Alapon

পদ্মাবতী বয়ানঃ ইতিহাস যখন সাহিত্যের উপাদান

১।


Sanjay Leela Bhansali র ছবি ‘Padmaavat’ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় তুমুল বিতর্ক দেখছি।(সিনেমাটি আমি দেখিনি, দেখার কোন ইচ্ছেও নেই।) এই বিতর্কের মুল কারন পদ্মাবতীর অস্তিত্ব। ইতিহাসকে সাহিত্যে নিয়ে আসার মুল আপদটাই এখানে। শিল্প ইতিহাসের বাতাবরণে এমন একটা মিথিকাল ডিসকোর্স তৈরি করে যা অনেক সময় ফ্যাক্টকে রিপ্লেস করে ফেলে। ফলে যা হবার তাই -- শিল্পের ছোঁয়ায় ইতিহাস হয়ে যায় পাতিহাঁস।


২।


বলিউডের ‘পদ্মাবতী’ মূলত দিল্লীর সুলতান ‘আলাউদ্দিন খিলজি’ এবং রাণী ‘পদ্মাবতী’র মধ্যকার প্রেম নিয়ে লোক-কাহিনী নির্ভর। আলাউদ্দিন খিলজির প্রয়াণের ২০০ বছর পর সুফি কবি জায়সী রচিত ‘পদুমাবৎ’ তৈরি একটা চরিত্র মাত্র এই ‘পদ্মাবতী’। আর এর ১০০ বছর পর রচিত আলাওল এর পদ্মাবতীও একই। সেই সময়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমির খসরু ‘পদ্মাবতীর’ উল্লেখ করেন নি। ষোল শতকের ইতিহাসবিদ ফারিশতা প্রভৃতি মুসলমান ঐতিহাসিকদের কেউই এই কল্পিত ‘হিন্দু রমণী’র অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয় না। নির্ভরযোগ্য হিন্দু ঐতিহাসিক দলিল থেকেও সেরকম কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। সেকালের গ্রীক ইতিহাসবিদেরাও এমন কারও অস্তিত্ব সম্পর্কে জানান নি। ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র তাঁদেরও মত, ‘ইতিহাস আলাউদ্দিন খিলজি, চিতোরের রাজা রতন সিং উভয়কেই মানে এবং তাঁদের যুদ্ধের কথাও বলে। কিন্তু তাতে ‘পদ্মাবতীর’ কোনও অস্তিত্ব নেই’।


সিনেমার জন্য একটু টুইস্ট দেবার জন্য কবি জায়সীর উচিলায় একখান প্রেমকাহিনী ঢুকানো হয়েছে। এখানেও Bhansali এন্ড কোম্পানি লিমিটেডের একটা ভিন্ন হাকিকত আছে। মূলত উদ্দেশ্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার চর্চা। সামান্য একটু প্রেমের ইস্যুতে ‘পদ্মাবতী’ হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিরোধের মুখে পড়লেও আদতে এটা মুসলিম বিরোধী চলচিত্র। যেখানে আলাউদ্দিন খিলজিকে দেখানো হয়েছে বর্বর ও চরিত্রহীন একজন মানুষ হিসেবে।


অথচ আলাউদ্দিন খিলজি বিজেতা হিসেবে ছিলেন তামাম ভারতের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম। উত্তর ভারতের প্রভাবশালী রাজ্য গুজরাট, রণ-থম্ভোর, মালব এবং মেবার বিজয় করেন তিনি। এরপর তিনি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন।


কাফুর দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজা যেমন, রামচন্দ্র, প্রতাপ রুদ্র, তৃতীয় বল্লালকে পরাজিত করেন। অধিকার করেন পান্ড্যব রাজ্য। এভাবে ক্রমে ক্রমে সমগ্র দক্ষিণ ভারত মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়। মালিক কাফুর নিজেও ভারত শাসন করেছেন। আলাউদ্দিন খিলজি ও মালিক কাফুর উভয়েই মঙ্গলদের পরাজিত করেছেন। আলাউদ্দিনের হাতে পরাজিত হয়েছিল গুজরাটের রাজা কর্ণদেব, মালবের রাজা মহ্লক দেব, রণ-থম্ভোরের রাজপুত রাজা হামির দেব , মেবারের রাজা রতন সিং।


আলাউদ্দিন খিলজি উদারতা দেখান, কর ও শান্তির বিনিময়ে তিনি পূর্ববর্তী হিন্দু রাজাদেরই অধিকৃত রাজ্যের দায়িত্ব দেন।


৩।


আসুন সিনেমার আলাউদ্দিন খিলজি মিথিকাল ডিসকোর্স থেকে চোখ ফিরিয়ে ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখি, আসলেই কেমন ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি। ইতিহাসের এই পাঠটি আমরা নিয়েছি ড. কুমুদকুমার দাস রচিত "খলজী শাসনাধীন ভারত" (পৃ১২৬–১৫৫) থেকে।


আলাউদ্দিন খিলজি তাঁর ওমরাহ/ অমাত্যবাহিনী খিলজিদের সীমাবদ্ধ রাখেন নি।ভারতীয় হিন্দুদের উচ্চপদ দেন। বিভিন্ন গোষ্ঠীর তুর্কি, আফগান, ধর্মান্তরিত ভারতীয় মুসলিম, নব মুসলিম (মোঙ্গল)দের অভিজাতদের অন্তর্ভুক্ত করেন।তিনি অভিজাতদের আর্থিক ক্ষমতা সম্পূর্ণ খর্ব করেন নখদন্তহীন সিংহে রূপান্তরিত করেন।বিভিন্ন প্রশাসনিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা অর্জনে প্রয়াসী ও সক্ষম হোন।


আলাউদ্দিন খিলজি প্রথম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেন।সরকারি বিপণন কেন্দ্র স্থাপন করেন।সরকার থেকে টাকা দিয়ে কমিশন ভিত্তিক ব্যবসা চালু করেন।জিনিসের দাম কমিয়ে দেন ভর্তুকি দিয়ে।ভারতে ভর্তুকি ব্যবস্থার প্রথম প্রবর্তক।ব্যবসা বাণিজ্য ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘দেওয়ান-ই-রিয়াসত’ নামে এক মন্ত্রক চালু করা হয়। ইয়াকুব নাজির হন প্রথম ‘দেওয়ান-ই-রিয়াসত’।


চোর ডাকাত, খুনী, দস্যুদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।মদ্যপান জুয়া গণিকাবৃত্তি প্রভৃতি কুপ্রথা নিষিদ্ধ করেন।রাজস্ব আদায়কারী চৌধুরী, খুত, মুকদ্দম প্রভৃতি গ্রামের স্বার্থান্বেষী ধনীদের ক্ষমতা খর্ব করেন।


শাসনকার্যে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি।গোঁড়ামি কুসংস্কার ধর্মান্ধতার পরিবেশ বদলে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় আধিপত্য থেকে মুক্তি দেন।মালিক নায়েক নামে এক ‘হিন্দু’কে আখুর-ই-বেগ তথা অশ্বশালার অধ্যক্ষ ও সেনাপতির পদে নিয়োগ করেন।


দেশে চমৎকার রাস্তা ঘাট গড়ে তোলেন।ডাক হরকরা ব্যবস্থা প্রচলন করেন। শেরশাহের অনেক আগেই।দেশের আইন শৃঙ্খলা খুব ভালো ছিল। চুরি ডাকাতি রাহাজানি ছিল না।দিল্লির সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দিন খিলজি প্রথম রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করেন।


৪।


কবি জায়সী রচিত ‘পদুমাবৎ’ যে মিথ মেকিং শুরু করেছিল তাই এখন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস। মুল ইতিহাস এখন মিথ্যা। কবি জায়সীর কল্পিত পদ্মা 



বতী এখন ভারতে হিন্দু সমাজের কারো কারো কাছে দেবী, আবার কারো কাছে হিন্দুবাদের আদর্শ। Sanjay Leela Bhansali শিল্পের ছোঁয়ায় পদ্মাবতী ডিসকোর্স আরেকটু রঙিন হল। আরেক দপা হত্যা করা হল সত্য কে।


কবি জায়সী যখন ‘পদুমাবৎ’ রচনা করেছিলেন তখন তিনি কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন,
তার স্রেফ সাহিত্য ভাবনা একদিন ইতিহাস বিকৃত করে দিবে
কিংবা
তার কবি মানসের কল্পিত মানসী পদ্মাবতী একদিন বিজেপি (BJP) সুপার মার্কেটে চড়া দামে বিক্রি হবে?


কৃতজ্ঞতায়: ড. কাওসার আহমদ

পঠিত : ১১৫৪ বার

মন্তব্য: ০