Alapon

• উস্তাজ মওদুদীর রাজনৈতিক চিন্তাকাঠামো ও তার বিরোধী পক্ষের মতামত : (পর্ব-০১)



ফ্রানৎস ফানোঁ যেমন কলোনাইজারদের হাতে শোষিত মানুষের আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে শেষ অস্ত্র হিসেবে দেখেছেন। তেমনি মওদুদী মজলুমের শেষ অস্ত্র হিসেবে জাহিলিয়াতে আচ্ছন্ন শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেছেন। যাকে তার পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠিত জাহিলিয়াতের মোকাবিলায় শাসকের বিরুদ্ধে অনন্তর যুদ্ধের ঘোষণা বলা যায়। এজন্য ফাঁনো কিংবা মওদুদী দুজনই পশ্চিমের বিরুদ্ধে শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবিলা করেই ক্ষান্ত হন নি। উপনিবেশের বিরুদ্ধে নিজস্ব আইডিওলোজিকে প্রতিষ্ঠাকল্পে বাস্তব ময়দানের লড়াইয়েও নেমে এসেছেন। যেটা মওদুদীর সমালোচকদেরকে মওদুদী থেকে আলাদা করেছে।

মওদুদী ছিলেন আধুনিক যুগের পলিম্যাথ। শুধুমাত্র পশ্চিমের মোকাবিলা করতে গিয়ে রাজনৈতিক বয়ান হাজির করেই ক্ষান্ত হন নাই। তার পাশাপাশি ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরতে গিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক(বিশেষ করে আধুনিক ব্যাংকিং, সুদমুক্ত অর্থনীতি, অর্থনীতির নতুন সংজ্ঞায়ন ও বিশ্ব অর্থনৈতিক ধারণা থেকে ইসলামের অর্থৈতিক চিন্তাকে আলাদাকরণ), শিক্ষাকাঠামোর রূপ, নারী ও শিশুসহ, মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনের সাথে সাজুয্য অসংখ্য বিষয়ে তাকে কলম ধরতে হয়েছে। এবং স্থান-কাল ও সময়ের প্রেক্ষিত ধর্মীয় টেক্সটের আলোকে নতুন সমস্যা চিন্তায় নতুন করে মোকাবিলায় নামতে হয়েছে। তার এসবের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন রাষ্ট্রচিন্তক। যেই চিন্তা তাকে সারা পৃথিবীতে পরিচিত করে তোলার পাশাপাশি একদল মানুষকে যে চিন্তায় একটি রাজনৈতিক দলের অধীনে জড়ো করতে পেরেছিলেন।
গত শতকের মুসলিম দুনিয়ায় রাজনৈতিক ইসলামের তাত্ত্বিক চিন্তাকাঠামোর (তাওহীদ আল হাকিমিয়্যাহ) যে রূপ তিনি সামনে নিয়ে আসেন তা ছিল গত এক হাজার বছরের মুসলিম ইতিহাসের মধ্যে নতুন চিন্তার সংযোজন। যেটা একইসাথে ইসলামের মূল টেক্সটের সাথে সাজুয্য ও বাস্তব জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় একটি ধারা-লো বিপ্লববাদী অ-স্ত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কারণ, খেলাফতের পতনে সারাবিশ্বে মুসলমানরা হাহাকার করছিল তখন। তৎকালীন ইকামাতে দ্বীনের চলমান ডিস্কোর্সকে তিনি আরো বেশি গতিশীলতা দান করেন। এবং রাষ্ট্রকে জাহিলিয়াত আখ্যায়িত করেন। বর্তমান সেই একই বিষয় কতটুকু প্রযোজ্য তা নিয়ে বিস্তর আলাপ চলে আসছে সামনেও চলমনা থাকবে। কারণ, মওদুদীর চিন্তা দুনিয়ার এখনো শেষ আসে নি। সেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এখনো তার গর্জন নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
ট্র্যাডিশনাল ঘরানা থেকে সর্বদাই মওদুদীর রাজনৈতিক চিন্তাকে অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল হয়ে ওঠার ব্যপারে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু, তারা বিষয়টাকে মওদুদীর সমসাময়িক ঔপনিবেশিককালের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনায় আনেন না। মওদুদী পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিজম ও মডার্নিটির বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আক্রমণ করেছিলেন। এবং পাশ্চাত্যের সামনে ইসলামকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্নাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। পশ্চিম সীমান্ত থেকে পূর্বের সীমান্ত পর্যন্ত এই মানুষই সেদিন ইসলামের পক্ষে বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। এবং ইসলামি টেক্সটের আলোকে তৎকালীন কঠিন ও ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চিন্তা করছিলেন। যাকে সারাবিশ্বে গতশতকের স্কলাররা ইমাম কিংবা উস্তাজ হিসেবে সম্বোধন করে থাকে।

মূলত, একজন বুদ্ধিজীবীর কাজ কি? বা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একজন মুজতাহিদের কাজ কি? স্থান কাল ও সময়ের প্রেক্ষাপটে ধর্মের চলমান সংঘর্ষমূলক বয়ানগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সফলতার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। মওদুদী একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইসলামের চরম সংকটকালে তেমনটাই হাজির করার চেষ্টা করেছেন। এদিক থেকে তাকে অতি রাজনৈতিক হিসেবে সমালোচনাকারী নদভী, ওয়াহিদুদ্দিন ও গামেদীরা তার মত করে পশ্চিমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কোন বয়ান পেশ করতে পারেন নি। তাছাড়া,পশ্চিমের মোকাবিলার ক্ষেত্রে তাদের বয়ান পুরোটাই অরাজনৈতিক ও শুধুমাত্র তা বইয়ের চিন্তা কাঠামোর ভিতরেই আবদ্ধ ছিল এখনো আছে। তার কোন রাজনৈতিক ফর্ম তারা কখনো হাজির করতে পারেন নি। উল্টো, পশ্চিম থেকে শুরু করে প্রাচ্যের রাজনৈতিক ধারায় তারা অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রের সাথে লিয়াজু করেই নিজেদেরকে অরাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু মওদুদী শুধু মোকাবিলার রাজনৈতিক বয়ান লিখেই বসে থাকেন নি। তার জন্য তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। এবং সে প্রেক্ষিতেই তার সময়কালীন সকল চিন্তা ও মতদর্শের মোকাবিলা তাকে করতে হয়েছে। এবং রাজনৈতিক দলের বাস্তব সম্মুখ কার্জক্রম ও পথচলায় নানামাত্রিক সিদ্ধান্তগত ভুল থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে তার চেষ্টাকে অস্বীকার করাকে এক প্রকার বেইনসাফি বলা যায়। শুধু তাই নয়, একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘ পথচলায় সফলতা না পেতে পারে, তাই বলে সে চিন্তা বাদযোগ্য বিষয়টা এমনও নয়। কারণ, মুসলিম ধর্মীয় টেক্সটে সফলতার জন্য ব্যক্তির প্রচেষ্টা ও আল্লাহর পক্ষ থেকে সফলতা পাওয়ার বয়ানই উপস্থিত। ফলে, যেকোনো রাজনৈতিক দল তার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চেষ্টা চলমান রেখে, স্থান কাল ও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পথচলাকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা যায়। পৃথিবীতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হাজারো বয়ান থাকতে পারে। কিন্তু, সেগুলোর রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক ফর্ম কোনটা চলমান তার উপর নির্ভর করে তাদের মোকাবিলার চলমান লক্ষ্য কিংবা পরিণতি।

মওদুদীর যারা ক্রিটিক করেছেন তারা মওদুদীকে তাদের ট্র্যাডিশনাল চিন্তা ও নিজস্ব অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিবেচনা করার চেষ্টা করেছেন। মওদুদীর মধ্যে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক চিন্তকের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তেমনি এটাও স্পষ্ট যে, এদিক থেকে তার সমালোচকরা ছিলেন বাস্তব রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। তারা রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করলেও বাস্তব দুনিয়ার রাজনীতির সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। মওদুদীর ক্রিটিককারীদের মধ্যে অন্যতম গামেদী, মিয়া নদভী ও ওয়াহিদুদ্দিন খানদের ব্যক্তিজীবনে দৃষ্টিপাত করা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। গামেদী মওদুদীর রাজনীতির নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু, গামেদী এটা বুঝতে পারোন নাই একটা চিন্তাকে রাজনীতিতে সেট করতে গেলে সমসাময়িক অসংখ্য বিষয়ের মোকাবিলায় একটি দলকে কতটুকু জটিলতার ভিতর দিয়ে পথ চলতে হয়। এক্ষেত্রে, মওদুদীর সমালোচদের তার রাজনৈতিক কাজের কিংবা চিন্তাগত নিয়মপন্থা অবলম্বনকে ক্রিটিক করাটাই আরো উপকৃত হওয়ার দরজ খুলে দিতো।

মিয়া নদভী মওদুদীর রাজনৈতিক চিন্তার সমালোচনা করেছেন। আবার সমালোচনা করেছেন সাইয়েদ কুতুবের চিন্তারও। কুতুব ছিল মওদুদীর চিন্তারই ভাবশিষ্য। নদভী তার জনপ্রিয় বইয়ের(মুসলিম বিশ্বের পতনে বিশ্ব কি হারালো?) ভূমিকা লিখেছিলেন কুতুবকে দিয়েই। ব্রাদারহুডের সাথে ছিল উনার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। মুসলিম বিশ্বে নদভীকে পরিচিত করানোর ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে ব্রাদারহুডের মত সংগঠন। অন্যদিকে, তিনি আজীবন সম্পর্ক রেখেছেন সৌদী মোনার্কির সাথে। পশ্চিমের সখ্যতায় অক্সফোর্ডে ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন ভূমিকা। আবার ভারতবর্ষের রাজনীতি থেকে ছিলেন অনেক দূরে। যেখানেই উপস্থিত উনার চিন্তা ও কর্মের সংকট। ওয়াহিদুদ্দীন খান ও গামেদীর ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য। এরা কেউই রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব ছিলেন না। রাষ্ট্রপক্ষের মনো বেদনা তৈরি হতে পারে এমন কিছুই তারা করেন নি। উল্টো উনাদের কেউ কেউ অনেক সময় রাষ্টপক্ষের মনতুষ্টিই করে চলেছিলেন। তারমানে উনারা ছোটখাটো আলেম ছিলেন এটা কখনোই বলা যাবে না, আমরা বলছিও না। তারা অনেক বড় মানের আলেম ছিলেন নিঃসন্দেহে। ট্র্যাডিশনার ধারার অধীনে উম্মাহর রুহকে জীবন্ত করার ক্ষেত্রে তারা নতুন কোন চিন্তাই মুসলিম উম্মাহকে দিতে পারেন নাই। তারা দাওয়াহ’র ময়দানে সরব ছিলেন কিন্তু পশ্চিমের মোকাবিলায় তাদের কোন বুদ্ধিভিত্তিক বয়ান উল্লেখযোগ্য আকারে ছিল না। তাই বলে উম্মাহর কল্যাণে তাদের অবদান নেই সেটাও আমরা বলছি না। রাজনৈতিক অঙ্গনে না এসে তারা তাদের নিজস্ব অরাজনৈতিক অবস্থান থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনকে সরাসরি খারিজ না করার কাজে মুখর হওয়াটা ভালোভাবে নিতে পারা কঠিন বলা যায়। তবে ইসলামের বিভিন্ন ধারায় তারা যে অবদান রেখেছেন তা সত্যিই অনস্বীকার্য।
এক্ষেত্রে, মওদুদী ছিলেন বাস্তব ময়দানের স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিদ ও ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক। তাওহীদে হাকিমিয়াকে অবলম্বন করেই সারাজীবন ভয়হীন লেখালেখি করেছেন। এটার একটি বিপ্লবী তাত্ত্বিক রূপ খাড়া করেছিলেন। নদভীর সাথে তার চিন্তার পার্থক্যের পিছনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পার্থক্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মাণ। তার পাশাপাশি ইসলামকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনায়ও ছিল তাদের স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি। উম্মাহর ফকীহ ইউসুফ আল কারজাবি নদভী ও মওদুদী দু'জনেরই জীবনী লিখেছেন। মওদুদীর বিপক্ষে নদভীর সমালোচনাকে তিনি শুধু চিন্তার পার্থক্য হিসেবেই দেখেছেন। আমাদের কাছে মনে হয়,এমন চিন্তার পার্থক্য তৈরি হওয়ার পিছনে রাজনৈতিক ময়দানের অবস্থান ও ভৌগোলিক অবস্থানও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

একজন পলিটিক্যাল লিডারের তুলনায় একজন পলিটিক্যাল থিংকার হিসেবে মওদুদী সফল। তারপরও তার চিন্তাকে ময়দানে আনার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বিশাল বড় ব্যপার ছিল। এখানে তার বিশাল ক্যাডিট। এছাড়াও, তার সবচেয়ে বড় সফলতার জায়গা হলো উপনিবেশে দাড়িয়ে পাশ্চাত্যের জ্ঞানকাণ্ডের বিরুদ্ধে ইসলামের পক্ষে তার শক্তিশালী অবস্থান। ইসলামের ট্র্যাডিশন থেকে না বের হয়েও স্থান-কাল ও সময়ের আলোকে তার ধর্মীয় পরিমণ্ডলের কার্জকরণ নবায়ন। তিনি একজন মুজতাহিদ ছিলেন। আর একজন মুজতাহিদের কাজই হলো সময়ের আলোকে চিন্তা করা। তিনি সে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তার সবটুকু চিন্তা সঠিক, এমনটা ভাবা যেমন ভুল, তেমনি তার সবটুকু চিন্তা ভুল তেমনটা ভাবাও ঠিক না। তার সাংগঠনিক চিন্তাকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। বিশেষ করে, তার রেখে যাওয়া JI এর বর্তমান কার্যক্রম ও কার্য পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযুগ থাকতে পারে। মওদুদীর জীবনী লেখকরা বাংলাদেশে তাকে যেভাবে একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন, তার পাশাপাশি একজন বিশ্ব মানের রাষ্ট্রচিন্তক হিসেবে তাকে নিয়ে তেমন পর্যালোচনায় হাজির করতে পারেন নি। তবে এটা তাদের ব্যর্থতা বলবো না। বরং এটাও তাদের নিজস্ব সক্রিয় সাংগঠনিক জীবনের প্রভাব(তার জীবনী লেখকরা ব্যক্তিজীবনে সকলেই বড় বড় লিডার ছিলেন)। তারা নিজেরা যেমন বৈশ্বিক মানের চিন্তক হয়ে উঠতে পারেন নি ; তেমনি মওদুদীকেও একজন বৈশ্বিক চিন্তক হিসেবে পরিচিত করাতে পারেন নি। আজকের বাংলাদেশে তাই মওদুদী পাঠ একধরনের ক্রাইসিসে আবর্ত। শুধুৃমাত্র অরাজনৈতিক, বুর্জোয়া ভাবপ্রেমিক খপ্পরে পতিত হয়েছে মওদুদী পাঠ। যারা ওয়াহিদুদ্দিন খান, গামেদী, নদভীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মওদুদীকে পাঠ করে। কিন্তু, তার সমকালীন চিন্তা বিশ্বের আলোকে তাকে পাঠ করে না। এর পিছনে আরেকটা কারণ ক্রিয়াশীল থাকার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে পলিটিক্যাল ইসলামের সম্মুখ রাজনৈতিক ক্রাইসিস, যা তাদেরকে মওদুদীর মত সাহসী না হয়ে নদভী ও গামেদীদের মত হওয়ার প্রেরণা যোগায়। মূল পলিটিক্যাল ইসলামের বয়ান যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ার প্রেক্ষিতঃ দুর্বল রাজনৈতিক দেওবন্দী ডিসকোর্সের ভেতরে ঢুকে ট্র্যাডিশনাল ইসলামের তাওহীদ ও তামুদ্দুনিক কাঠামোকে ধ্বংস করার একধরনের ছুপা পায়তারা লক্ষনীয়। যার ফলে ভাববাদী, মার্কসবাদী ও সেক্যুলার ভাবুকরা দেওবন্দী কাঠামোতে ঢুকতে উঠে পড়ে লেগেছেন। এটি ইসলামের বিপক্ষে চক্রান্ত বৈ কিছু নয়।

সম্প্রতি হাটাজারি মাদ্রাসার সাঈদ আহমদ নামক একজন শিক্ষক মওদুদীর বিরুদ্ধে কয়েকপর্বে লিখেছেন। যাকে বিশ্লেষণ করে বলা যায় মোটাদাগে মওদুদীর সমালোচনায় লেখা নদভীর বই থেকে তিনি দুটো অভিযোগ কপি করে তুলে ধরেছেন। তন্মধ্যে আমরা আজকে একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। ইবাদত সংক্রান্ত বিষয়টি অন্য পর্বে আলাপ করবো।

সাঈদ আহমদ সাহেব উনার লেখায় (৪র্থ পর্বে) প্রথমে মিয়া নদভীর ভাষ্যতে খিলাফাহ বা ইসলামি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা, নববী যুগ থেকে খেলাফত বা ইসলামি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সাহাবী, তাবেয়ী ও পরবর্তী প্রত্যেক যুগের ব্যক্তিদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে খেলাফত বা ইসলামি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। নদভী খেলাফতের সংজ্ঞা নির্ধারণে শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহঃ) কে উদ্ধৃত করেন, “খেলা(ফত হচ্ছে সেই ব্যাপক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব; যার মাধ্যমে দ্বীন কায়েমের উদ্যোগ নেয়া যাবে এভাবে যে, দ্বীনী ইলমসমূহকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে, ইসলামের আরকানসমূহকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, জি হা /দ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী যেমন, সেনাবাহিনী সুসংগঠিত করা, তাদেরকে লড়াইর জন্য গড়ে তোলা এবং তাদের মাঝে গনীমতলব্ধ সম্পদ বণ্টন করা ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা পালন করা যাবে, শরয়ী বিচারব্যবস্থা ও তার দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা যাবে, নিপীড়ন ও শোষণের যাবতীয় পথ রুদ্ধ করা যাবে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে বাঁধা প্রদান করা যাবে। আর এসব কিছু সম্পাদিত হবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে ।

অতঃপর শাহ সাহেব (রহঃ) খেলাফতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন :
“খেলা(ফতের এ সকল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও শাখাসমূহকে যদি একটি বাক্যে প্রকাশ করতে হয়, যা তার সকল অংশকে অন্তর্ভূক্তকারী একটি ব্যাপক একক নীতির মত শোনাবে এবং তার সকল অনুষঙ্গের ও প্রকারের জন্য জাতিবাচক প্রধানবিশেষ্য হবে, তাহলে তা হচ্ছে "ইকামাতে দ্বীন"। এরপরেই নদভী লিখেছেন, "এখানে একটি বাস্তব ও সত্য কথা স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার যে, “ইক্বামাতে দ্বীন” শব্দকে শুধু আল্লাহ তা'আলার শাসন প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করার সমার্থবোধক বানিয়ে ফেললে তা ভুল হবে। জামায়াতে ইসলামীর রচনাবলীর মাঝে তা যেই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই অর্থ হতে ‘ইকামাতে দ্বীন' শব্দটি আরো ব্যাপক, গভীর ও বিস্তৃত অর্থ ও বোধ ধারণ করে আছে।"

এক্ষেত্রে নদভী সুরা আশ শূরা-১৩ নং আয়াত উদ্ধৃত করেন এবং আয়াতে উল্লেখিত اقيموا الدين বাক্যটির অর্থ বিশ্লেষণে লিখেছেন, "বাক্যটির অর্থ পূর্বাপর একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, এর দ্বারা সম্পূর্ণ দ্বীন ও তার শিক্ষা [আকাইদ, ইবাদাত ও মু'আমালাত] উদ্দেশ্য। শুধু খেলা(ফত ও রাজত্ব এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অর্জন করা-ই উদ্দেশ্য নয়।"
তারপর তিনি উক্ত বাক্যের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসীকে উদ্ধৃত করেন। আলুসী (রহঃ) লিখেছেন, “এখানে দ্বীন দ্বারা উদ্দেশ্য হল, দ্বীনে ইসলাম; যা বলা হয় আল্লাহ এক বলে স্বীকার করা, তাঁর বশ্যতা ও আনুগত্য মেনে নেওয়া, তাঁর সমস্ত কিতাব, সকল রাসূলের উপর, প্রতিদান দিবসের উপর এবং সে সকল বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা; যেগুলোর মাধ্যমে একজন বান্দা মু'মিন হতে পারে। আর দ্বীন কায়েম করার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তার আরকানসমূহকে স্থিতিশীল করা এবং তার মাঝে কোনো ধরনের বক্রতা ও বিভ্রান্তি ঘটে যাওয়া থেকে তা সুরক্ষিত রাখা। সাথে সাথে এই দ্বীনের উপর সদা সর্বদা অবিচল থাকা।"
[আলোচনাটি সাঈদ আহমদ সাহেব আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) লেখা বইয়ের (অনু-) ১২৩-১২৯ পৃষ্ঠা থেকে কোট করেছেন।]

উপরিউক্ত আলাপ থেকে নদভী (রহঃ) কিংবা সাঈদ আহমদ সাহেব যে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তা হচ্ছে, মওদুদী কিংবা JI এর লোকেরা "ইকামাতে দ্বীন" এর ভুল ব্যাখ্যা বুঝেছেন এবং ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। তারা ইকামাতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার নামে "ইকামাতু দৌলা" বা রাষ্ট্র ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আন্দোলনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে, ট্রাডিশনাল আলেমদের কাছে ইকামতে দ্বীনের যে বিস্তৃত ব্যাখ্যা তাকে বাদ দিয়ে তারা তাকে সংকীর্ণ করে ইকামাতে দৌলার উদ্দেশ্যে পরিণত করেছেন।

এছাড়াও, সাম্প্রতিক সময়ে মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত তার ফেসবুক টাইমলাইনে মওদুদীর সমালোচনায় লিখেছেন,"মাওলানা মওদূদী শুধু ইসলামের অখন্ডিত ও সামগ্রিক রূপ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; তিনি এটি করতে গিয়ে যে ইক্বামতে দ্বীনের তত্ত্ব প্রস্তাব করলেন সেখানে তিনি আধুনিক রাষ্ট্রবাদকে নিয়ে এলেন। ফলে তার চিন্তায় ইক্বামতে দ্বীন আর ইক্বামতে দৌলা একাকার হয়ে গেল। এখানে চিন্তক হিশেবে তার প্রথম বিচ্যুতি। এর ফলে দ্বীনের চেয়ে দৌলা বেশি প্রাধান্য পেয়ে গেল।"

ফলে, নদভীর বক্তব্য ধরে সাঈদ আহমদ সাহেব ও মনোয়ার শামসীর বয়ান একই দিকে অঙ্গুলি নির্দেষ করেছে বলেই স্পষ্ট হয়। বলা থাকা দরকার, তৎকালীন মওদুদীর ইকামাতে দ্বীনের সমালোচনায় নদভীর বয়ানকে অনুসরণ করে আরো অসংখ্য বই লেখা হয়েছে। আমার মতে, এক্ষেত্রে তারা মওদুদীর বয়ানকে কনটেক্সট এর আলোকে বুঝতে সক্ষম হননি। ফলে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন এবং বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছেন। একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, মওদুদীর সমালোচনায় নদভী মূল বয়ানের সমালোচনা না করে বয়ানের শাখাপ্রশাখায় খাবি খেয়েছেন, মওদুদীর পুরো বয়ানের কোন যোক্তিক সমালোচনা নদভী হাজির করতে পারেন নি। বিশেষ করে, মওদুদী তার কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা বইয়ে অসংখ্য কুরআনের আয়াতকে রেফারেন্স হিসেবে এনে তা থেকে সুক্ষ্ম যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন। এবং বয়ানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে নদভী তার বইতে মওদুদীর সমালোচনায় বিষয়গুলোকে ধর্তব্য হিসেবে ধরেন নি। এছাড়াও, নদভী ইকামতে দ্বীন শব্দের ব্যাখ্যায় ইসলামের ট্র্যডিশনাল আলেমদের বিশ্লেষণকে অনুসরণ করেছেন। যাদের মাঝে খেলাফত বর্তমান ছিল। তারা খেলাফত প্রতিষ্ঠাকে তাই ফরজে কিফায়াহ হিসেবে দেখেছেন। অন্যদিকে, মওদুদী ইকামাতে দ্বীনের বয়ান পেশ করেছেন ঔপনিবেশিক সংকটকালীন মূহুর্তে। যেখানে মুসলমানদের খেলাফত তছনছ হয়ে গেছে। এমন কঠিন মুহূর্তে সময়ের আলোকে ইকামাতে দ্বীনের যুগোপযোগী ব্যাখ্যাই তিনি হাজির করার চেষ্টা করেন। এবং আমরা দেখবো, নদভী ঐতিহ্যিক আলেমদেরকে অনুসরণ করে ইকামতে দ্বীনের যে বিস্তৃত ব্যাখ্যা পেশ করেন মওদুদী সে ব্যাখ্যাকে অতিক্রম করে সময়ের আলোকে আরো গতিশীল ব্যাখ্যা হাজির করেন। যার ফলে নদভী যে বিষয়টি ক্লিয়ার করে ধরতে পারেন নাই তা স্পষ্ট হয়। মওদুদী বিষয়টি নিয়ে বিস্তর লিখে গেছেন। আমরা তা থেকে একটু আধটু আলাপে যাবো। বিষয়টাকে ক্লিয়ার করেই শেষ করবো।

মওদুদীর ব্যাখ্যায় ইকামতে দ্বীন মানে মানুষের ব্যক্তিজীবনে দ্বীন বা ইসলামের কিছু রুসুম-রেওয়াজ বা কিছু ইবাদত পালন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার মতে ইকামাতে দ্বীন হলো একটি ব্যক্তি ও সমাজের সামগ্রিক অবস্থার মাঝে দ্বীনের পুনরুজ্জীবন। যার ফলে ব্যক্তি কিছু ইবাদত করেই দ্বীনের পূর্ণ অনুভূতি আসার তীব্রতা অনুভব না করে জীবনের প্রতিটি সময়কে গনিমত মনে করে আল্লাহর ভয় নিয়ে কাজ করে যাবে। এবং পুরো লাইফটাকে দ্বীনময় করে তুলবে। দ্বীন অনুভূতি তার কাছ থেকে বিন্দু পরিমাণ সময়ের জন্য বের হবে না। এবং সে সমাজ থেকে পালিয়ে সারাদিন/কিছু সময় মসজিদে বসে থেকে নামাজ, রোজা, হজ্জা, যাকাত করার মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে না। বরং মসজিদ থেকে বের হয়েও দুনিয়ার কাজে আটকে যাবে। দুনিয়ার জাহেলিয়াতে থেকে আল্লাহর ভয়ের অনুভূতি নিয়ে তা থেকে নিজের পাশাপাশি সমাজকে মুক্ত করার চেষ্টা করবে। এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করবে যাতে করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল মানুষের জন্য দ্বীনকে জীবনের সামগ্রিক রূপায়ন হিসেবে মেনে চলতে সহজ হয়ে ওঠে। মওদুদী ইকামাতে দ্বীনের নামকরণ ব্যাখ্যায় লিখেছেন,"আমরা যে জিনিস প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, কুরআনের পরিভাষায় তার অর্থবহ নাম হচ্ছে ‘দ্বীনে হক’ অর্থাৎ, সেই জীবনব্যবস্থা (দ্বীন) যা সত্যের (নবীগণের আনীত হেদায়াত অনুযায়ী আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যের) ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এটাকে বোঝানোর জন্য আমরা কখনো কখনো ‘হুকুমতে ইলাহিয়া’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছি। এর অর্থ অন্যদের নিকট যা-ই হোক না কেন, আমাদের নিকট আল্লাহ তা’আলাকে প্রকৃত শাসক ও হুকুমকর্তা স্বীকার করে নিয়ে গোটা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনকে তাঁর শাসন ও হুকুমের অধীনে পরিচালিত করাই কেবল এর অর্থ। এ হিসেবে শব্দটি পুরোপুরি ‘ইসলাম’ এর সমার্থক। এরই ভিত্তিতে আমরা এই তিনটি পরিভাষা (দ্বীনে হক’ হুকুমতে ইলাহিয়া, ইসলাম) সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করি। আর সেই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা সংগ্রামের নাম দিয়েছি আমরা ‘ইকামতে দ্বীন’ ‘শাহাদাতে হক’ ও ‘ইসলামী আন্দোলন’। (আন্দোলন, সংগঠন কর্মী, পৃঃ ৪৪-৪৫; জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ৭)

ঔপনিবেশিক মুসলিম মাত্রই একধরনের চিন্তা ও মননগত সংকটের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্যতার ভিতরে আপ্লুত হয়েছিল। ফলে, ঔপনিবেশিক সংকট থেকে মুসলিম মননকে রক্ষা করতে খেলাফত বিহীন আধুনিক যুগের জাতিরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে ইকামতে দ্বীনের প্রস্তাবনা মওদুদী হাজির করেন। এটাকে যেভাবে মনোয়ার শামশী আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের বয়ান হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছেন এবং তিনি বলেছেন মওদুদী এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইকামতে দ্বীনের তত্ত্বকে ব্যবহার করেছেন। তা পুরোপুরি ভুল ধারণা। তবে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র কাঠামোয় খেলাফত বিহীন ইসলামের নতুন মডেল হিসেবেও তিনি বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে পারতেন। কারণ, মওদুদীর চিন্তাকাঠামোকে অনেকেই পশ্চিমা চিন্তাকাঠামো বলে চালিয়ে দিলেও মওদুদী খোদ তার মডেলের সাথে পশ্চিমা চিন্তাকাঠামোর বিস্তর পার্থক্য নির্দেষ করেছেন। মওদুদীর সমকালীন অনেক আলেম এমন ভুল ধারণার স্বীকার হয়েছিলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন,“আমাদের দাওয়াত সম্পর্কে সাধারণত বলা হয় যে, আমরা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার দাওয়াত দিয়ে থাকি। হুকুমতে ইলাহিয়া শব্দে স্বতঃই একপ্রকার ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়- অনেকে আবার ইচ্ছা করেই একে কেন্দ্র করে ভুল ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। সাধারণত লোকে মনে করে, কিংবা তাদেরকেই বুঝাতে চেষ্টা করা হয় যে, ইসলামি রাষ্ট্র বলতে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা বুঝায় মাত্র। আরো বলা হয় যে, বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে সেই বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ..........সেহেতু খুব সহজেই বুঝানো হয় যে, আমরা হুকুমত দখল করতে চাই......আমাদেরকে দুনিয়ার বা পার্থিব স্বার্থবাদী আখ্যা দেওয়া হয়। অথচ মুসলমানদের দ্বীন-ইসলাম এবং পরকালের জন্যই কাজ করা দরকার, দুনিয়ার জন্য নয়.........অথচ আমাদের বই-পুস্তক উদার ও মুক্ত দৃষ্টিতে পাঠ করলেই প্রত্যেকেই অতি সহজেই বুঝতে পারেন যে, নিছক একটা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামগ্রিক জীবনে ইসলাম নির্ধারিত পরিপূর্ণ বিপ্লব সৃষ্টি করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই বিপ্লবের জন্য আল্লাহ তা’আলা নবী প্রেরণ করেছেন।” (ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি, পৃঃ ৬)
.
এছাড়াও তিনি আরো লিখেছেন, “এ কারণেই আমরা যখন ‘ইকামতে দ্বীন’ শব্দ ব্যবহার করি, তখন তার অর্থ কেবলমাত্র মসজিদে দ্বীন কায়েম করা কিংবা কয়েকটি ধর্মীয় আকীদাহ-বিশ্বাস ও নৈতিক বিধান প্রচার করা-ই আমরা বুঝাই না। বরঞ্চ, আমাদের নিকট এর অর্থ হলো- ঘরবাড়ী, মসজিদ, মাদ্রাসা, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, হাট-বাজার, থানা, সেনানিবাস, কোট-কাচারী, সংসদ, মন্ত্রীসভা, দূতাবাস, সর্বত্রই সেই এক খোদার দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাকে আমরা আমাদের রব এবং মা’বুদ বলে মেনে নিয়েছি। আর এসব কিছুর ব্যবস্থাপনা সেই রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষানুযায়ী পরিচালিত করতে হবে, যাকে আমরা আমাদের প্রকৃত পথপ্রদর্শক বলে স্বীকার করে নিয়েছি।” (আন্দোলন, সংগঠন কর্মী, পৃঃ ৪৮; জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ১০) মওদুদী এক্ষেত্রে মানবজীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের যে মৌলিক ডিসকোর্স তাকে ইকামতে দ্বীন তত্ত্বের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি ইকামতে দ্বীন বলতে সরাসরি এমন কিছুকে বুঝান নাই যা দ্বারা সরাসরি ইকামতে দৌলা বা আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্দেশ্য বুঝায়। তার লেখায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ বা দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলিম জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বাস্তবায়নের মধ্যে নববী আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি সুন্দর সমাজচিত্র ও রাষ্ট্র কাঠামোর গঠনকেই বুঝানো হয়েছে। সেই রাষ্ট্র কাঠামোয় ব্যক্তি ও সমাজের ইসলামী জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ পাবে। মওদুদ লী লিখেছেন, “ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাই মুসলমানদের জীবনের মূল লক্ষ্য। একটি নিছক জাতীয় রাষ্ট্র কায়েম করা তাদের লক্ষ্য নয় বরং দুনিয়ার সামনে আল্লাহর বিধানের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে পারে এমন একটি বিশুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করাই তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা ও নৈতিক পরিবেশ যেখানে খাঁটি ইসলামের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে, যার আইন আদালত ফৌজ পুলিশ ও দূতাবাস পৃথিবীর সামনে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরবে, সে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করাই প্রত্যেক মুসলমানের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। এরুপ একটি ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম হলে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে কি পার্থক্য” এবং ইসলাম সর্বদিক দিয়ে সকল মানবরচিত সভ্যতা ও মতবাদের চাইতে কত উচ্চ ও উৎকৃষ্ট তা জগতবাসী সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে। মুসলমানদের এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকেই আমরা জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। ইসলামের পরিভাষায় একে বলা হয়।” (জামায়াতে ইসলামীর উনত্রিশ বছর, পৃঃ ২৩)
.
এটাও স্পষ্ট যে, মওদূদী যখন রাষ্ট্র, ইকামতে দ্বীন বলেন তখন তাঁর উদ্দেশ্য হয়- পৃথিবীর সামনে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা দ্বীনে হককে পরিপূর্ণ স্থাপন করা। যেই দ্বীনে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে নিবিড় সম্পর্ক আছে, সুস্থ মা’রিফাত আছে, সত্য আধ্যাত্মিকতা আছে, বান্দার আখিরাতের মুক্তি আছে, দুনিয়ার মুক্তি আছে, দুনিয়াতে এমনভাবে জীবনযাপনের নিশ্চয়তা আছে যা তাকে আখিরাতের পাথেয় অর্জনে বাধা সৃষ্টি না করে বরং সহায়তা করবে। তিনি তার ইকামাতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন, “বরঞ্চ কেবল এ উদ্দেশ্যেই চেয়েছিলাম, যেন একটি নিরেট ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পৃথিবীর সামনে ইসলামি জীবনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ নমুনা উপস্থিত করবে।” (আন্দোলন, সংগঠন কর্মী, পৃঃ ৪৫; জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ইতিহাস কর্মসূচী, পৃঃ ৯)

উপরিউক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে মওদুদীর প্রতি তার সমালোচকদের যে ভ্রান্ত দাবি তাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মওদুদীর দৌলার চাইতে দ্বীনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এবং তিনি ও তার দল যে ইকামাতে দ্বীনকে সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ করেন নি এবং ট্রাডিশনাল বিশ্লেষণের বাহিরে যান নি বরং চলমান ব্যাখ্যাকে আরো গতিশীল করেছেন তাই এখানে স্পষ্ট হয়। তিনি ইকামাতে দ্বীনের পক্ষে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। এবং তার দ্বীনের পূর্ণতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তিনি নববী চরিত্রের রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করেছেন। যা আমরা উপরে মওদুদীর লেখনী থেকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি।

~ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান

পঠিত : ৩৪৪ বার

মন্তব্য: ০