Alapon

|| ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ||



ইমাম শাহওয়ালিউল্লাহ দেহলভী জন্মগ্রহণ করেছিলেন
১১১৪ হিজরীতে সম্রাট আলমগীরের মৃত্যুর চার বছর পূর্বে এবং ইন্তিকাল করেন ১১৭৬ হিজরীতে দিল্লীর অন্ধ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলমের আমলে। কাজেই হায়াতে জিন্দেগিতে শাহওয়ালিউল্লাহ দেহলভী দিল্লীর ১০ জন সম্রাটের শাসনকাল প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারা ছিলেন-
১. সম্রাট আওরঙ্গজেব ২. প্রথম বাহাদুর শাহ্ ৩. ময়েনউদ্দীন জাহাঁদার শাহ্ ৪. ফররুখ সিয়ার ৫. রফিউদ-দারাজাত ৬. রফিউদ-দৌলা ৭. মুহম্মদ শাহ্
৮. মাহমুদ শাহ্ ৯. দ্বিতীয় আলমগীর ১০ দ্বিতীয় শাহ্
আলম।

অন্ধ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলমের হাত থেকে লর্ড ক্লাইভ
কোম্পানী বাহাদুরের পক্ষে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী গ্রহণ করেন। এ ছিলো শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর ইন্তিকালের আনুমানিক দুই বছর পূর্বের ঘটনা।

উপরিউক্ত সম্রাটগণের আমলে দিল্লীর মসনদ কী বিপর্যয়ের মধ্যে নিমজ্জিত ছিলো তা ইতিহাস সচেতন সকলেরই জানার কথা। সৈয়দ-ভ্রাতাদের উত্থান এবং তাদের হাতে একান্ত অসহায়ভাবে ফররুখ সিয়ারের কাররাগারে মৃত্যু বররণ, তারপর তুরানীদের হাতে সৈয়দ ভ্রাতাদের পতন, মারাঠা বিদ্রোহ এবং তাদের উত্থান, শিখ বিদ্রোহ, নাদির শাহের অভিযান এবং দিল্লীতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, পানিপথের যুদ্ধে আহমদ শাহ্ আবদালীর হাতে সত্যের বিজয়, উপমহাদেশের রাজনীতিতে রোহিলার অনুপ্রবেশ, ইরানী এবং তুরানী আমির উমারাদের পারস্পরিক হানাহানি, উপমহাদেশের প্রতি ইউরোপীয়দের লোলুপ দৃষ্টি, এরপর ইংরেজ কর্তৃক বাংলা বিহারের কর্তৃত্ব দখল এবং এগুলি ছাড়া আরো বহু পরিবর্তন এবং বিপ্লব শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ নিজে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

দিল্লীর মসনদ তখনকার দিনে যে উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে দোল খাচ্ছিলো, শাহ্ সাহেব সে সম্পর্কে পূর্ণরূপে ওয়াকিফহাল ছিলেন। মক্কায় চলে যাওয়ার পর তিনি সেখান থেকে উসমানি খিলাফত, হিন্দুস্তান ও মুসলিম রাষ্ট্রের কার্যাবলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
তার একটি পত্রে এ সম্পর্কে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, "উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি বে-খবর নই, কারণ ওখানে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং লালিত পালিত হয়েছি। আমি আরব দেশও দেখেছি বিশ্বস্ত লোকের মারফতে খবরাখবর নিয়েছি।"
শিক্ষা জীবনের এক পর্যায়ে তিনি হাদীস শাস্ত্রে অধিক জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। সেই লক্ষ্যে ১৭২৪ সালে তিনি প্রথমে হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমন করেন। এরপর হিজাজে আট বছর অবস্থান করে, আবু তাহের বিন ইবরাহিম আল কুর্দি আল মাদানির মত পণ্ডিতদের কাছ থেকে হাদীস ও ফিকহ শিক্ষালাভ করেন। একই সময়ে তিনি মুসলিম বিশ্বের আরো বিভিন্ন প্রান্তের লোকের সংস্পর্শে আসেন এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশের অবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন।

এরূপে তিনি তিনি দর্শন, রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। অর্জিত এ সকল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি ‘ফুয়ুদ আল হারামাইন’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। ১৭৩২ সালে তিনি পুনরায় দিল্লীতে ফিরে আসেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনের বাকি সময় এখানেই তার লেখালেখি ও কর্মতৎপরতা চালিয়ে যান।

১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতে মুসলিম শাসনের বিপর্যয় শুরু হয়। অর্থাৎ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি এই পরিস্থিতি সামনে রেখেই তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। সে সময় তার প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল—উপমহাদেশের মুসলিম সমাজকে ইসলামের মূল আদর্শের দিকে ধাবিত করা। আর এই কাজে ব্যাপক জ্ঞান-গবেষণা, লেখালেখি ও রাজনৈতিক তৎপরতাই ছিলো তার কর্মকাণ্ডের সারবস্তু।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিলো— দিল্লীর মসনদকে যাবতীয় দুর্বল শাসন থেকে মুক্ত করে ইসলামের অনুকূল শাসন ব্যবস্থা নিয়ে আসা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন মতভেদে আক্রান্ত মুসলিম সমাজকে একটি অভিন্ন ও মৌলিক চিন্তার আলোকে সমবেত করা। চতুর্থত, ব্রিটিশদের উত্থানকে রুখে দেয়ার জন্য জ্ঞানভিত্তিক এমন একটি পরম্পরা তৈরি করা যাতে করে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবেও তাদের পরাস্ত করা সম্ভব হয়। সর্বোপরি ভারতের মুসলিম সমাজের ওপর আরোপিত সব ধরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিপর্যয় রোধকল্পে স্বতন্ত্র্য শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা। তিনি ১২ বছর অধ্যাপনা এবং গবেষণার পর
সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন। ব্যাপক অধ্যয়ন গবেষণা এবং বিশেষ করে হিজাজ সফরের লব্দ প্রেরণা তাকে ইনকিলাবি আন্দোলন শুরু করার জন্য সজাগ করেছিলো।
এ আন্দোলনের জন্য তিনি দুটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছিলেন।

১.কোরআন মাজীদের ব্যবহারিক মূল্য প্রদর্শন।
২.অর্থনৈতিক সমতা বিধান

আল কোরআনের ব্যবহারিক মূল্য প্রদর্শন এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তার সামগ্রিক সংস্কার প্রস্তাবের মূল বুনিয়াদ। মানুষ যদি জীবনের অধিকাংশ সময় অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের পথেই সংগ্রাম করতে থাকে, তবে সে কখনোই জীবনের বৃহত্তর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের জন্য কাজ করতে পারবেনা—শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী তা ভালোভাবেই জানতেন। এজন্য সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। যাতে উচ্চশ্রেণির অতিরিক্ত ভোগ-বিলাসের দরুণ মধ্য ও নিম্নশ্রেণির মানুষরা নিষ্পেষিত না হয়। জীবিকার জন্য সব শ্রেণির মানুষ যদি একটি ভারসাম্যে উপস্থিত হয়, তবে জীবনের মূল উদ্দেশ্যের দিকে আলোকপাত করা সবার জন্যই সহজতর হবে বলে তিনি মনে করতেন।

কোরআনের আনীত শিক্ষা ও আদর্শকে তিনি সর্বাগ্রে গুরুত্বারোপ করতেন। যদি কোরআনের প্রস্তাবিত আদর্শের আলোকে সমাজব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যায়, তবে যেকোনো যুগে, যেকোনো সমাজেই নব জাগরণের সূচনা অবশ্যম্ভাবি হয়ে উঠবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর রচিত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে ‘হুজ্জাতুল্লাহ আল বালিগাহ’-কে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করা হয়। এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন—
“যদি কোনো মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সভ্যতার বিকাশধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে তাদের শিল্পকলা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে। তারপর যদি শাসকগোষ্ঠী ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ও ঐশ্বর্যের মোহে আচ্ছন্ন জীবনধারা বেছে নেয়, তাহলে সেই আয়েশী জীবনের বোঝা মজদুর শ্রেণির ওপরে এসে পড়ে। ফলে সমাজের অধিকাংশ মানুষ মানবেতর পশুর জীবনে যাপনে বাধ্য হয়। গোটা সমাজ জীবনের নৈতিক কাঠামোই তখন বিপর্যস্ত হয়। সবাইকে তখন অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থেকে জীবনপ্রক্রিয়া চালানোর জন্য বাধ্য করা হয়। তখন মানুষকে রুটি-রুজীর জন্য পশুর মতই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। মানবতার এ চরম নির্যাতন ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহ’তায়ালার পক্ষ থেকে কোনো পথ নির্দেশ অবশ্যই এসে থাকে। অর্থাৎ, স্রষ্টা নিজেই বিপ্লবের আয়োজন করেন।”
হিজাজে গিয়ে তিনি ইজতিহাদের পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেন। তিনি তার ইনকিলাবি হারাকাতের ক্ষেত্রে রসূল (সা.) এর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক প্রেরণা লাভ করেন।
১১৪৪ হিজরি (১৭৩১খ্রি.) এক জুমার রাতে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্বপ্ন দেখেন। সে স্বপ্নের অন্তর্নিতিহ নির্দেশের তিনি এরূপ ব্যাখ্যা করেন-
১. তার হাতে তৎকালীন রাজনৈতিক বিশংখলার অবসান ঘটবে এবং তিনি সেই দায়িত্ব বহন করবেন।
২. বর্তমান সরকারের পরিবর্তে একটি নতুন সরকার গঠিত হবে তিনিই হবেন তার উপলক্ষ্য এবং উপমহাদেশে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও জাতীয় আন্দোলনের তিনিই নেতা হবেন।
৩. বিপ্লবী আন্দোলন দীর্ঘ কালব্যাপী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হবে।
তিনি এমন স্বপ্ন দেখে সংস্কার আন্দোলনের দৃঢ় ইচ্ছে নিয়েই দেশে ফিরেছিলেন।
শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন মক্কায় ইসলামী আন্দোলনকে সামনে রেখেই। তিনি তাসাউফের বাইয়াতকে তার রাজনৈতিক আন্দোলনের
ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অন্য কথায় তাসাউফের বাইয়াত গ্রহণের অর্থ তার নিকট ছিলো- রাজনৈতিক মতবাদের দীক্ষাগ্রহণ। এ কারণেই তিনি রাজনীতিতে তাসাউফ দর্শনকে অধিক গুরুত্ব দিতেন।

শাহ্জানাবাদে প্রতিষ্ঠিত তার মাদরাসা থেকেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিলো। তার পরের সময় ইমাম আব্দুল আজিজ এবং তার পর ইমাম মুহাম্মদ ইসহাক
এই মাদরাসা থেকেই আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ তার আন্দোলনের পরিকল্পনা রচনার সাথে সাথে তার অনুবর্তীদের দ্বারা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পরিষদ গঠন করেছিলেন। তারা শিক্ষা ও দীক্ষার মারফতে একদিকে আলেম ও সুফি অন্যদিকে আমির -উমারা এবং শাহি দরবারের অন্য বিশিষ্ট লোকদের মধ্যে আন্দোলন বিস্তার করার কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন।
যারা এ কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তাদের মধ্যে
মওলানা মুহাম্মদ আশেক ফুলহাতি, মওলবী নুরুল্লাহ্,
মওলানা মুহাম্মদ আমিন কাশ্মীরী উল্লেখযোগ্য।

তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে কেন্দ্রীয় পরিষদের শাখাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নাজিরাবাদের মাদরাসা, রায়বেরেলিতে শাহ্ ইলমুল্লাহর দায়েরা এ শ্রেণির শাখা কেন্দ্র। সিন্ধুর থাড্ডায় মোল্লা মুহাম্মদ মুঈন-এর মাদরসাও তার শাখা ছিলো। বিখ্যাত সুফি আব্দুল লতিফ ভাট্টাইর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো। সুলতান মুহাম্মদ এবং নওয়াব নজিবুদ্দৌলাহ্ ছিলেন শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর বিশেষ ভক্ত।

জীবনের শেষদিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীকে রাজনৈতিকভাবে একটি বড় ভূমিকা নিতে হয়। সে সময় তিনি মারাঠাদের অব্যাহত শক্তিবৃদ্ধি থেকে দিল্লীর শাসনকে নিরাপদ করার দিকে মনোনিবেশ করেন। এজন্য আহমদ শাহ আবদালীকে পত্র লিখে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানান। ফলে ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পরাস্ত করে আহমদ শাহ আবদালী দিল্লীকে নিরাপদ করেন। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ ও ইনসাফভিত্তিক শাসন নিশ্চিত করার জন্য তার বিভিন্ন লেখালেখি ও কর্মতৎপরতার মাঝেই লুকিয়ে ছিলো ভবিষ্যৎ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রসদ।
রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি নম্নোক্ত চিন্তাধারা পেশ করেন-

এক. সার্বভৌমত্বের নিরঙ্কুশ মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্।
এতে কোনো রূপ অংশীদারিত্ব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী মানুষ হলো মুসাফিরের ন্যায়।

দুই. মানুষ হিসেবে প্রতিটি আদম সন্তানের সমান মর্যাদা।
একে অপরের প্রভুত্ব দাবি করার কোনো অধিকার নেই।
এক মানুষ অপর মানুষের দাসত্ব করতে পারে না।

কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্র বা জাতির মালিক হতে পারে না।কোনো মানুষের পক্ষে ক্ষমতাশালী কোনো শাসকের প্রতিও এরূপ ধারণা পোষণ করা অবৈধ।

তিন. রাষ্টপ্রধানের মর্যাদা তত্ত্বাধায়কের সমতুল্য।তত্ত্বাবধানকারী প্রয়োজন বোধ করলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সে পরিমাণ অর্থই গ্রহণ করতে পারে, যে পরিমাণ
দ্বারা একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন নির্বাহ হয়ে থাকে।

চার. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে একমাত্র আল্লাহর দ্বীনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
তার চিন্তা ও জ্ঞান ছিলো অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। কোরআন, হাদীস, তাফসির, ফিকহ শাস্র সহকারে পাশ্চাত্যের অনেক জ্ঞান সম্পর্কেও বিশদ ধারণা রাখতেন। ফার্সি ভাষায় কোরআনের তরজমা করে তৎকালীন অনেক ধর্মীয় নেতাদের ভ্রান্ত চিন্তার অপনোদন ঘটিয়েছিলেন। এছাড়া হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফত নিয়ে শিয়া মতাবলম্বীদের ভুল প্রচারকে মোকাবেলার জন্য ‘ইযালাতুল খিফা’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা এবং ইযালাতুল খিফা গ্রন্থে ইসলামি খিলাফত এবং রাজতন্ত্রের পার্থক্য তুলে ধরেন।

অতঃপর খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ও শর্তাবলি উপস্থাপন করেন এবং সেসব অবদান পেশ করেন যা ইসলামী খিলাফত আমলে প্রকৃত পক্ষে মুসলমানদের ওপর বর্তায়। অন্যদিকে শরীয়াহর মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে উত্তম ফয়সালা নির্ধারণের জন্য ‘আল ইনসাফ ফি বায়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ’ নামক একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া আরো অনেক বিষয়ে তার বিস্তর লেখা ও গবেষণা রয়েছে। এর মাঝে 'আল ফাউজুল কাবীর', 'আল কাউলুন নাসির', 'আল আকিদাতুল হাসানাহ' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

মৃত্যুর আগে তার তৎপরতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি প্রচুর শিষ্য তৈরি করে যান। তার সুযোগ্য পুত্র শাহ আব্দুল আজিজ প্রায় ৬০ বছর ধরে উপমহাদেশে সেই লক্ষ্যে অব্যাহতভাবে কাজ করেন। শাহ শহীদ ইসমাইল, শাহ ইসহাক ও আহমেদ ব্রেলভী তারই চিন্তা ও আদর্শের উপযুক্ত সৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হন। এছাড়া আরো অনেক ইসলামী স্কলার ও পুনর্জাগরণ কর্মীদের ওপরে তার জীবন ও তৎপরতার প্রভাব ছিলো অসামান্য। সাইয়িদ নুরসী (রহ.) তারই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তুরস্কে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহ.) ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর ভাবশিষ্য। তিনি তার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে ভারত বর্ষে জামায়াতে
ইসলামী গঠন করেন এবং সর্বাত্মক বিপ্লবী ও সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন।


-----------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্রঃ
১.দার্শনিক শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.) ও তাঁর চিন্তাধারা-জুলফিকার আহমদ কিসমতী।
২. ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন-সাইয়েদ আবুল আলা
মওদূদী।
৩.শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা-
মওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী
৪.Shah Waliullah Al-Dehlawi : Thoughts and Contributions by Kunju, Saifudheen
৫. Muslim Philosophy and Philosophers by Mohammad Sharif Khan, Mohammad Anwar Saleem

- মোস্তফা

পঠিত : ১২৭৭ বার

মন্তব্য: ০