Alapon

ঈমান রক্ষার আন্দোলন এবং কিছু কথা...



ভারতীয় মুসলমানের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো ধর্মান্তরিত মুসলিম। ইসলামের সৌন্দর্য (জাতভেদ নেই) বা মুসলিমদের আখলাক দেখে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে। হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার অর্থ ছিলো- পূর্বের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ছেড়ে এক নতুন সংস্কৃতি, নতুন ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরা। যাকে বলা হয়- Cultural Migration বা সাংস্কৃতিক হিজরত।

ধর্মান্তরিত মুসলিমের জীবনাচার বদলে যায়। আগে তারা এমন কিছু পরিহার করতো, যা এখন গ্রহণ করেছে। আবার, আগে তারা এমন কিছু গ্রহণ করতো, যা এখন পরিহার করেছে। যেমন: গরু খাওয়া, পুরুষরা স্বর্ণ পরিধান, মূর্তিপূজা ইত্যাদি। একটি ধর্ম গ্রহণ করা মানে আগের অনেক কিছু বাদ দেয়া, নতুন অনেককিছু গ্রহণ করা। আর ইসলাম শুধুমাত্র বিশ্বাসের নাম না, ইসলাম এক সংস্কৃতি। ধর্মান্তরিত মুসলিমরা তখন এক নতুন সাংস্কৃতিক পরিচয় ধারণ করে।

বিশ শতকের সূচনাতে ভারতের ধর্মান্তরিত মুসলিমরা এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। স্বাভাবিকভাবে, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা ইসলাম গ্রহণ করেই যে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে আলেম হয়ে যাবে, এমন না। তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো ঠিকই, কিন্তু জ্ঞানতাত্ত্বিক তৃষ্ণা নিবারণের তেমন সুযোগ ছিলো না। নিজেদের অজ্ঞতার কথা কাকে গিয়ে বলবে? কে তাদেরকে কাছে টেনে নিয়ে শেখাবে?

তারউপর ভারতীয় মুসলিমরা রাজনৈতিক ক্লান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিচয় আদায়ে একদিকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে ব্রিটিশদের সাথে, অন্যদিকে কংগ্রেসের সাথে মনোমালিন্য তো আছেই।

ঠিক সেই ক্লান্তিকালে ভারতীয় হিন্দুরা ধর্মান্তরিত মুসলিমদেরকে আবারো হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে নিতে সামাজিক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনটি পরিচিত ছিলো ‘শুদ্ধি ও সংগঠন’ নামে। তারা প্রাথমিকভাবে বেশ সফলও হয়। ভারতের মেওয়ার রাজপুত সম্প্রদায় থেকে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো, শুদ্ধি আন্দোলনকারীরা তাদেরকে বুঝিয়ে আবারো হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

অন্যদিকে, ভারতীয় মুসলিমদের আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিলো ইউরোপের খ্রিস্টান মিশনারী। মুন্সী মেহেরুল্লাহর (রাহিমাহুল্লাহ) জীবনী পড়লে আমরা জানতে পারি যে, উনিশ-বিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদেরকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে কিভাবে উৎসাহ দেয়া হয়েছিলো, লোভ দেখানো হয়েছিলো।

এমনকি মিশনারীরা বিভিন্ন বিতর্কের আয়োজন করে, দরিদ্র মুসলিমদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দেবার মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের মেজ-বৌ চরিত্রের মাধ্যমে সেই সামাজিক অবস্থা ফুটে ওঠে।
একদিকে ধর্মান্তরিত মুসলিম তাদের ঈমান নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, অন্যদিকে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা মুসলিমরা শুদ্ধি আন্দোলন ও মিশনারীর প্রচারে সংশয়ে পড়ে যায়।

ভারতীয় মুসলিমের এমন সঙ্কটকালে প্রয়োজন ছিলো একটি সামাজিক প্রতিরক্ষা আন্দোলন; মুসলিমদের ঈমান রক্ষার আন্দোলন।

১৯০৮ সালে ভারতীয় মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা দারুল উলুম দেওবন্দে একজন ছাত্র ভর্তি হোন। ১৯২০ সালের দিকে তিনি ভারতীয় মুসলিমদের ঈমান রক্ষার জন্য একদল দারুল উলুম গ্র্যাজুয়েট ও সাহারানপুরের তরুণ আলেমদেরকে মেওয়াতে প্রেরণ করেন। শুদ্ধি আন্দোলনের প্রভাবে যেসব ধর্মান্তরিত মুসলিম হিন্দু ধর্মে ফিরে যায় তাদেরকে এবং সেখানকার ধর্মান্তরিত মুসলিমদেরকে ইসলাম, ঈমান শেখানোর জন্য এই আলেম-দল ছুটে যায়।

বেশ সফলতার সাথে তারা হিন্দু ধর্মে ফিরে যাওয়া ধর্মান্তরির কিছু মুসলিমকে ফিরিয়ে আনেন। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা মুসলিমরা নানামুখী প্রচারের ফলে ঈমান নিয়ে সংশয়ে। তাদের সাথে থেকে, তাদেরকে বুঝিয়ে তাদের ঈমান মজবুত করার দায়িত্ব নেন সেই আলেমগণ।

যিনি এই আন্দোলন শুরু করেন, দারুল উলুমের সেই আলেম তাঁর আন্দোলনের নাম দেন ‘ঈমান রক্ষার আন্দোলন’। এই আন্দোলনের স্লোগান ছিলো- ‘অ্যায় মুসলমান, মুসলমান বানো’ বা ‘হে মুসলমান, মুসলমান হও’।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সময়ে মদীনায় যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা বাকারা ২:২০৮]

শুদ্ধি আন্দোলন এবং মিশনারীদের খ্রিস্টধর্ম প্রচারের মুখে দাঁড়িয়ে ভারতের সেই আলেম এমন এক আন্দোলন শুরু করেন, যার ফলে ভারতের তৎকালীন মুসলমান ঈমান রক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

দলে-দলে মানুষ সেই আন্দোলনে যোগ দেয়, নিজেদের ঈমান পাকাপোক্ত করার ব্যাপারে সচেতন হয়। যারা মাদ্রাসায় গিয়ে আলেমদের সান্নিধ্যে যেতে ভয় পেতো, দ্বিধা কাজ করতো; তারা দেখতে পায় আলেমরা তাদের ঘরে নক করে বলছে, “আসেন ভাই, মসজিদে যাই।”

‘আলেম’ মানেই মাথার তাজ, সম্মানিত ব্যক্তি। ভারতীয় মুসলিমরা ভাবতেই পারে নি যে, এতো সম্মানিত মানুষরা তাদের ঘরে ঘরে এসে তাদেরকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করবে! আলেমদের ব্যবহারে মানুষ মুগ্ধ হলো। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো সেই আলেম আবির্ভুত হলেন ভারতীয় মুসলমানের ত্রাণকর্তা রূপে। খাদের কিনারায় থাকা ভারতীয় সাধারণ মুসলমান, ধর্মান্তরিত মুসলমানকে তিনি টেনে তুললেন। তাদেরকে শেখালেন ঈমান, নামাজ, আদব-আখলাক, ভ্রাতৃত্ব।

ভারতীয় মুসলমানের সেই কঠিন দুঃসময়ে যিনি হাল ধরেছিলেন, তিনি হলেন মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী (রাহিমাহুল্লাহ)। যে আন্দোলনের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ঈমান রক্ষার আন্দোলন’, আজ সারাবিশ্বে সেই আন্দোলন ‘তাবলীগ জামাত’ নামে পরিচিত।

- আরিফুল ইসলাম

পঠিত : ৯৪০ বার

মন্তব্য: ০