Alapon

ভারতবর্ষে ইসলাম: হিন্দু ঐতিহাসিকের চোখে...



আর্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ভারতবর্ষে বসবাসকারী বিভিন্ন অনার্য ধর্মাবলম্বীদের প্রথম পরিচয় শুধু ধ্বংস ও সংঘাতের মাধ্যমেই হয়েছিল মনে হয়। ইসলাম ধর্মের উদ্ভব হওয়ার অনেক আগে থেকেই ইরানি, আরব্য, তুর্কি প্রভৃতি মধ্য ও পশ্চিম প্রাচ্যের অধিবাসীদের সঙ্গে ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এবং ভারতবর্ষে মুসলিমদের সশস্ত্র অভিযানগুলাে শুরু হওয়ার আগেইইসলাম ধর্মাবলম্বী বণিকরা ভারতবর্ষের কোনাে কোনাে স্থানে, বিশেষত কেরলে একটা নিজস্ব সমাজ গড়ে তুলেছিল। যেমন মুসলিম সৈনিকদের অভিযান শুরুর আগেই মুসলিম বণিকদের আসা-যাওয়া শুরু হয় তেমনই উত্তর ভারতে মুসলিমদের প্রথম অনুপ্রবেশ নিরস্ত্র ও প্রেমিক সুফি সাধুসন্তদের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায়। সে ইতিহাস বিশদভাবে যথাস্থানে আলােচিত হবে।

স্থানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংস সাধনের ব্যাপারে পরবর্তীকালে সৈনিকের বেশে আগত বিদেশি মুসলিমরা মােটামুটিভাবে বৈদিক আর্যদের পদাঙ্কই অনুসরণ করে। তবে অনার্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য আর্যরা যতখানি সাফল্য দাবি করতে পারে মুসলিম যােদ্ধারা ততখানি সাফল্য দাবি করতে পারে না। তার কারণ বােধহয় এই যে, বৈদিক আর্যরা যতখানি একাগ্রতা ও উগ্রতার সঙ্গে অনার্যদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়েছিল মুসলিমরা ততখানি একাগ্রতা ও উগ্রতার সঙ্গে আর্য সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়নি, তারা অনেকখানি পরসংস্কৃতি-সহিষ্ণু ছিল ।

এটা একটা প্রচলিত ধারণা যে, এক হাতে কোরান, অন্য হাতে কৃপাণ নিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার করা হয়েছে। এই ধারণাটা কতখানি সত্য তার বিচার একেবারে নতুন করে করা বিশেষ প্রয়ােজন । এখানে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মুসলিম রাজনৈতিক শক্তির প্রধান কেন্দ্র ছিল দিল্লি-আগ্রা অঞ্চল, কিন্তু উল্লিখিত বড় শহরগুলাে বাদ দিলে ওইসব কেন্দ্রের সংলগ্ন অঞ্চলগুলােতে মুসলিমদের সংখ্যার চেয়ে কেন্দ্রের থেকে বহু দূরবর্তী অঞ্চলগুলােতে যেমন সিন্ধুতে, কেরলে, বাংলায় মুসলিমদের সংখ্যা সর্বদা গরিষ্ঠ আকার লাভ না করলেও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে নিয়ে গঠিত সমগ্র জনসংখ্যার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ আকার লাভ করেছে। মুসলিম শক্তির মূল কেন্দ্র থেকে বহুদূরে অবস্থিত ওইসব অঞ্চল ইসলামের ব্যাপক প্রচার কী করে এবং কেন হলাে?

এ প্রশ্নের সদুত্তর একহাতে কোরান, অন্য হাতে কৃপাণের তত্ত্বের সাহায্যে দেয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে ওই তত্ত্বের উদ্গাতা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ঐতিহাসিকরা নন, তারাই তত্ত্বটির উদ্গাতা যারা হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদে লাভবান হয়েছে সবচেয়ে বেশি। পূর্বোক্ত ভারতের ভবিষ্যৎ বিষয়ক বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, মুসলমানের ভারতাধিকার দরিদ্র পদদলিতদের উদ্ধারের কারণ হইয়াছিল। এই জন্যই আমাদের এক-পঞ্চমাংশ ভারতবাসী মুসলমান হইয়া গিয়াছিল। তবে এক হাতে শাস্ত্র, অন্য হাতে অস্ত্র নিয়ে ধর্ম প্রচার কাকে বলে তা জানতে হলে ধর্মীয়তার কঠোরতম সমালােচক ও স্বাধীন চিন্তার পরিপােষক ইউরােপীদের অন্তরঙ্গ ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করা দরকার।

একটা ব্যাপার প্রথমেই চোখে পড়া উচিত ইসলাম ধর্ম ভারতবর্ষে প্রচারের আগে ভারতীয়দের যেমন কতকগুলাে নিজস্ব ধর্মমত ছিল যেগুলােকে ইসলামের আগমনের পরে সম্মিলিতভাবে হিন্দু ধর্ম বলা হয়, তেমনই ইউরােপে, খ্রিষ্টধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার আগে কতকগুলাে নিজস্ব ইউরােপীয় ধর্মমত ছিল এবং সেগুলােকে সম্মিলিতভাবে পেগান ধর্ম বলা হতাে। দীর্ঘকাল মুসলিম শাসনের অধীনে থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের অধিকাংশ অধিবাসী, এমনকি মুসলিম শক্তির প্রধান কেন্দ্রগুলাের অধিবাসীও হিন্দুই থেকে যায়, কিন্তু ইউরােপে পেগান ধর্মের বিরুদ্ধে এমন সর্বব্যাপী অভিযান চালানাে হয় যে পেগান ধর্মাবলম্বী ইউরােপীয়দের চিহ্নমাত্র রাখা হয়নি । মুসলমানরা যদি সত্যিই এক হাতে অস্ত্র নিয়ে ধর্ম প্রচারের অভিযানে নামতাে, তাহলে ইউরােপের মতাে ভারতবর্ষেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চিহ্নমাত্র থাকত না। তাই পূর্বোক্ত বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেন, কেবল তরবারি ও বন্দুকের বলে ইহা সাধিত হইয়াছিল, একথা মনে করা নিতান্ত পাগলামি মাত্র।

ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ও তার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে ইউরােপের ইতিহাসে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ অবান্তর মনে হতে পারে । কিন্তু যারা মনে করে যে, এক হাতে শাস্ত্র, এক হাতে অস্ত্র নিয়ে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করা হয়েছে। তারা ইউরােপের ও আমেরিকার ইতিহাসে ওইভাবে ধর্ম প্রচারের প্রকৃত তাৎপর্য দেখতে পাবে এবং সেই তাৎপর্যের আলােতে বুঝতে পারবে যে এক হাতে কোরান, অন্য হাতে কৃপাণের তত্ত্ব ভারতবর্ষের ইতিহাসে কোনােমতেই প্রযােজ্য নয় । প্রযােজ্য হতাে, যদি ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বৈদিক আর্যদের আগ্রাসনের পরে সাযুজ্য সন্ধানের পন্থা অনুসরণ না করে ইউরােপীয় খ্রিষ্টানদের মতাে অসহিষ্ণুভাবে ধর্ম প্রচারের পন্থা গ্রহণ করত এবং সমরাস্ত্রের শক্তিতে ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষকে এইধর্মশাস্ত্রের অধীনে আনত । হিন্দুদের ভাগ্য ভালাে যে, অস্ত্রধারী খ্রিষ্টানদের আগে অস্ত্রধারী মুসলিমরা এসেছিল ভারতে এবং পরধর্মসহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত স্থাপনকরেছিল ।

ইসলামের আগমনের আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, শৈব ধর্ম, শাক্ত ধর্ম প্রভৃতি বহুরকম ধর্ম ছিল; কিন্তু হিন্দুধর্ম বলে কোনাে বিশেষ ধর্ম ছিল না; হিন্দু, হিন্দোয়াই, হিন্দুস্তান প্রভৃতি সমস্ত শব্দই ছিল ভৌগােলিক অর্থদ্যোতক। পাঞ্জাবের অন্তর্গত শির-ই-হিন্দ বা শিরিন্দ ছিল এই ভৌগােলিক সংজ্ঞার সর্বোচ্চ সীমা এবং শির-ই-হিন্দের নিচে যে ভূভাগ ছিল তা-ই ছিল হিন্দু বা হিন্দুস্তান । কিন্তু ইসলাম নামে একটা সুনির্দিষ্ট শাস্ত্রবিহিত সুসংগঠিত সুসংহত ধর্মমত যখন বাইরের দেশ থেকে হিন্দে প্রবেশ করতে থাকে, তখন তার থেকে স্থানীয় বা দেশজ ধর্মমতগুলােকে সুস্পষ্টরূপে পৃথক করার জন্য হিন্দে প্রচলিত সমস্ত বিস্রস্ত ধর্মগুলােকে হিন্দু ধর্মের আধারে ধারণ করা হয়। একদা যেমন বিদেশিরাই এ দেশের নামকরণ করেছিল হিন্দু বলে, তেমনই সম্ভবত এবারে বিদেশি ধর্মাবলম্বীরাই দেশজ ধর্মগুলাের সম্মিলিত রূপের নাম দিয়েছিল হিন্দু ধর্ম । তবে বিদেশাগত ধর্মের সংস্পর্শে দেশজ ধর্মগুলাে নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে একই নাম অবলম্বনে ঐক্যবদ্ধ সংগঠিত সংহত হয়ে থাকতেও পারে।

রাজনীতির ক্ষেত্রে এরকম ঐক্য ও সংহতি সাধনের দৃষ্টান্ত চোখের সামনেই আছে—উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দু-তিন দশক পর্যন্ত ভারতবর্ষে গুজরাতি ছিল, বাঙালি ছিল, পাঞ্জাবি ছিল, তেলুগু ছিল, মহারাষ্ট্রীয় ছিল, তমিল ছিল, ওড়িয়া ছিল, কিন্তু ভারতীয় বলে আলাদা বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনাে জাতি ছিল না। বিদেশি রাজনৈতিক শাসনের ও অর্থনৈতিক পেষণের প্রতিক্রিয়াতেই ভারতীয় জাতি’ অথবা ভারতীয় জাতির কল্পনা’ জন্মলাভ করে। বিদেশি রাজনৈতিক শক্তির আগে যখন বিদেশি ধর্মীয় শক্তির প্রচার ও প্রসার শুরু হয়, তখন তার প্রতিক্রিয়াতে ‘হিন্দুধর্মের অথবা ‘হিন্দুধর্মীয় বােধের কল্পনা’র উদ্ভব। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের কল্পনাকে জন্ম দেয়াই এ দেশে ইসলামের প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ।

পঠিত : ৯৬৭ বার

মন্তব্য: ০