Alapon

ছাত্রলীগকে কেন বদরুল লীগ বলা হয়?



১.
নাম ছিলো তার বদরুল আলম। পড়তো সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতি বিভাগে। একটা মেয়েকে সে আকাঙ্ক্ষা করতো (তার বা তাদের ভাষায় ভালোবাসতো)। মেয়েটির নাম খাদিজা। পুরো নাম খাদিজা আক্তার নার্গিস। তো প্রেমিক পুরুষ বদরুল তার মনের কথা জানান দেয় খাদিজাকে। বারবার প্রস্তাব করে বা দেয় সে। কিন্তু মেয়েটি তার এই প্রস্তাব গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দেয়। প্রস্তাবে সাড়া না পেলে যে কারোই মন খারাপ হতে পারে। এতোটুকুন স্বাভাবিকই। বদরুলেরও তাই হলো। মন খারাপ আরকি। কিন্তু তার বিষয়টি স্রেফ মন খারাপেই থেমে থাকেনি। সে এটাকে ক্ষোভে রূপ দেয়। এ থেকে তা প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা পর্যন্ত গড়ায়।
 
 
২.
০৩-ই অক্টোবর, ২০১৬। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও পৃথিবীতে বিশুদ্ধ ভোর ফুটেছে। ভোরের বিশুদ্ধ বাতাসের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। কিন্তু সেই ভোরের বিশুদ্ধ বাতাস সিলেট মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজার জন্য বিশুদ্ধ না হয়ে পরিণত হয়েছে অভিশপ্ত এক ভয়ংকর সকালে।
 
অন্যান্য দিনের মতো আজো খাদিজা সকালের নাস্তা ও কাজকর্ম সেরে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্লাসে যাবার। কিন্তু সে জানতো না তার জন্যে কী ভয়ংকর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে! সে বুঝতে পারেনি কী ভয়াবহ এক পিচাশের তাণ্ডবের বলি হতে যাচ্ছে সে। তাই সে আনমনে আনন্দমুখর পরিবেশে ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। আজ তার পরীক্ষা। সে এসেছে পরীক্ষা দিতে। এ পরীক্ষা জীবনেরও।
 
৩.
ক্লাসে এসে হাজির হয়েছে খাদিজা। এসে সুস্থ দেহ সুন্দর মনে পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করে সে। পরীক্ষা শেষ করে যথারীতি বাড়ি ফিরছে খাদিজা ! হাঁটতে হাঁটতে সে কিছু পথ পেরোলো। পৌঁছলো এমসি কলেজের কাছে। এ সময় তার সামনে হুট করেই এক দো-পেয়ে জানোয়ার রূদ্রমূর্তি ধারণ করে এসে দাঁড়ালো। যথারীতি তাকে প্রেমের প্রস্তাব করলো সেই দো-পেয়ে জানোয়ার। আগেই বলেছি, নাম তার বদরুল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। [০১] কিন্তু খাদিজা তার এসবকে পরোয়া না করে সাহস আর ভদ্রতার সাথে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
 
এতেই ঘটলো বিপত্তি! সারা দেহের সকল শক্তি, সকল রক্ত যেনো বদরুলের মাথার মগজে এসে ভর করলো। খপ করে চেপে ধরে খাদিজার হাত সে। হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে।
 
পুকুরপাড়ে এনেই স্বজোরে এক চড় মারে খাদিজাকে। চড়ের ভারটা এতোটাই ভয়াবহ ছিলো যে, খাদিজা লুটিয়ে পড়ে যায় মাটিতে। এবার সাথে সাথেই চাপাতি বের করে নেয় বদরুল। চাপাতি দিয়ে তাঁর বাম হাতে হিংস্র গতিতে দেয় এক কোপ ! খাদিজা প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজেকে রক্ষা করতে। কিন্তু বদরুলের হিংস্রতা তো থেমে নেই। একে একে কোপাতেই থাকে, কোপাতেই থাকে তাকে। কোপের আঘাতে একপর্যায়ে খাদিজা জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে। এই পাষাণ্ড জানোয়ার তাকে এতো ভয়ংকর আর নিষ্ঠুরভাবেই কোপাতে থাকে যে, চাপাতির কোপের আঘাতে খাদিজার মাথার খুলি ভেদ করে মস্তিষ্কও জখম হয়। আশেপাশের মানুষগুলো প্রথমে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকলেও একপর্যায়ে কিছু মানুষ ছাত্রলীগ নেতা নরপশু বদরুলকে ধাওয়া দিয়ে আটক করে। এবং পুলিশে দেয়। [০২]
 
আর এদিকে গুরুতর আহত অবস্থায় খাদিজাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসকরা নিরুপায় হয়ে পাঠিয়ে দেয় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে। সেখানে প্রায় দুই মাস চিকিৎসা দেওয়ার পর ২৮ নভেম্বর সাভারের সিআরপিতে স্থানান্তর করা হয় খাদিজাকে। খাদিজার অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ ছিলো যে, বিচারক পর্যন্ত বলেছেন যে, ভাগ্যক্রমে খাদিজা বেঁচে ফিরেছে। কারণ, খাদিজার অবস্থা ছিলো এরকমই ভয়াবহ যে, স্কয়ার হাসপাতালে তিন দফা অস্ত্রোপচার করতে হয় তার।
 
 
একপর্যায়ে এই ঘাতক হিংস্র জানোয়ারের বিচার হয় আদালতে। আদালত তাকে যাবজ্জীবন দেয়। তখনও অবশ্য তার স্বপ্ন ছিলো। সে ছিলো আত্মবিশ্বাসী।  কারণ সে মুজিব সেনা। ছাত্রলীগ নেতা। অবশ্য শয়তান একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী থাকে, এটা স্বাভাবিক!
রায়ের পর তাকে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার জন্য যখন পুনরায় প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়, তখন প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় বদরুল সবার উদ্দেশে জোর গলায় বলতে থাকে , আমার কিছুই হবে না। [০৩]
 
যাহোক, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্যে খাদিজার ওপর সেই নৃশংস আক্রমণের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, ভাইরাল হয়। এবং এ নিয়ে সারাদেশে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিলো সে সময়।

এই ঘটনার পরে তখন থেকেই ছাত্রলীগকে বদরুল লীগ বলা হয়। উল্লেখ্য, বদরুল আদালতে বিচারকদের উদ্দেশ্য করেও বলে যে, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক।’ [০৪]
[ ছবিতে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা বদরুল কর্তৃক খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য ]


~রেদওয়ান রাওয়াহা
২৩/০৮/২২ ইং


তথ্যসূত্র :
--------------------

০১| ০১| বদরুল আমাদের কেউ না : ছাত্রলীগ/ দৈনিক প্রথম আলো/ ০৪. ১০. ২০১৬

০২| খাদিজা দিলেন বর্ণনা, বদরুল বললেন সুখে থেকো/ NTV Online/ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

০৩ | খাদিজা হত্যাচেষ্টায় বদরুলের যাবজ্জীবন / দৈনিক প্রথম আলো/ ০৮ মার্চ ২০১৭

০৪ | বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তি চাইলেন খাদিজা / দৈনিক ইনকিলাব/ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

পঠিত : ১৩৯১ বার

মন্তব্য: ০