Alapon

বিটিএস : হ্যামিলিওয়নের বাঁশিওয়ালা



হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা একটি বিখ্যাত গল্প। হ্যামিলন একটি শহরের নাম। সেই শহরে ইঁদুরের প্রকোপ বেড়ে যায়। মনে হয় যেন ইঁদুরের বন্যা হয়েছে। স্কুলের ব্যাগ, খাবারের পাতিল, বিছানা, টেবিল, ড্রয়ার, জুতা যেখানেই হাত দেয়া হয় সেখানেই ইঁদুরের উপস্থিতি। শহরের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে যায় ইঁদুরের যন্ত্রণায়।

হ্যামিলন শহরে একদিন আজব এক লোকের আগমন ঘটল। বাহারি রঙের আলখেল্লা পরিহিত এক বাঁশিওয়ালা। সে শহরবাসীকে ইঁদুর থেকে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে আশ্বাস দিল। বিনিময়ে সে যা চায় তাই পাবে। লোকটি অদ্ভুত সুরে বাঁশি বাজাতে বাজাতে শহর থেকে কিছুটা দূরে এক নদীর দিকে চলতে লাগল। সুরের মূর্ছনায় ইঁদুরের দল তার পিছু নিল। নদীর তীরে গিয়ে বাঁশিওয়ালা বাঁশি বন্ধ করে দিতেই সব ইঁদুর নদীতে ঝাপিয়ে পড়ল। এভাবেই হ্যামিলনের শহরবাসী ইঁদুরের কবল থেকে রক্ষা পেল।

বাঁশিওয়ালা শহরে এসে মানুষের কাছে বিনিময় চাইল। কিন্তু তারা লোকটার সাথে প্রতারণা করল। কোন প্রকার বিনিময় না দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিল। বাঁশিওয়ালার ভিতর প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল। কিছুদিন পর সে আবার শহরে প্রবেশ করল। সে নতুন এক সুরে বাঁশি বাজাতে আরম্ভ করল। এবার বাঁশির সুরের মূর্ছনায় ইঁদুরদল নয়, হ্যামিলনের সকল শিশুরা তার পিছু নিল। বাঁশিওয়ালা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুরের জাদুতে শহরের শিশুদের নিয়ে অজানা গন্তব্যে হারিয়ে গেল।

কাল্পনিক এই গল্পটির সাথে ছোটবেলা থেকেই আমি পরিচিত। ছোটবেলায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা নামক এই গল্প আমার প্রিয় একটি গল্প ছিল। গল্পটি কাল্পনিক হলেও আমি যেই বিষয়ে লিখতে চাচ্ছি তারসাথে গল্পের শিক্ষণীয় এক যোগসূত্র আছে। এজন্যই গল্পটি উল্লেখ করা।

বর্তমান জাহেলী বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিগুলো পুরোটাই মুসলিমদের জন্য হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত। এই ইন্ড্রাস্টিগুলো মুসলিম প্রজন্মকে একটা ঘোর ও নেশার মধ্যে রেখে আল্লাহ, তার রাসুল ও দ্বীন থেকে বহুদূরে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কাউকে তো ইসলাম থেকেই বের করে দিচ্ছে। আমি বিটিএসকে আলাদাভাবে শিরোনাম করলাম অফলাইনে কিছু ঘটনা ও অনলাইনে কিছু স্ক্রিনশট দেখার ফলে। মুসলিম মেয়েদেরকে ভয়াবহভাবে মোহাচ্ছন্ন করে ঈমান থেকে সরিয়ে দিচ্ছে বিশেষ এই গ্রুপ। তাদের নূন্যতম ঈমান, গায়রাত, হায়া সবকিছুকে বিলীন করে দিচ্ছে।

আশ্চর্যজনকভাবে এদের মধ্যে অনেক এমন মেয়েও আছে, যারা হিজাব পরিধান করে। এমনকি দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের গণ্ডিতেও এই ফেতনা প্রবেশ করেছে। কেউ তাদের জন্য ঈমান ছেড়ে দিতে প্রস্তুত, আবার কেউ তাদের কাছে নিজের ইজ্জত বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত। কেউ কেউ আরো আগে বেড়ে বিটিএসকে তাদের রব হিসেবেও ঘোষণা দিচ্ছে।নাঊযুবিল্লাহ।
এই গ্রুপের আরেকটি ভয়াবহ দিক হল, এরা তাদের ফ্যানদের মাঝে সমকামিতার ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক করে তুলছে। তাদের অধিকাংশ ফ্যানই সমকামিতার প্রতি সফট ধারণা রাখে। অথচ সমকামিতা মারাত্মক একটি পাপ। মহান আল্লাহ তায়ালা এই পাপের জন্য পুরো এক জাতিকে জমিনে ধ্বসিয়ে দিয়েছেন। আরেক হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে লানত দেন যারা কওমে লুতের কাজ তথা সমকামিতা করে। এমনকি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীসে সমকামিতায় লিপ্ত ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। ( যদিও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেকারো দায়িত্ব না)

মূলত বিটিএস গ্রুপের প্রধান কাজ হল গানবাদ্য। গানবাদ্য হল শয়তানের বাঁশি। এই বাঁশি অন্তরে কপটতা সৃষ্টি করে, নেশার জন্ম দেয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত শয়তান তার সুরের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর রাসুলের আনুগত্য থেকে বের করে কুফুর ও জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়। গানবাদ্য হল অন্তরের মাদক। শয়তান এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরে এক প্রকার মাদকতা সৃষ্টি করে দ্বীনের ব্যাপারে বেহুশ বানিয়ে রাখে। সালাফদের একজন বলেছেন, গানবাদ্য অন্তরকে বিনষ্টকারী এবং রবকে অসন্তুষ্টকারী।

বর্তমান প্রজন্মের দ্বীনের ফেরার প্রধান বাঁধাগুলো চিহ্নিত করলে প্রধানতম হিসেবে যেই বিষয়গুলো সামনে আসবে সেগুলো হল, গানবাদ্য, নাটক মুভি ও নারী কেন্দ্রিক মোহ। আর এই সবগুলোর সম্পর্কই যৌনতার সাথে। ফলে বলা যায়, এই প্রজন্মের প্রধান সমস্যা হল যৌনতাকেন্দ্রিক মোহ। কারো ভিতর যৌনতাকেন্দ্রিক এসব মোহ আর দ্বীন কখনোই একত্রিত হতে পারে না৷ এই সত্য ইসলামের শত্রুরাও ভাল করে উপলদ্ধি করেছে। এজন্য বর্তমান পুরো জাহেলী সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে যৌনতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির উপর। যৌনতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে কখনোই একটা দ্বীনদার প্রজন্ম গড়ে উঠতে পারে না। এই সংস্কৃতিতে কখনোই এমন কোন প্রজন্মের কল্পনা করা যায় না, যারা সত্য প্রতিষ্ঠার পথে নির্বিঘ্নে অগ্রসর হবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা ( লিপ্ত হওয়া তো দূরের কথা) যিনার কাছেও যেও না। নিশ্চয় তা অশ্লিলতা এবং পথ হিসেবে তা কতই না নিকৃষ্ট। ( সুরা ইসরা, ৩২)

এজন্য ইসলামী শরীয়তে কেবল যিনাই নয়, যিনার প্রতি উদ্রেককারী প্রতিটি কাজ ও পদক্ষেপকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফ্রি মিক্সিং, নারী পুরুষের বন্ধুত্ব, একে অপরের দিকে তাকানো, নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শন, গানবাদ্য এগুলো সমাজে যৌনতা কেন্দ্রিক উন্মাদনা সৃষ্টি করে। দেখবেন বর্তমান পুরো জাহেলী সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে যৌনতা উদ্রেককারী সকল উপকরণের উপর। এই উপকরণ ও এক্টিভিটিগুলোকে আধুনিক জাহেলী সভ্যতায় কেবল সহজলভ্যই করা হয়নি, বরং এগুলোকে প্রশ্নাতীত অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
আর মহান আল্লাহ তায়ালা এগুলো থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এগুলোকে নিকৃষ্ট পথ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ এগুলো মানুষকে দ্বীন থেকে গাফেল করে দেয়। বান্দা ও আল্লাহর মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। যেই পথ মানুষকে দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকে তা অবশ্যই নিকৃষ্ট পথই হবে। তাছাড়া উল্লেখিত বিষয়গুলো মানুষের বিবেক, বুদ্ধি, দায়িত্বজ্ঞান ও ব্যক্তিত্বকেও নষ্ট করে দেয়।

যৌনতাকেন্দ্রিক মাদকতাপূর্ণ যেই কালচারে বর্তমান মুসলিম প্রজন্ম হাবুডুবু খাচ্ছে, এই কালচার থেকে তাদেরকে বের করা না গেলে আমরা এমন কোন প্রজন্মের আশা রাখতে পারি না, যারা জাতির উন্নতি সাধন করবে। আল্লাহর দ্বীনকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে। মানবজাতিকে একটি সুস্থ সভ্যতা উপহার দিবে। মুসলিম দায়ীদেরকে বিশেষভাবে যুব সমাজের এই সমস্যাগুলো অনুধাবনপূর্বক সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এর সাথে মুসলিম পিতামাতাদেরকেও তাদের সন্তানদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ও সতর্ক হতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে, সন্তানসন্ততি তাদের কাছে আল্লাহর দেয়া আমানত। আল্লাহ পইপই করে এই আমানতের হিসাব তাদের কাছ থেকে নেবেন। সন্তানদেরকে পর্দা, মাহরাম গাইরে মাহরাম মেইন্টেইন, দৃষ্টি অবনত রাখা, ফ্রি মিক্সিং থেকে দূরে থাকা, হায়া, গাইরাতের উপর প্রতিপালন করা একদিকে সন্তানদের অধিকার, অন্যদিকে তা পিতামাতার উপর গুরুতর দায়িত্ব। আর মুসলিমদের মধ্যে যারা সমাজে অশ্লিলতার প্রচারক সেলিব্রিটি, নায়ক, নায়িকা, মডেল, প্রতিষ্ঠানের প্রতি যারা আবেগ, ভালবাসা ও উন্মাদনা রাখেন তারা একনিষ্ঠভাবে কেবল একবার পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি নিয়ে ভেবে দেখুন।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জাননা। (সুরা নুর, আয়াত ১৯)

তিনি আরো বলেন, আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।( সুরা লুকমান, আয়াত ৬)
আপনি কাদেরকে নিয়ে উন্মাদন হয়ে আছেন, কাদের ভালবাসায় আপনি অন্ধ হয়ে আছেন, কাদের প্রতি আপনি মুগ্ধতা অনুভব করছেন, কাদের মত হওয়ার জন্য আপনি আপ্রাণ পরিশ্রম করে যাচ্ছেন!

যাদেরকে আপনার রব আযাবের ভীতি প্রদর্শন করছে, যাদেরকে আপনার সৃষ্টিকর্তা অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করছে, যাদেরকে আপনার ইলাহ দুনিয়া ও আখেরাতে অপদস্থতার বাণী শোনাচ্ছে, যাদেরকে আপনার প্রতিপালক অসম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরছে।
যাদের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তির ঘোষণা দিচ্ছেন, যাদেরকে তিনি তিরস্কার করছেন তারাই হয়ে গেছে বর্তমান মুসলিম প্রজন্মের আইডল ও আদর্শ। তারাই হয়ে গেছে তরুণ তরুণীর একমাত্র ব্যস্ততা। মুসলিম উম্মাহর জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ বিষয় আর কী হতে পারে!

-ইফতেখার সিফাত

পঠিত : ৪৬১ বার

মন্তব্য: ০