Alapon

স্মৃতি সাগরে আর ঢেউ খেলবে না


সময় বহমান। সময়ের চাকার সাথে স্রষ্টার প্রতিটি নির্দেশনা চলমান। পৃথিবীতে মানুষের আগমণ এবং প্রস্থান রাজাধিরাজ মহান স্রষ্টার নির্দেশনারই ফল। পৃথিবীর আলো বাতাসে প্রতিদিন নিত্য নতুন মূখাবয়বের আগমণ। কেউ আসে কেউ চলে যায়। যে যায় সে আর ফিরে আসে না। ফিরে আসেনি কেউ। স্রষ্টার এ বিধানে নেই অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ। পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা মানুষের এ জীবনের কর্মের সমাপ্তি ঘটে মৃত্যু নামক অমোঘ বিধানে। মানুষের মৃত্যুর মিছিলে কিছু নাম স্মৃতি হয়ে রয়। এমনই এক স্মৃতিময় নাম আব্বাস আলী খান। বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনে এর ভাঙা গড়ায় আব্বাস আলী খান একটি স্মৃতি বিজড়িত নাম। এ মহামনীষী ১৯৯৯ সালে এ ধরাধাম হতে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। রেখে গেছেন, হাজারো স্মৃতি- কিন্তু সে স্মৃতি সাগরে আর কখনো ঢেউ খেলবে না।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ আজ যে সংকটের মূখোমূখি তার প্রধান অনুসঙ্গ মানুষের ভোটাধিকার নেই। দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচনের নামে একদেশদর্শী খেলা চলছে। স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের যে ধারা তা বন্ধ হয়ে আছে। কয়েক কোটি তরুণ এমন আছে, যারা জীবনে এখন পর্যন্ত ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। স্বাধীন দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না প্রায় এক যুগ ধরে। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এ দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী দলের অন্যতম প্রধান হিসেবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সে সময় প্রতিটি নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য জাতির সামনে কেয়ার টেকার সরকার ফর্মূলা পেশ করেছিলেন জননেতা আব্বাস আলী খান। কেয়ার টেকার সরকার ফর্মূলা যদিও অধ্যাপক গোলাম আযমের গভীর বুদ্ধিমত্তা আর রাজনৈতিক চিন্তার ফসল, তবে তখন তিনি প্রকাশ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আসার ক্ষেত্রে কিছু আইনগত প্রতিবন্ধকতা থাকায় ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম জাতির সামনে এ ফর্মূলা পেশ করেন আব্বাস আলী খান। পরবর্তীতে এ দাবীটিই এক দফার দাবীতে রূপ নেয়। ৯০ এর গণ অভ্যূত্থান, ১৯৯৬ এর অসহযোগ আন্দোলন এবং বর্তমানে যে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন চলছে তার কেন্দ্রবিন্দু নির্বাচন ব্যবস্থায় কেয়ার টেকার সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন। বাংলাদেশের অপরাপর রাজনৈতিক দল এবং সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে এ পদ্ধতির উপযোগিতা বোঝাতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। আব্বাস আলী খানের উত্থাপিত ই থিওরীই বর্তমান সংকট সমাধান করতে পারে।
জয়পুরহাটের বিখ্যাত খান পরিবারে ১৯১৪ ইংরেজি সালে তার জন্ম। ধর্মীয় আদর্শিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তিনি। ইংরেজ আমলে পরিচালিত নিউ স্কীম মাদরাসা হতে ১৯৩০ সালেম্যাট্রিকুলেশন পশ করেন। ১৯৩২ সালে রাজশাহী কলেজ হতে ইন্টারমেডিয়েট এবং ১৯৩৫ সালে কলকাতা কলেজ হতে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। পারিবারিকভাবেই বাংলা, উর্দূ এবং আরবী ভাষা শিক্ষা করেন। শিক্ষা জীবনে ইংরেজি ভাষায় সমানতালে দক্ষতা অর্জন করেন। সেই হিসেবে বাংলা, ইংরেজি, আরবী ও উর্দূ ভাষায় তিনি ছিলেন বেশ পারঙ্গম। ভাষার চমৎকারিত্ব, উপস্থাপনার সম্মোহনী শক্তি ছিল অপরীসীম। অতি সাদাসিদে জীবন যাপন আর অকপটে সবকিছু বলে দেয়ার মতো দ্বিধাহীন সাবলীলতা তাঁর জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। জীবনে কোনো কিছু লুকোনোর অভ্যেস কোনোকালেই তাঁর ছিলো না এর প্রমাণ মেলে তার আত্ম জীবনী ‘‘স্মৃতি সাগরের ঢেউ’’ বইয়ে। “নামাযের জন্য কারো পারমিশনের দরকার নেই মশাই। আমি রোজ ১ টার সময় নামাযের জন্য বেরিয়ে যাবোই। আপনি বরং লিখিত অর্ডার দিয়ে বন্ধ করে দিন। দেখবো আপনার মুরোদ খান।”
১৯৩৫ সাল ; বৃটিশ শাসনামল । দুর্লভ সরকারী চাকুরী। বড় সাবের হুকুম-অফিস থেকে নামাযের জন্য যাওয়া যাবে না। বসের রক্ত চক্ষু উপক্ষো করেও জামায়াতে নামায পড়তে গিয়েছেন। এক পর্যায়ে বসের কড়াকড়িতে চাকুরী ছেড়ে দেন। কিন্তু নামায ছাড়েননি।
জেলা শহরে বড় হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন একাধারে দশ বছর। এরপর দীন প্রচার প্রতিষ্ঠার কাজে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নিয়ে পুরো সময়কে কুরবানী হিসেবে পেশ করেন দীনি আন্দোলনের জন্য। নিজ বাড়ির কাছে তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে তালিমুল ইসলাম একাডেমী। যার প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যয় তিনি একাই বহন করেছেন বলা যায়। এভাবে আরো অনেক সামাজিক কাজে তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ঈদগাহ, মসজিদ, কবরস্থান এ ধরণের আরো বহু প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন।
রাজনৈতিক ময়দানে তিনি এক সাহসী সিংহ পুরুষ। ১৯৫৭ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে মাছিগোটে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর রুকন সম্মেলনে তাঁর উপর রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামীর আমীরের দায়িত্ব অর্পিত হয়। পাকিস্তান আমলের শেষ সময় তিনি বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় গ্রæপের নেতৃত্ব দেন। পার্লামেন্ট মেম্বার হিসেবে তিনি আইয়ুব খানের কুখ্যাত মুসলিম পারিবারিক আইন বাতিলের দাবীতে ১৯৬২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় পরিষদে বিল উত্থাপন করেন। আইউব খানের আপোষ প্রস্তাব, নানা কুচক্র এবং প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক হুমকি সত্বেও জনাব এ বিল উত্থাপন হতে বিরত থাকেন নি। আইউব বিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বিশ^ মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অপার বন্ধনে আব্বাস আলী খান ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ১৯৭৫ সালে হজব্রত পালন করা ছাড়াও ১৯৭৮ সালে ওমরাহ পালন করেন। এ সময় তিনি পবিত্র রিয়াদ, দাহরান, জেদ্দা, তায়েফ প্রভৃতি শহরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের সাথে সাক্ষাৎ করেন ও বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দেন। এ বছরই তিনি কুয়েত সফর করেন। ১৯৭৯ সালে IIFSO-এর আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি মালয়েশিয়া ও সিংগাপুর সফর করেন। FOSIS-এর আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ড সফর করেন। তিনি ১৯৮৯ সালে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার আহবানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বৃটেন ও ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভাষন দেন এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন দেশের ইসলামী দেশের নেতৃবৃন্দের সাথে সংলাপে অংশ নেন।
আব্বাস আলী খানের ভাষা জ্ঞান কেমন ছিলো তা বোঝা যায় তার রচিত ও অনুদিত সাহিত্য পাঠে। ‘‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস’’ নামক ইতিহাসের এ বই তার এক আমর কীর্তি। তাঁর আত্ম জীবনী স্মৃতি সাগরের ঢেউ যেন আপনাকে সাহিত্যের এক নবতর শাখায় ঢেউ খেলাবে। বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব্যব্যাপী ইসলামী পূনর্জাগরণ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাওলানা মওদূদীর জীবনী ‘‘একটি জীবন একটি ইতিহাস’’ মাওলনাকে জানার দিগন্ত উম্মোচন করেছে। তার রচিত ও অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা আমাদেরকে ইতিহাসের অন্য এক ভূবনে প্রবেশ করার সূযোগ করে দিয়েছে।

জনাব আব্বাস আলী খানের রচিত গ্রন্থাবলী
১. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস
২. স্মৃতি সাগরের ঢেউ
৩.মাওলানা মওদূদী : একটি জীবন একটি ইতিহাস
৪.জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস
৫. মৃত্যু যবনিকার ওপারে
৬. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙিক্ষত মান
৭. জামায়াতে ইসলামীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
৮. আলেমে দ্বীন মাওলানা মওদূদী
৯. মাওলানা মওদূদীর বহুমুখী অবদান
১০. ঈমানের দাবী
১১. ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব
১২. একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
১৩. ইসলামী বিপ্লব একটি পরিপূর্ণ নৈতিক বিপ্লব
১৪. সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক
১৫. MUSLIM UMMAH
১৬.বিদেশে পঞ্চাশ দিন
১৭.যুক্তরাজ্যে একুশ দিন
১৮.বিশ্বের মনীষীদের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদূদী
১৯.ইসলামী আন্দোলন ও তার দাবী
২০.দেশের বাইরে কিছুদিন

জনাব আব্বাস আলী খানের অনূদিত গ্রন্থাবলী
১. সীরাতে সরওয়ারে আলম (২-৫খণ্ড)
২. সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং
৩. বিকালের আসর
৪. ইসলাম ও সামাজি সুবিচার
৫. পর্দা ও ইসলাম
৬. আদর্শ মানব
৭. জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি
৮. ইসরা ও মিরাজের মর্মকথা
৯. মুসলমানদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মসূচী
১০. একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার
১১. পর্দার বিধান
১২. ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ
১৩. আসান ফেকাহ-১ম খণ্ড
১৪. আসান ফেকাহ-২য় খণ্ড
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার এই মর্দে মুমিনকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন-আমীন

পঠিত : ৪৪৭ বার

মন্তব্য: ০