ইমাম বান্নার পাঠশালা
তারিখঃ ২৫ জুলাই, ২০২২, ২২:০৪
গত শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকদের প্রভাবে মুসলিমরা যখন ধীরে ধীরে নিজেদের আত্মপরিচয় বিস্মৃত হতে বসেছিলো, মুসলিম যুবকরা যখন আত্মবিশ্বাসহীনতায় আক্রান্ত হয়ে দ্বীন-শরিয়ত ছেড়ে ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন তত্ত্ব ও মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েতেছিলো, ঠিক সেই সময়েই মুসলমানদের ভেতর ঈমানের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করতে, আল্লাহর দ্বীনকে পুনরায় বিজয়ীর আসনে সমাসীন করতে যে কয়জন মহানায়ক দীপ্ত পদে এগিয়ে এসেছেন ও ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে মিশরের স্কুল শিক্ষক ইমাম বান্না রহিমাহুল্লাহ অন্যতম।
ইমাম বান্না মুসলমানদের জাগানোর জন্য অবিরত দাওয়াতি কাজ করে গিয়েছেন শুরুর দিকে। এক পর্যায়ে তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেওয়া মানুষদেরকে সংঘবদ্ধ করেছেন। গড়ে তুলেছেন জি-হা-দ ফি সাবিলিল্লাহর একটি কাফেলা। নাম তার ইখওয়ানুল মুসলিমীন।
এই ইখওয়ানের কর্মীদের ওপর চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে শত-সহস্র জুলুম নিষ্পেষণ।
এতো শত-সহস্র জুলুম নিষ্পেষণের মধ্যেও কীভাবে তাঁরা আজো টিকে আছে, কীভাবে আর কী জন্য তাঁরা শত প্রতিকূলতা মাড়িয়েও সমাজ-রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও মজবুত ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, কী এমন প্রশিক্ষণ পেয়েছে তাঁরা, যার কারণে জালিমের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শাহাদাতের ফাঁসির মালাকেও গলায় ধারণ করতে পেরেছে কিংবা করে যাচ্ছে—এই প্রশ্নটা আমাদের মনে উঁকি দেয় না? অবশ্যই দেয়।
ইমাম বান্না কীভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের কর্মীদেরকে পরিচালনা করতেন, ইখওয়ানের কর্মীদেরকে তিনি কোন পদ্ধতিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতেন, সংসার-সমাজ-রাষ্ট্র নিয়ে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করতেন কিংবা করাতেন; ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ইখওয়ানের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা ও আন্তর্জাতিক ইসলামি চিন্তাবিদ-আলিমে দ্বীন ডঃ ইউসুফ আল কারজাভী একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন "আত-তারবিয়্যাতুল ইসলামিয়্যাহ ও মাদরাসাতু হাসান আল বান্না" নামে।
বইটি প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে "ইমাম বান্নার পাঠশালা" নামে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির অনুবাদ করেছেন ঢাবির আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী জাকিয়া সুলতানা শিফা।
বইটিতে বড়ো একটি ভূমিকার পরে লেখক ব্যক্তিত্ব ও সমাজ বিনির্মাণে ইখওয়ানের তারবিয়াত পদ্ধতিকে পাঁচটি অধ্যায়ে বিন্যাস করেছেন।
ভূমিকাতে লেখক "নবপ্রজন্ম গঠনে ইখওয়ানের সফলতার কারণ" শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদ এনেছেন। এতে নবপ্রজন্ম গঠনে ইখওয়ানের সফলতার যে কারণগুলো উল্লেখ করেছেন পয়েন্ট আকারে, সেগুলো হচ্ছে-
১.তালিম-তারবিয়াতের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ
২. এই তালিম-তারবিয়াতের সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত লক্ষ্য নির্ধারণ
৩. ইসলামি জীবন গঠনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করার কারণে।
৪. আল্লাহভীরু নেতৃত্ব পাবার কারণে।
এই আল্লাহভীরু নেতৃত্ব বলতে শাইখ কারজাভী ইমাম বান্না রহিমাহুল্লাহকেই বুঝিয়েছেন। এখানে তিনি বান্নার নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন— "আল্লাহ তাঁকে অসামান্য ঈমানি শক্তি দান করেছেন। তিনি ছিলেন এমন নেতা, যাঁর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্তরে তিনি জায়গা করে নিতেন। এমনকি তাঁর অন্তর থেকে আশপাশের লোকদের অন্তরেও এই গুণ প্লাবিত হতো।"
এরপর কারজাভী বান্নার সম্পর্কে আরো বলেন, তিনি ছিলেন পিতার মতো, যাঁর থেকে অন্যরা নিজেদের অন্তরে অনুপ্রেরণা লাভ করে।"
৫. মুখলিস ও আমানতদার দক্ষ প্রশিক্ষক।
৬. যুগোপযোগী ও বিচিত্র উপকরণ।
এরপর তিনি মূল আলোচনায় যান। এবং পাঁচটি অধ্যায়ে সে আলোচনাগুলো সজ্জিত ও বিন্যস্ত করেন। সে অধ্যায়গুলো হচ্ছে-
১. রব্বানিয়াত :
- এই অধ্যায়ে ব্যক্তিগত আমল-আখলাক-ইবাদাত ও নিরেট আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরির বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেমন, জামায়াতের সহিত সালাত, জিকির, সুন্নাহভিত্তিক আমল ও বিদ'আত পরিহার, নফল আমল, আত্মসমালোচনার মতো বিষয়গুলো নিয়ে এসেছেন।
২-পূর্ণাঙ্গতা ও সার্বজনীতা :
-সবচেয়ে বেশি আলোচনা তিনি করেছেন এই অধ্যায়ে। এখানে ইলম চর্চা, যোগ্যতা অর্জন ও স্মার্ট পার্সোনালিটির অধিকারী হয়ে নেতৃত্ব দেবার মতো বিষয়াদি আলোচনা করেছেন । সাথে সাথে তিনি জি/হাদ, রাজনীতি তথা আজাদি আন্দোলন, একতা ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠার বিষয়াদি নিয়েও আলোচনা করেছেন। মানে সোজাকথায় ইখওয়ানের রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিটা কী, জিহা/দ ও রাজনীতিতে সেগুলোই আলোচনা করেছেন।
৩. ইতিবাচক দৃষ্টভঙ্গি ও গঠনমূলক কর্মতৎপরতা
৪. ভারসাম্য ও মধ্যপন্থা :
-লেখক এখানে তিনটি পয়েন্টে আলোচনা করেছেন। সেগুলো হচ্ছে-
ক) সমাজ গঠনে ভারসাম্য
খ) দেশপ্রেম ও জাতীয়তার বিষয়ে ভারসাম্য
গ) দাওয়াতি কাজে মানুষের শ্রেণিকরণে ভারসাম্য
বিশেষত তখন জাতীয়তাবাদ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মুসলিম বিশ্বে আছড়ে পড়তে লাগলো। ইমাম বান্না সেই জাতীয়তাবাদকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন, জনশক্তির মধ্যে এ বিষয়ে কী ধারণা আর দিক্ষা দিতেন সেটাই আলোচনায় এসেছে।
৫. ভাতৃত্ব ও একতা :
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠাকাঙ্ক্ষী কর্মীগণ এই বইটি পড়ে অজানতেই বলে ওঠবেন—
আমরা একআত্মা, এক প্রাণ।
আমাদের শহীদের চেহারার কোন ভিন্নতা নেই।
সর্বশেষ এমন একটা বই প্রকাশ করার জন্যে প্রচ্ছদ প্রকাশন - Prossod Prokashon-কে কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন । এমন সুন্দর আর ঝরঝরে অনুবাদের জন্যে অনুবাদিকাকেও অভিনন্দন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর যোগ্যতা বাড়িয়ে দিন। বিশেষত কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি প্রচ্ছদের শাহমুন নাকীব ফারাবী ভাইকে। উক্ত বইটাসহ এমন গুরুত্বপূর্ণ দারুণ বইগুলো উপহার প্রদান করার জন্যে। জাঝাকাল্লাহু খাইরান ইয়া আখি।
#বুক_রিভিউ
বই : ইমাম বান্নার পাঠশালা
লেখক : ড. ইউসুফ আল কারযাভী
অনুবাদিকা : জাকিয়া সুলতানা শিফা
প্রকাশনী : প্রচ্ছদ প্রকাশন
পৃষ্ঠা : ১৫৮
মুদ্রিত মূল্য : ২৭০
প্রকাশকাল : মে ২০২২ ( প্রথম প্রকাশ )
লেখক : রেদওয়ান রাওয়াহা
মন্তব্য: ০