হরমোনের নাম মেলাটোনিন। যখন আলো, তখন কমে যায় মেলাটোনিনের নিঃসরণ। যখন অন্ধকার, তখন বেড়ে যায় তার নিঃসরণের মাত্রা। হরমোনটির নিঃসরণ ঘটায় মস্তিষ্কের কেন্দ্রে অবস্থিত পিনিয়াল গ্রন্থি। এ নিঃসরণ নির্ভর করে আলো-অন্ধকারের উপস্থিতির ওপর। পিনিয়াল গ্রন্থি আলো-আঁধারের এই অনুভূতি টের পায় ঠিক সেখান থেকে, যেখান থেকে মস্তিষ্কে যায় দেখার অনুভূতি। মানুষের চোখের ভেতর একধরনের সেন্সর রয়েছে। যেগুলো আলো শনাক্ত করে এবং মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় অংশে সঙ্কেত পাঠায়। চক্ষুগোলকের একেবারে ভেতরের আবরণ রেটিনায় আছে এমন কিছু স্নায়ুকোষ, যা দেখার অনুভ‚তি জাগানোর বদলে সোজা চলে যায় সার্কাডিয়ান রিদমের প্রাণকেন্দ্র সুপারকিয়াসমেটিক নিউক্লিয়াসে। সেখান থেকে আলো-আঁধারের সঙ্কেত চলে যায় পিনিয়াল গ্রন্থিতে। অন্ধকারের সঙ্কেত এলে গ্রন্থিতে মেলাটোনিন নিঃসরণের পরিমাণ ১০ গুণ বেড়ে যায়, হরমোনটি ঘুমের আনুক‚ল্য নিশ্চিত করে। আলোতে মেলাটোনিনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে জাগরণের অনুকূলে কাজ করে দেহ।

মেলাটোনিনের এই যে নিঃসরণ, তা আলো-আঁধারের সাথে সাথে বাড়ে-কমে। মেলাটোনিনের এই চক্রাকার পরিবর্তন দেহের অন্যান্য দেহকলার নিজস্ব সময়জ্ঞানেও প্রভাব ফেলে। দেহকলার নিজস্ব রুটিন দেহের বিভিন্ন অঙ্গের নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করে।

সকালে আপনার দরকার সারা দিনের পরিশ্রমের জন্য শরীরের প্রস্তুতি। দেহঘড়ি সেটি নিশ্চিত করে। সকাল ৬টায় স্ট্রেস বা উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা তৈরির হরমোন কর্টিসলের প্রবাহ ঘটে। ৬টা থেকে ৬টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে দেহের রক্ত সঞ্চালন সবচেয়ে দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হয়ে থাকে। যা সারা দিনের পরিশ্রমের সক্ষমতাকে আমন্ত্রণ করে। সকাল সাড়ে ৭টায় বন্ধ হয়ে যায় মেলাটোনিন গ্রন্থের নিঃসরণ, এতে ধীরে ধীরে কমে যায় ঘুমের আবেশ।

সকাল সাড়ে ৮টায় মানুষের কার্যক্ষমতা নির্ধারণকারী নিউরনগুলো প্রস্তুত হতে থাকে দিনের ধকল সামলানোর জন্য। সকাল ৯টার দিকে রক্তচাপ বাড়ে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে, মস্তিষ্কে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিঃসৃত হয় মানবদেহের কর্মোদ্যম নির্ধারক হরমোন- টেস্টোস্টেরন। কর্মসচেতন থাকার জন্য তার সাহায্যের বিকল্প নেই। তার অনুপস্থিতি কাজের প্রতি উদ্দীপনা হারানোকে অবধারিত করে।

সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে মানবদেহে সারা দিনের সর্বোচ্চমাত্রায় কর্মোদ্দীপনা কাজ করে। শরীরে কাজের উদ্যমের যেসব টিস্যু, তারা তখন থাকে অধিক মাত্রায় সক্রিয়। ফলে এ সময়ে যেকোনো কাজ খুব সহজে পূর্ণ মনযোগ দিয়ে সম্পাদন করা সম্ভব।
দুপুর ১২টা থেকে কমতে থাকে মস্তিষ্কে টেস্টোস্টেরন নিঃসরণের মাত্রা। দুপুর ১২টার আগে মস্তিষ্ক সজাগ থাকে সবচেয়ে বেশি, ১২টার পর সমন্বয়ের কাজ হয় সবচেয়ে ভালো।

বেলা ১টায় পাকস্থলী মস্তিষ্কের কাছে জানায় খাদ্যের দাবি। সেখানে বিদ্যমান নিউরন সেই সঙ্কেত লাভ করে। আপনাকে কর্মসক্ষম থাকতে হবে। সে জন্য শরীরে দরকার প্রচুর জ্বালানি। এবার খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। নতুবা টেস্টোস্টেরনের প্রবাহ খুব সঙ্কোচিত হয়ে যাবে, শরীর হবে দুর্বল, মেজাজ যাবে বিগড়ে। খাদ্য গ্রহণের পর বেলা ৩টার আগ অবধি মস্তিষ্কে নিসৃত টেস্টোস্টেরনের মাত্রা মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় বিরাজমান থাকে। সার্কিডিয়ান রিদমের পার্থক্যের কারণে খাবারের পরে কাউকে পেয়ে বসে তন্দ্রা। এ সময়ে ঘুমিয়ে নিতে পারেন। এ ঘুম মস্তিষ্ক এবং শরীরকে দেবে উপাদেয় বিশ্রাম, আপনাকে করবে আরো উদ্যমী, সতেজ! বেলা ৩টার পরে শরীর থাকে খুব তৎপর, যেকোনো কাজে সাড়া দেয় দ্রুত। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত শরীরের তাপমাত্রাও থাকে সবচেয়ে বেশি।

বিকেল ৫টায় ভারসাম্য আসে শরীরে। কণ্ঠের মাংসপেশি এবং মস্তিষ্কের নিউরনগুলো অধিকতর স্বাভাবিক থাকে। এ ভারসাম্য হৃৎপিণ্ডের কাজে দেয় সুষম সমন্বয়, শ্বাস-প্রশ্বাস করে নিয়ন্ত্রিত। কণ্ঠস্বর এ সময়ে অধিকতর সুরেলা শোনাবে। বিকেলে যে উদাস হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনি গান করেন কিংবা ছাদে দাঁড়িয়ে মনের অজান্তেই উচ্চারণ করেন প্রিয় কোনো সুর, এর পেছনে কাজ করে দেহঘড়ির প্রভাব।

সন্ধ্যা ৬টা। সারা দিনের কাজ শেষে ক্লান্ত নিউরনগুলোতে নেমে আসে স্থিতাবস্থা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে দেহের রক্তসঞ্চালন সর্বোচ্চ মাত্রায় থাকে, যা আপনাকে নতুন করে কর্মসচেতন করে তোলে। সন্ধ্যা ৭টায় দেহের তাপমাত্রা দিনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করে। সারা দিনের কর্মতৎপরতা শেষে আপনার দেহকে পুনরায় সজীব করার শেষ প্রক্রিয়া এটি। বস্তুত সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টার ভেতর রক্তচাপ বাড়ে সবচেয়ে বেশি।

রাত ৯টার দিকে শুরু হয় রাত পছন্দকারী আলোক সংবেদনশীল হরমোন মেলাটোনিনের নিঃসরণ। এ সময় মস্তিষ্কের নিউরনগুলো নিজেদের কাজের ধরন যেহেতু বদলায়, ফলে দেহে লাগে হালকা ধাক্কা। যেন ঘুম আপনাকে ছুঁয়ে যায় গোপনে, নিবিড়ে। এরপর জেগে থাকতে পারবেন আরো কয়েক ঘণ্টা। যখন রাত সাড়ে ১১টা, নিউরনগুলো তখন মস্তিষ্কে সঙ্কেত পাঠাতে থাকে, আমি আর পারছি না, এবার ঘুমাতে হবে। রাত যখন ১২টা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে দৈহিক ক্রিয়া শাটডাউন করে। দেহের কোষ কিংবা মস্তিষ্কের নিউরনগুলো সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে থাকে তখন। সময়টি জেগে থাকার নয় মোটেও। রাত ২টার দিকে ঘুমের মাত্রা সবচেয়ে গভীর হয়ে থাকে। আবার কেউ মস্তিষ্কের বিপরীতে জোর করে কোনো কাজ করতে গেলে সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। কারণ তখন ক্ষয়ে যাওয়া কোষগুলো পুনরায় গঠিত হচ্ছে।

ভোর ৪টায় দেহের তাপমাত্রা সর্বনিম্নে নেমে আসে। সকাল ৬টা থেকে আবারো ঘড়ি শুরু করে তার কাজ। এভাবেই চলে, চলতে থাকে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেহঘড়ির এ শৃঙ্খলায় ব্যতিক্রম থাকলেও বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এ সার্কিডিয়ান রিদম পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

এই ছন্দকে অবজ্ঞা করলে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতাকেই অবজ্ঞা করলেন। অনেকসময় শরীরে কাজ করে অস্বস্তি। এক দিকে ঝিমুনি-ঝিমুনি লাগে, অন্য দিকে ঘুমও ঠিক আসে না। কী হয়েছে আসলে? সম্ভবত শরীরের ভেতরে থাকা মহাঘড়িটির ছন্দের সাথে শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন পাকস্থলী, মস্তিষ্ক বা এ রকম অন্য অঙ্গগুলোর ছন্দের সমন্বয় হচ্ছে না। যার ফলাফল শরীরের এই অসহযোগিতা। শরীর যখন আরো বড় রকমের অসহযোগিতা করছে, তখন খেয়াল রাখতে হবে- দেহঘড়ির নিয়মে ব্যত্যয় হয়েছে কোথাও!

ধরা যাক ঘুমের কথা। যারা রাতজাগার কাজ করেন বা রাতে অনিদ্রা রোগে ভোগেন, তারা জেটলেগের কবলে পড়েন। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃৎপিণ্ডের অসুখ, স্থূলতা আর বিষন্নতায় ভুগতে হয় এদেরই বেশি। যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিফটে কাজ করেন, তাদের দেহঘড়িটি অনেক সময় এলোমেলো হয়ে যায়। এই দশাটিকে বলা হয় ‘সোস্যাল জেটলেগ’ বা সামাজিক পরিস্থিতির কারণে তৈরি হওয়া দৈহিক বিড়ম্বনা।

এই বিড়ম্বনা আমাদের শুধু বিপদে ফেলে না, অনেক কিছু শেখায়ও। প্রকৃতি আমাদের দেহে যে স্বয়ংক্রিয় শৃঙ্খলা প্রতিস্থাপন করেছে এবং যার ওপর আমাদের চালিত করছে, তার মধ্যেই নিহিত আমাদের সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা। দেহ ব্যবস্থাপনায় প্রাকৃতিক ছন্দের সত্য যেভাবে বিদ্যমান, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রাকৃতিক আইন ও সহজাত সত্যগুলোর সুরক্ষায় রয়েছে স্বাভাবিকতা। একে যখনই এবং যেখানেই প্রত্যাখ্যান করা হবে, সেখানেই তৈরি হবে বৃহত্তর জেটলেগ, যা ডেকে আনবে দেহের ক্যান্সার, হৃৎপিণ্ডের পচন!

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]

পঠিত : ৮১৬ বার

মন্তব্য: ০