Alapon

দ্বীন এর অর্থ কী?




দ্বীন এর আভিধানিক অর্থ

আমরা যদি ‘الدين’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সম্পর্কে অনুসন্ধান করি, তাহলে দেখতে পাব— শব্দটির ভিন্নধর্মী একাধিক অর্থ রয়েছে। ভিন্নধর্মী একাধিক অর্থ থাকার কারণে কেবল আভিধানিক অর্থ থেকে ‘الدين’ শব্দের প্রকৃত মর্মার্থ সম্পর্কে আমরা খুব একটা অবগত হতে পারি না। এ কারণেই আল্লামা ড. মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ দারায কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত বোধ অর্জনে অভিধানিক জ্ঞানকে অসম্পূর্ণ আখ্যায়িত করেছেন; কারণ তা আমাদেরকে কোনো বিষয়ের যথার্থ ও চূড়ান্ত বোধ ও তাৎপর্য সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে অবহিত করতে পারে না।
তবে শাইখ দারায তাঁর গবেষণায় পেয়েছেন, ‘الدين’ শব্দের এই বিবিধ অর্থ সামগ্রিকভাবে তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত মৌলিক অর্থকে নির্দেশ করে। আবার এই তিনটি মৌলিক অর্থের মাঝেও যে সামান্য তফাত পরিলক্ষিত হয়, তার ভিত্তি হচ্ছে— যার অর্থ করা হচ্ছে তা মূলত একটি শব্দ নয়, বরং তিনটি শব্দ। আরও সহজ করে বলতে গেলে, ‘الدين’ শব্দ তিনটি ক্রিয়ামূলকে ধারণ করে। ফলে, এই তিন ক্রিয়ামূলের অর্থের মাঝে সামান্য তফাত পরিলক্ষিত হয়। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
‘‘الدين’ শব্দটি মাঝে মাঝে ‘دانه يدينه’ থেকে উদগত হয়। তখন এটা হয় স্বনির্ভর فعل متعدي বা সকর্মক ক্রিয়া। মাঝে মাঝে ‘دان له’ থেকে উদগত হয়, তখন এটা ‘ل’ দ্বারা فعل متعدي বা সকর্মক ক্রিয়া হয় এবং মাঝে মাঝে ‘دان به’ থেকে উদগত হয়, তখন এটা ‘ب’ দ্বারা فعل متعدي বা সকর্মক ক্রিয়া হয়। এই উৎপত্তিস্থল ভিন্ন হওয়ার কারণেই ‘الدين’ শব্দের অর্থের মাঝে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
১. ফলে যখন আমরা বলব ‘دانه دينا’, তখন এর অর্থ হবে— সে তার মালিক হলো, সে তাকে আদেশ করল, সে তাকে পরিচালনা করল, সে তার বন্দোবস্ত করল, সে তাকে বশীভূত করল, সে তার হিসাব নিল, সে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিল, সে তাকে প্রতিদান দিলো এবং সে তাকে পুরস্কৃত করল ইত্যাদি। অতএব দেখা যাচ্ছে উপর্যুক্ত ব্যবহারে ‘الدين’ শব্দটি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অর্থ প্রদান করে। আর এই মালিক হওয়া, আদেশ করা, পরিচালনা করা, বন্দোবস্ত করা, বশীভূত করা, হিসাব নেওয়া, সিদ্ধান্ত নেওয়া, প্রতিদান দেওয়া ও পুরস্কৃত করা ইত্যাদি সবকিছুই রাজা, বাদশাহ বা ক্ষমতাধর সত্ত্বার কর্মকাণ্ড।
‘الدين’ শব্দের এ অর্থই প্রদান করে মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারিমের এই আয়াত—
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
“বিচার দিনের মালিক।” সূরা ফাতিহা : ০৪
অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ আদায় ও প্রতিদান প্রদানের দিবস।
রাসূল সা. বলেন—
الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ
“বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসকে বশে রাখে।”
অর্থাৎ সে স্বীয় নফসকে তার নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের ভিতর রাখে।
২. আবার যখন আমরা বলব ‘دان له’, তখন এর অর্থ হবে— সে তার আনুগত্য করেছে, সে তার অধীন হয়েছে ইত্যাদি। অতএব এর আলোকে ‘الدين’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আনুগত্য, বশ্যতা, অধীনতা ও দাসত্ব ইত্যাদি।
ফলে ‘الدین لله’ বা ‘দ্বীন আল্লাহর জন্য’ এই শব্দগুচ্ছ দুইটি অর্থ প্রদান করে। আর এই দুইটি অর্থই সঠিক। অর্থ দুইটি হচ্ছে— ১. কতৃত্ব ও ক্ষমতা আল্লাহর জন্য। ২. আনুগত্য ও দাসত্ব আল্লাহর জন্য।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট যে, ‘الدين’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থটি প্রথম অর্থের অনুগামী ও তার সাথে সম্পর্কিত। তাই বলা হয়—
دانه فدان له
অর্থাৎ সে তাকে আনুগত্যের ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করল, ফলে সে তার আনুগত্য করল এবং তার সামনে বিনীত হলো।
৩. আবার যখন আমরা বলব ‘دان بالشيء’, তখন এর অর্থ হবে— সে কোনো কিছুকে তার দ্বীন বা চলার পথ হিসেবে গ্রহণ করেছে, কোনো কিছুকে সে তার আকিদা বা বিশ্বাস হিসেবে পছন্দ করে নিয়েছে এবং কোনো কিছুকে সে তার অভ্যাস বা আখলাক হিসেবে বেছে নিয়েছে ইত্যাদি। এর আলোকে ‘الدين’ শব্দের অর্থ হয়— চিন্তাগত ও কর্মগত এমন এক মাযহাব বা চলার পথ, মানুষ যাকে তাদের জীবন চলার পথে অনুসরণ করে। একজন মানুষের কর্মগত মাযহাব হচ্ছে তার স্বভাব, আচার, আচরণ, অভ্যাস, রীতি-নীতি ও জীবন চরিত ইত্যাদি। যেমন বলা হয়—
هذا ديني وديدني
অর্থাৎ এটাই আমার দ্বীন, এটাই আমার স্বভাব চরিত।
আবার একজন মানুষের চিন্তাগত মাযহাব হচ্ছে তার আকিদা-বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি, যা সে লালন করে। যেমন আরবরা বলে—
دینت الرجل
অর্থাৎ আমি তাকে তার দ্বীনের ব্যাপারে ছেড়ে দিয়েছি। তথা আকিদা বা বিশ্বাস হিসেবে যা কিছুকে সে বেছে নিয়েছে, তার ব্যাপারে আমি কোনো আপত্তি বা বিরোধিতা করি নি।
অতএব দেখা যাচ্ছে, ‘الدين’ শব্দের এই তৃতীয় অর্থটিও পূর্ববর্তী দুই অর্থের অনুগামী। কারণ কোনো ব্যক্তি যে আকিদা-বিশ্বাস বা স্বভাব-চরিত্রগুলো লালন করে, তার উপর এগুলোর সীমাহীন প্রভাব বিরাজ করে। ফলে এই আকিদা-বিশ্বাস বা স্বভাব-চরিত্রগুলো ব্যক্তিকে তাদের অনুগত, অনুসারী ও দাসানুদাস করে তোলে।
মোটকথা, এই ত্রিবিধ আভিধানিক অর্থ থেকে এ কথা প্রমাণিত হচ্ছে যে, ‘الدين’ শব্দ দ্বারা আরবরা মূলত এমন এক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বুঝাতো যার প্রথমপক্ষ দ্বিতীয়পক্ষকে সম্মান ও ভক্তি করতো, সমীহ করতো এবং তার সামনে বিনীত হতো। তাই আমরা যদি ‘الدين’ শব্দকে প্রথমপক্ষের বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করি, তখন এর অর্থ হবে আনুগত্য ও অধীনতা। আর যদি দ্বিতীয় পক্ষের বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করি, তখন এর অর্থ হবে মালিকানা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ইত্যাদি। আর যদি আমরা দুই পক্ষের মধ্যে যুগসূত্র স্থাপনকারী সম্পর্ককে বিবেচনায় আনি, তখন এর অর্থ হবে দ্বিপাক্ষিক এই সম্পর্কের প্রকাশভঙ্গি কিংবা এই সম্পর্ক পরিচালিত হওয়ার সুবিন্যস্ত রূপরেখা।
অতএব আমরা বলতে পারি, সম্পূর্ণ আলোচনা মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। আর তা হচ্ছে আনুগত্যের আবশ্যকতা। প্রথম ব্যবহার তথা دانه دينا এর অর্থ হচ্ছে অপরের উপর আনুগত্য আবশ্যক করে দেওয়া, দ্বিতীয় ব্যবহার তথা دان له এর অর্থ হচ্ছে নিজের উপর আনুগত্যকে আবশ্যক করে নেওয়া এবং তৃতীয় ও সর্বশেষ ব্যবহার তথা دان بالشيء এর অর্থ হচ্ছে সেই মূলনীতি ও রূপরেখা, যার আনুগত্য করা হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আরেকটি কথা পরিষ্কার হয়ে উঠে। তা হচ্ছে ‘الدين’ শব্দটি ও তার সমুদয় ব্যবহার সবকিছুই আরবি ভাষার উৎসজাত। আর ওরিয়ান্টালিস্টরদের দাবি— ‘الدين’ শব্দ ও এর সমুদয় ব্যবহার কিংবা অধিকাংশ ব্যবহার হিব্রু অথবা ফার্সি থেকে আগত, তা একটি মিথ্যা ও অসার দাবি। তাদের এই অযৌক্তিক দাবির পিছনে লুকিয়ে রয়েছে ঘৃণ্য জাতি বিদ্বেষ। তারা আরবদেরকে সম্মান ও গৌরবের সকল উৎস থেকে বঞ্চিত করতে চায়, এমনকি ভাষাগত সম্মান ও গৌরব থেকেও; অথচ এ ভাষাই হচ্ছে তাদের সম্মান ও গৌরবের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস।
আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে যাওয়া যাক। ‘الدين’ শব্দের এই ত্রিবিধ ব্যবহার থেকে আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করবে শেষ দুইটি ব্যবহার, বিশেষত তৃতীয় ব্যবহারটি। কারণ ধর্মসমূহের ইতিহাসে ‘الدين’ শব্দটি মাত্র দুইটি অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে, অন্য আর কোনো অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। যথা—
১. সেই মানসিক অবস্থা (état subjectif), যাকে আমরা ধার্মিকতা (religiosité) হিসেবে অভিহিত করে থাকি।
২. বহিঃস্থ সেই হাকিকত (fait objectif), যার দিকে প্রতিটি বাহ্যিক আচার-আচরণ, রীতিনীতি ও কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন করা যায়। অর্থাৎ সেই মূলনীতিসমূহ যাকে কোনো জাতি তাদের চিন্তা ও কর্মের মানহায (doctrine religieuse) হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।
সর্বশেষ এই অর্থটিই বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত।
দ্বীন এর পারিভাষিক অর্থ
• ইবনুল কামাল বলেন, “দ্বীন হচ্ছে এমন এক ইলাহি বিষয়, যা আকলবানদেরকে সেই বিষয়গুলো কবুল করতে আহ্বান জানায়, যেগুলো রাসূল সা. নিয়ে এসেছেন।”
• কেউ কেউ বলেন, “দ্বীন হচ্ছে এমন এক ইলাহি বিষয়, যা আকলবানদেরকে তাদের সৎ ইচ্ছাশক্তির ভিত্তিতে সত্ত্বাগত দিক থেকে উত্তম হিসেবে বিবেচিত বিষয়াবলির প্রতি চালিত করে।”
• আবুল বাকা তার কুল্লিয়ায় বলেন, “দ্বীন হচ্ছে এমন এক ইলাহি বিষয়, যা আকলবানদেরকে তাদের সৎ ইচ্ছার আলোকে সত্ত্বাগত দিক থেকে উত্তম হিসেবে বিবেচিত আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়াবলির প্রতি চালিত করে। যেমন আকিদা-বিশ্বাস, জ্ঞান ও নামায ইত্যাদি।
মাঝে মাঝে الدين শব্দের ব্যবহারে এর একটি দিককে (এর আভ্যন্তরীণ বিষয়াবলিকে) উপেক্ষা করে এটাকে কেবল দ্বীনের মৌলিক বিষয়য়াবলি বুঝাতে প্রয়োগ করা হয়। তখন এটি মিল্লাত অর্থে ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۚ
“এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন, ইবরাহিমের মিল্লাত (আদর্শ), তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ।” সূরা আল আনয়াম : ১৬১
আবার মাঝে মাঝে এর অন্য দিকটিকে উপেক্ষা করে এটাকে দ্বীনের শাখাগত বিষয়াবলি বুঝাতে প্রয়োগ করা হয়। এ অর্থেই আল্লাহ তায়ালার কথা—
وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَذَٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ
অর্থাৎ আর (তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে) নামায প্রতিষ্ঠা করতে এবং যাকাত আদায় করতে। আর এটাই সঠিক দ্বীন।” সূরা বাইয়িনাহ : ০৫
• ইসলামপন্থীরা দ্বীনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ যে সংজ্ঞাটি উদ্ধৃতি করে, তা মূলত বর্ণনা করেছেন كشاف اصطلاحات العلوم والفنون প্রণেতা। সংজ্ঞাটি হচ্ছে—
“দ্বীন হচ্ছে এমন এক ইলাহি বিষয়, যা সুস্থ আকলের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে তাদের ইচ্ছার আলোকে দুনিয়াবি কল্যাণ ও পরকালীন সফলতার দিকে চালিত করে।”
• শাইখ ড. দারায উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোকে এভাবে সারসংক্ষেপ করেছেন—
الدين وضع إلهي يرشد إلی الحق في الإعتقادات، وإلی الخير في السلوك والمعاملات.
“দ্বীন হচ্ছে এমন এক ইলাহি বিষয়, যা আকিদার ক্ষেত্রে হক এবং আচার-আচরণ ও মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে কল্যাণের দিকে চালিত করে।”
আমার কাছে মনে হয়েছে, শাইখ দারাযের সংক্ষেপিত এই সংজ্ঞার ত্রুটি হচ্ছে তা ইবাদত ও মুয়ামালাত উভয়কে একত্রে ধারণ করে না। তবে আমরা যদি সংজ্ঞায় বর্ণিত আচার-আচরণ (السلوك) শব্দকে ব্যাপক অর্থে ধরি, তাহলে তা আল্লাহর সাথে আচার-আচরণ ও বান্দার সাথে আচার-আচরণ উভয়কেই ধারণ করে।
শাইখ দারায পাশ্চাত্যের কিছু মনীষী কর্তৃক বর্ণিত ধর্মের সংজ্ঞাও উল্লেখ করেছেন, যা মুসলিম স্কলারদের বর্ণিত দ্বীনের সংজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও কাছাকাছি অর্থবোধক। আমরা এখানে কয়েকটি সংজ্ঞা উদ্ধৃতি করছি।
• Cicero বলেন, “ধর্ম হচ্ছে সেই সম্পর্ক বা বন্ধন, যার মাধ্যমে মানুষ স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে।
• তিনি আরও বলেন, “ধর্ম হচ্ছে আমাদের সেই দায়িত্বানুভূতি যা ঐশী নির্দেশনার উপর নির্ভরশীল।”
• Friedrich Schleiermacher তার ‘On Religion: Speeches to its Cultured Despisers’ গ্রন্থে বলেন, “ধর্মের মূল ভিত্তি হচ্ছে আমাদের নিরংকুশ অভাববোধ ও অধীনকার মানসিকতা।”
• ফাদার শাতিল বলেন, “ধর্ম হচ্ছে সৃষ্টিজীবের কতিপয় দায়িত্বের সমাহার; যথা— স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব, সমাজের প্রতি দায়িত্ব এবং তার নিজের প্রতি দায়িত্ব।”
• Robert B. Spencer বলেন, “ধর্মের মূল উপাদান হচ্ছে এমন এক শক্তির প্রতি বিশ্বাস, সময় বা কাল কোনো দিক থেকেই যার কোনো সীমা, পরিসীমা ও সমাপ্তি নেই।”
আল কুরআনে ‘দ্বীন’ শব্দ
কোনো অনুসন্ধিৎসু পাঠক যদি আল কুরআনুল কারিম পাঠ করেন, তাহলে দেখতে পাবেন নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট, একক বা সম্বন্ধবাচক ইত্যাদি বিভিন্ন পন্থায় দ্বীন শব্দটি আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল কুরআনে দ্বীন শব্দটি বিবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই, আল কুরআনে কোথায় শব্দটি কোন অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে তা নির্ধারণ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই এর আগ-পর ও বর্ণনাপ্রসঙ্গ দেখতে হবে।
১। কোনো কোনো সময় ‘দ্বীন’ শব্দটি ‘الجزاء’ বা প্রতিদান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন—
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
“প্রতিদান দিবসের মালিক।” সূরা ফাতিহা : ০৪
২। কোনো কোনো সময় ‘দ্বীন’ শব্দটি ‘الطاعة’ বা আনুগত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন—
وَأَخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلَّهِ
“এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তারা তাদের আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করে।” সূরা নিসা : ১৪৬
৩। কোনো কোনো সময় ‘দ্বীন’ শব্দটি দ্বীন ও আকিদার মৌলিক বিষয়াবলি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন—
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ ۖ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ ۚ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ ۚ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ.
“তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন দ্বীন; যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি ওহি করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহিম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে মতবিরোধ করো না। তুমি মুশরিকদের যার প্রতি আহ্বান করছ, তা তাদের নিকট দুর্বহ মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে দ্বীনের দিকে পরিচালিত করেন।” সূরা শুরা : ১৩
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যে বিষয়ে উম্মতে মুহাম্মাদিকে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই একই বিষয়ের নির্দেশনা দিয়েছিলেন নূহ, ইবরাহিম, মুসা ও ঈসার মতো মহান নবিদেরকে। আর সেই নির্দেশনা হচ্ছে—
أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ ۚ
“তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে মতবিরোধ করো না।”
এ আয়াতে বর্ণিত দ্বীন, যা নিয়ে সকল রাসূলগণ আগমন করেছেন, তার অর্থ সম্পর্কে বিখ্যাত মুফাসসির হাফিয ইবনু কাসির রাহি. বলেন—
“একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক না করা। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন—
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
“আর তোমার পূর্বে আমরা যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তার কাছে এ ওহিই পাঠিয়েছি যে, আমি ব্যতীত আর কোনো সত্য ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদাত করো।” সূরা আম্বিয়া : ২৫
হাদিস শরিফে এসেছে, “আমরা নবিগণ পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই; আমাদের সবার দ্বীন এক।” বুখারি : ৩৪৪২, মুসলিম : ২৩৬৫, আহমাদ : ৯২৭০। আবু দাউদও (৪৬৭৫) কিছুটা ভিন্ন শব্দে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
অর্থাৎ তাদের সবার দ্বীনের সাধারণ কথা হচ্ছে এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক না করা। এই দিক থেকে তাদের সবার দ্বীন সমান, যদিও তাদের শরিয়ত ও মানহায ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন—
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ۚ
“তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এক একটি শরীয়ত (আইন) ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।” সূরা মায়িদা : ৪৮
এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেছেন—
أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ ۚ
“তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করো এবং এতে মতবিরোধ করো না।”
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সকল নবি-রাসূলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার ওসিয়ত করছেন এবং বিভক্তি ও মতবিরোধ থেকে বিরত থাকার আদেশ করছেন।” ইবনু কাসির : ৪/১০৯
৪। আল কুরআনে কোনো কোনো সময় ‘দ্বীন’ শব্দটি বিশেষত ইসলামকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন—
أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ
“তারা কি আল্লাহর দ্বীন বাদ দিয়ে অন্য কোনো দ্বীন চায়?” সূরা আল ইমরান : ৮৩
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন—
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ
“তিনি পথনির্দেশ (কুরআন) এবং সত্য দ্বীনসহ নিজ রাসূলকে প্রেরণ করেছেন।” সূরা তাওবা : ৩৩, সূরা ফাতহ : ২৮, সূরা সফ : ০৯
৫। মাঝে মাঝে দ্বীন শব্দ দিয়ে কোনো কওম বা জাতি যে আকিদা-বিশ্বাস লালন করে তা বুঝানো হয়েছে; হোক তা বাতিল আকিদা। যেমন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে কাফির-মুশরিকদের উদ্দেশ্যে বলতে আদেশ করেছেন—
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
“তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আমার দ্বীন আমার জন্য।” সূরা কাফিরুন : ০৬
‘দ্বীন’ শব্দটি কেবল হক দ্বীন বুঝায় না
‘দ্বীন’ শব্দ দিয়ে কেবল হক দ্বীন বুঝায় না। বরং মানুষ যে সকল ধর্ম পালন করে কিংবা যে সকল আকিদা-বিশ্বাস লালন করে; তার সবই হচ্ছে দ্বীন, হোক তা হক কিংবা বাতিল।
একবার আমি এক সম্মেলনে উপস্থিত হই। সম্মেলনে অনেককেই আমন্ত্রণ করা হয়। সম্মেলনের বিষয়বন্তু ছিল বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা এবং তাদের অনুসারীদের মাঝে দূরত্ব দূর করা। সকল বক্তাই এ বিষয়ে কথা বলছিলেন৷ হঠাৎ এক বক্তা দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলা শুরু করেন—
“ইসলাম ছাড়া আর কোনো দ্বীন বা ধর্মের অস্তিত্বই নেই। কুরআন এ কথাই বলেছে—
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ ۗ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।” সূরা আল ইমরান : ১৯
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ
“যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও কবুল করা হবে না।” সূরা আল ইমরান : ৮৫
এমনকি আসমানি ধর্মগুলোকেও দ্বীন হিসেবে গণ্য করা যাবে না, কারণ এগুলো তার অনুসারীদের মাধ্যমে বিকৃত হয়ে গেছে এবং ইসলাম এসে এগুলোকে রহিত করে দিয়েছে।”
আমি তার কথার প্রতিবাদ জানাই। তার কথার বিরোধিতা করা আমি আমার দায়িত্ব মনে করি। কারণ তার কথার কারণে সম্মেলনে এতক্ষণ যাবত যা বলা হলো, তার সব কিছুই নিষ্ফল হয়ে যায় এবং বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা এবং তাদের অনুসারীদের মাঝে দূরত্ব দূর করণ সম্পর্কিত আলাপের আর কোনো মূল্যই থাকে না। আমি তখন বলি—
‘ইসলাম ছাড়া আর কোনো দ্বীন বা ধর্মের অস্তিত্বই নেই’ এ কথা সরাসরি কুরআন বিরোধী। কারণ, কুরআনুল কারিম ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মগুলোকেও দ্বীন হিসেবে বিবেচনা করেছে, যদিও সেগুলো বাতিল দ্বীন হোক না কেন। সেগুলো দ্বীন হিসেবেই বিবেচিত, যেহেতু এগুলোর অনুসারীরা এগুলোকে দ্বীন বা ধর্ম হিসেবেই পালন করে থাকে।
উপর্যুক্ত দাবি উত্থাপনকারী বক্তা যে আয়াতের মাধ্যমে দলিল দিয়েছেন, স্বয়ং সেই আয়াতই তার দাবি নাকোচ করে। তার দলিল—
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ
“যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও কবুল করা হবে না।” সূরা আল ইমরান : ৮৫
উপর্যুক্ত আয়াতে ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মগুলোকে দ্বীন বলা হচ্ছে।
আল্লাহ তায়ালা আহলুল কিতাবদের লক্ষ করে বলেন—
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ
“হে আহলুল কিতাব, তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না।” সূরা নিসা : ১৭১
এমনকি আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবিকে আদেশ করেন, তিনি যেন মূর্তিপূজারীদের বলেন—
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
“তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আমার দ্বীন আমার জন্য।” সূরা কাফিরুন : ০৬
আল্লাহ তায়ালা কাফিরদের ব্যাপারে বলেন—
الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَهُمْ لَهْوًا وَلَعِبًا وَغَرَّتْهُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا ۚ
“যারা তাদের দ্বীনকে ক্রীড়া-কৌতুকরূপে গ্রহণ করেছিল এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করেছিল।” সূরা আরাফ : ৫১
অতএব, দ্বীন বলতে হক ও বাতিল উভয় দ্বীনই বুঝায়৷ হক দ্বীন হচ্ছে যার বার্তাসহ আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ সা. কে পাঠিয়েছেন। আর বাতিল দ্বীন হচ্ছে ঐসব দ্বীন, যেগুলো রহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ
“তিনিই পথনির্দেশ (কুরআন) এবং হক দ্বীনসহ স্বীয় রাসূল প্রেরণ করেছেন, যাতে এটাকে (হক দ্বীনকে) অন্য সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন।” সূরা তাওবা : ৩৩, সূরা ফাতহ : ২৮, সূরা সফ : ০৯
অতএব, আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ সা. কে হক দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন এবং ওয়াদা করেছেন, এই দ্বীনকে অন্য সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী করবেন। অর্থাৎ ইসলাম আসার পর অন্য দ্বীনগুলোর আর কোন মূল্য থাকে না, ইসলাম সেগুলোকে বাতিল করে দেয়।

দ্বীন ও ইসলাম
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে রাখা দরকার। আর তা হচ্ছে, দ্বীন ও ইসলাম এক বিষয় নয়; যদিও সমসাময়িক অনেক লেখক উভয়টিকে এক মনে করে থাকেন। তবে, দ্বীনকে যদি ইসলাম বা আল্লাহ তায়ালার দিকে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করা হয়, তাহলে উভয়টি এক হতে পারে। যেমন আমরা যদি ‘আল্লাহর দ্বীন’ বা ‘দ্বীন ইসলাম’ এমনটা বলি অথবা বলি, ‘সেই দ্বীন যার বার্তাসহ আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ সা. কে প্রেরণ করেছেন এবং সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল কুরআনুল কারিম নাযিল করেছেন।

কিন্তু, ‘দ্বীন’ শব্দটি যদি কোনো বিশেষণ ছাড়া কিংবা কোনো কিছুর প্রতি সম্পৃক্ত করা ছাড়াই উল্লেখ করা হয়, তাহলে তা ইসলাম শব্দের চেয়ে সংকীর্ণ অর্থ দিবে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে দ্বীন হচ্ছে ইসলামের একটি অংশ।
এ কারণেই ইসলাম যে মাসলাহা বা কল্যাণগুলো মানুষের জীবনে নিশ্চিত করতে চায় উসুলবিদ, ফকিহ ও মুসলিম স্কলাররা এগুলোকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা—
• জরুরিয়্যাত।
• হাজিয়্যাত।
• তাহসিনিয়্যাত।
জরুরিয়্যাত হচ্ছে এমন সব বিষয়, যা ছাড়া মানবজীবন চলতে পারে না অর্থাৎ একবারে অচল হয়ে পড়ে। আর এ জরুরিয়্যাত মোট পাঁচটি। যথা—
• দ্বীন
• নাফস
• মাল
• আকল
• বংশধারা
কিছু কিছু আলেম সম্মানকেও যরুরিয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত মনে করেছেন।
(অর্থাৎ বুঝা যাচ্ছে দ্বীন ইসলামের যরুরিয়্যাত পর্বের আওতাভুক্ত একটি অংশবিশেষ।)
অতএব, ইসলামি শরিয়তের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা এবং এর হিফাযত করা। কারণ, দ্বীনই হচ্ছে মানব অস্তিত্বের মৌলিক উৎস এবং মানবজীবনের মূল বিষয়; এই দ্বীনের কারণেই আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন—
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
“আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে কেবল এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।” সূরা যারিয়াত : ৫৬
আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, তিনি এই আসমান, যমিন মোটকথা গোটা দুনিয়া কেবল এই কারণে সৃষ্টি করেছেন, যাতে মানবজাতি তাঁর পরিচয় লাভ করতে পারে এবং তার যথাযথ হক আদায় করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا
“আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং পৃথিবীও অনুরূপ; এগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ, যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, অবশ্যই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।” সূরা তালাক : ১২
অতএব দ্বীন হচ্ছে এমন বিষয়, যা আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এ সম্পর্কের আওতাভুক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে আল্লাহর মারিফাত, তাঁর তাওহিদ, তাঁর প্রতি শিরক ও ভুল ধারণামুক্ত নির্ভেজাল ঈমান, কেবল তারঁই ইবাদত করা এবং তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করা ইত্যাদি। অতএব আল্লাহ ছাড়া অন্য আর ইবাদত করা যাবে না, তিনি ছাড়া অন্য আর কারো কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না; তবে প্রচলিত উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা ভিন্ন কথা। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
“আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।” সূরা ফাতিহা : ০৫
‘ইসলাম’ শব্দটি ‘দ্বীন’ শব্দের চেয়েও ব্যাপক
অতএব উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে পারছি, ‘ইসলাম’ শব্দের পরিধি ‘দ্বীন’ শব্দের চেয়ে অনেক ব্যাপক। এ কারণেই আমরা বলে থাকি, ‘ইসলাম হচ্ছে দ্বীন ও দুনিয়া, আকিদা ও শরিয়াহ, ইবাদত ও মুয়ামালাত, দাওয়াত ও দাওলাত (রাষ্ট্র), আখলাক ও ক্ষমতা।
নবি সা. এর দুআয়ও আমরা এ বিষয়টি লক্ষ করি। আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবি সা. দোয়া করতেন—
اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لِي دِينِي الَّذِي هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِي - وَأَصْلِحْ لِي دُنْيَايَ الَّتِي فِيهَا مَعَاشِي - وَأَصْلِحْ لِي آخِرَتِي الَّتِي فِيهَا مَعَادِي
“হে আল্লাহ, আমার দ্বীনকে আমার জন্য সঠিক করে দিন, যা কর্মের বন্ধন। আমার দুনিয়াকেও আমার জন্য সঠিক করে দিন, যেখানে আমার জীবন যাপন। আমার জন্য আমার পরকালকে পরিশুদ্ধ করে দিন, যা আমার অনন্তকালের গন্তব্যস্থল।” মুসলিম : ২৭২০
এছাড়াও দেখা যায়, দ্বীনকে দুনিয়ার বিপরীত শব্দ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞরা ‘দ্বীন ও রাজনীতি’ বা ‘দ্বীন ও রাষ্ট্র’ নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা থেকেও ইসলাম শব্দের ব্যাপকতার ধারণা পাওয়া যায়।

-ড. ইউসুফ আল কারজাভী
-অনুবাদ : সাজ্জাদ হোসাইন খাঁ

পঠিত : ৩৮৯৬ বার

মন্তব্য: ০