Alapon

ইখওয়ান-জামায়াতের পথের দর্শন : সীমাবদ্ধতা কিংবা বিশিষ্টতা



ইসলামপন্থি রাজনীতিতে বর্তমান প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার পন্থা কী হবে, সেটা নিয়ে বেশ আলাপ আছে, জোরালো মতদ্বৈততা আছে।

আলাপ বা মতদ্বৈততার কারণ হলো— প্রতিপক্ষের পরিচয়। রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কেরামের সময় প্রতিপক্ষ ছিল কাফিররা। সুতরাং, তাদের আঘাতের বিপরীতে আঘাত, জীবনের বিনিময়ে জীবন ছিল দ্বিধাহীন বিষয়। এমনকি এই দ্বিধাহীনতা এত স্পষ্ট ছিল যে, তারা পিতার বিপরীতে পুত্র কিংবা পুত্রের বিপরীতে পিতাও দাঁড়িয়ে গেছেন কোনো অজুহাত ছাড়াই।

এই বিষয়ে বর্তমানেও ইসলামপন্থিদের মধ্যে তাই কোনো দ্বিধা নেই। কা-শ্মীরের আজাদি, আফ-গানিদের প্রতিরোধ বা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের ন্যায্যতা নিয়ে কোনো ধারার ইসলামপন্থিদের মধ্যে হীনম্মন্যতা, দ্বিধা কিংবা মতদ্বৈততা দেখা যায় না বললেই চলে; অথবা থাকলেও সেটা খুবই গৌণ।

সংকটটা আসলে সেসব প্রতিপক্ষের বিষয়ে অবস্থান নিয়ে, যাদের পরিচয় মুসলিম বটে, কিন্তু তারা ফাসিক, জালিম ও দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পথে অন্তরায়।

এই ইস্যুতেই বিভিন্ন ধারা-উপধারায় চিন্তার বাঁক পরিবর্তন দেখা যায়।


১. এই কায়েমি ব্যবস্থার ধারকবাহকদের প্রত্যক্ষ অথবা প্রচ্ছন্নভাবে তাকফির জ্ঞান করে, সমাজকে জাহেলি সমাজ ধরে নিয়ে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম ও শক্তির প্রয়োগবাদী ধারা।

২. এই কায়েমি ব্যবস্থাকে উপদেশ দিতে থাকা এবং যথাসম্ভব ঝামেলা এড়িয়ে দাওয়াত, তারবিয়াত, সামাজিক কাজ, ইলম চর্চা চালিয়ে যাওয়া।

৩. এই কায়েমি ব্যবস্থার সহায়ক হয়ে যথাসম্ভব নিজের ও দ্বীনের সেবা করা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের সেবাই এই শ্রেণির কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে যুগে যুগে।

৪. এই কায়েমি ব্যবস্থা পরিবর্তনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। তবে এর ধারকদের ইসলামের শত্রু জ্ঞান করলেও তাকফির না করা। আর কায়েমি ব্যবস্থার অপ্রতিবাদী নীরব জনগোষ্ঠীকে তাকফিরের তো কোনো সুযোগই নেই; সুতরাং এই সমাজ জাহেলি সমাজ নয়; বরং কিছু ক্ষেত্রে বিকৃত সমাজ আবার কিছু ক্ষেত্রে মজলুম সমাজ। সুতরাং এমন অবস্থার বিপরীতে না নীরব থাকা যায়, আর না কেবল উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত থাকা যায়, আর না সর্বাত্মক পরিবর্তন না হওয়া অবধি যতটুকু পরিবর্তনের সুযোগ আছে, সেসব ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকা যায়।


এই শেষোক্ত ধারাটিই ইখওয়ান-জামায়াতের কর্মপদ্ধতি। ইখওয়ান-জামায়াতের কর্মপদ্ধতিকে এক্ষেত্রে এভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে :


*এই আন্দোলন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজকে জাহেলি সমাজ মনে করে না; বরং যে মুসলিম সমাজে ইসলাম পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত নেই তাকে তারা বিকৃত সমাজ মনে করে। এবং এর মোকাবিলা নয়; বরং সংস্কার-সংশোধন করতে চায়।


*মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ ও রাষ্ট্রে এ ধারা কখনোই সশস্ত্রতাকে অনুমোদন করে না। কেননা, এর মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধারণ করা হবে, মুসলিমদের জীবন বিপর্যস্ত হবে, নিরাপরাধ মানুষের জানমাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, গৃহযুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে, এক ক্ষতিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে আরও বড়ো ক্ষতির সৃষ্টি হবে।


*এই সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত কায়েমি ব্যবস্থার বিপরীতে কেবল উপদেশ ও দাওয়াতকেই তারা যথেষ্ট মনে করে না; বরং সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতে চায়। এবং এর সর্বাত্মক পরিবর্তন যতক্ষণ সম্ভব না হবে, ততক্ষণ যথাসম্ভব পরিবর্তনের কাজ অব্যাহত রাখতে চায়।


ইখওয়ান-জামায়াত ধারার একটি মৌলিক সংকট-সীমাবদ্ধতা কিংবা ভিন্নভাবে বললে বিশিষ্টতা এখানেই। তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিকৃত সমাজে নীরব ও নিষ্ক্রিয়ও থাকতে পারে না; আবার সর্বাত্মক শক্তির প্রয়োগও ঘটাতে পারে না। তারা সংস্কার করার চেষ্টা করে, জোরালো প্রতিবাদ করে, বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধও করে, কিন্তু জীবনমরণ চূড়ান্ত প্রতিরোধ করতে পারে না। মার খেয়ে যায়; কিন্তু চূড়ান্ত মার দেওয়া থেকে দর্শনগত কারণেই তাদের হাত গুটাতে হয়।


এই দর্শনগত সংকটের আবর্ত কিংবা বিশিষ্টতার ভিত্তি এই ধারায় দুটি চিন্তাগত ভাঙন এ পর্যন্ত হয়েছে। অবশ্য বলতে গেলে তিনটি হয়েছে। আমাদের আলোচ্য ধারাগুলোর প্রথমটিও এই মৌলিক প্রশ্নকে ডিল করতে গিয়ে আলাদা পথ খুঁজে ফিরেছে, যা কিছুটা সাইয়িদ কুতুব শহিদের চিন্তাকে ধারণ করে; যদিও পুরোপুরি নয়।


যাহোক, এখানকার আলোচ্য ভাঙনের প্রথমটি হলো ডা. ইসরার আহমাদ ও মাওলানা আবদুর রহীম রহ.-এর মাধ্যমে। এই দুই মনীষীর দ্বিমতের মূল পয়েন্ট হলো— প্রচলিত ব্যবস্থায় কোনো রকম অংশগ্রহণ না করে দাওয়াত-তারবিয়াতের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় ও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। আর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি হয়ে যাওয়ার পর অহিংস গণঅভ্যুত্থান করা। এই হলো তাদের চিন্তাধারার সারমর্ম। অনেকে তাদেরকে স্বশস্ত্র ধারার সাথে একমত পোষণ করেছেন বললেও মূলত সেটা তাদের চিন্তাধারা সম্পর্কে ভুল অনুধাবন ও প্রচারণা।


আরেকটি অংশ জামায়াত-ইখওয়ান ধারার সাথে সম্প্রতি দ্বিমত পোষণ করেছে। তাদের বক্তব্য প্রকাশ্য অথবা অনেক ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্নভাবে এই যে, বর্তমানে ইসলামি আন্দোলন, ইসলামি রাষ্ট্র ইত্যাদির প্রয়োগের পরিবেশ বা সময় নয় বা প্রাসঙ্গিক নয়। এখন প্রয়োজন এমন অবস্থান গড়ে তোলা, যেখানে সবাই কাজ করার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ, এটা হবে ধর্মীয় ইস্যুতে যেভাবে সেক্যুলার রাষ্ট্র হয়েছে, তেমনি চিন্তাধারা বা মতাদর্শিক ক্ষেত্রে সেক্যুলার দল গড়ে তোলা, যাদের লক্ষ্য হবে— ধর্মীয়ভাবে তো বটেই মতাদর্শিকভাবেও রাষ্ট্র ও সমাজকে সেক্যুলার করে গড়ে তোলা।


মূলত এই দীর্ঘ লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, কোন ধারাটি যথার্থ বা কোনটি সফল-অসফল কিংবা সঠিক-বেঠিক তার আলাপ তোলা। বরং এই দীর্ঘ অবতরণিকার মূল আলাপটা খুবই ছোট্ট। আর সেটা হলো—


আপনি যদি ইখওয়ান-জামায়াত ধারায় সম্পৃক্ত থাকেন, তাহলে আপনার বোঝা উচিত— রাজপথে আপনি মজলুম হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই নেমেছেন। কারণ, আপনি কারও বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান গ্রহণের বিপরীতে ভিন্ন এক পথের পথিক। সুতরাং এ পথে আসার পর, আপনি যদি প্রশ্ন তোলেন, আপনি কেন বেসামরিক অবস্থায় সামরিকদের মুখোমুখি, তাহলে আপনার প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা নেই। কারণ, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষেত্রে এ পথকে বেছে নিয়েছেন সশস্ত্রতাকে পরিত্যাগ করেই। সুতরাং, আপনি আপনার দর্শনগত কারণেই নিষ্ক্রিয় থেকে রাজপথ পরিত্যাগ করতে পারবেন না; আবার দর্শনগত কারণেই সশস্ত্র হতে পারবেন না। তাহলে? মজলুম হওয়াই আপনার নিয়তি। আপনি এমন এক জাতির জিম্মাদার ও দরদি, যারা আপনাকে রক্তাক্ত করে। আপনার পরিচয় হলো— সক্রিয় ও মজলুম। আপনি সক্রিয় থাকবেন এবং আপনি মজলুম হবেন— এটাই আপনার পথ। সক্রিয়তার ঘাম আর মাজলুমানের রক্তের সেচ দিয়েই আপনি বাগান সাজাতে নেমেছেন।


হ্যাঁ! প্রশ্ন হতে পারে— আপনার ঘাম ও রক্তের সেচে বাগানটি আরও বেশি সজীব, সবুজ ও সুশোভিত হতে পারত কি-না?

~মুহাম্মাদ আবু সুফিয়ান

পঠিত : ৫৬৯ বার

মন্তব্য: ০