Alapon

মোসাদ এবং মিশাল



২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, বৃহষ্পতিবার।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রধান ও আধ্যাতিক নেতা শায়খ আহমদ ইয়াসিন ইসরাইলী কারাগারে বন্দী। বন্দী থাকলে কি হবে, হামাসের যাত্রা থেমে নেই। ফিলিস্তিনি জনতার পক্ষে তারা কাজ করেই যাচ্ছে।
ইসরাইল ও জর্ডান প্রতিবেশি দেশ। দুই দেশকে বিভক্ত রেখেছে জর্ডান নদী। জর্ডানের বাদশাহ তখন আবুল হুসাইন। হামাস ও জর্ডান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি চলমান। এ চুক্তির কারনেই হামাস তাঁদের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান অফিস খুলেছে রাজধানী আম্মানে।
জর্ডানে তখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। একটি কালো জীপে করে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান খালিদ মিশাল তাঁর তিন সন্তান ওয়ালিদ,ওমর ও বিলাল সহ অফিসের দিকে যাত্রা করলেন। গাড়ী ড্রাইভ করছেন আবু মাহের। আবু মাহের খালেদ মিশালের ড্রাইভার ও নিরাপত্তারক্ষী। সন্তানদের সাথে নেয়ার উদ্দেশ্য ছিল মিশালকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে আবু মাহের তাদের সেলুনে নিয়ে যাবে।
যাত্রা পথে আবু মাহের লক্ষ্য করলেন একটি গাড়ি তাদের পিছনে আসছে। তিনি এটিকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে নিলেন এবং কাউকে কিছু জানালেন না। কিন্ত মাহেরের অনুমান সেদিন ভুল ছিল, পিছনের গাড়ী কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয় বরং সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলের একটি নোংরা খেলার অংশ। এই খেলার পরিকল্পনা অনুযায়ি কোন এক হামাস নেতাকে খুন করবে ইসরাইল।
ইরাইলের প্রধানমন্ত্রী তখন বেনজামিন নেতানিয়াহু আর গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রাধান জেনারেল ড্যানি ইয়াতোম। স্টেডিয়ামের মত টাক মাথা ওয়ালা ড্যানি ইয়াতোমের মুখে নাকি সবসময় হাসি লেগে থাকে। ঠান্ডা মাথার খুনী। দীর্ঘদিনের সামরিক ক্যারিয়ার আছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের সামরিক সচিবও ছিলেন তিনি। রবিনের মৃত্যুর পর তাকে মোসাদের প্রধান করা হয়। মূলত মৃত রবিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্দেশ্যেই ছিল এই নিয়োগ।
৯৭ এর আগস্টে নেতানিয়াহু আর ড্যানি ইয়াতোম মোসাদ সদর দপ্তরে জরুরি বৈঠক করেন। উদ্দেশ্য কোন হামাস নেতাকে হত্যা করা যায়। মোস্ট ওয়ানটেড হামাস নেতাদের তালিকা তখনও মোসাদের কাছে ছিল না। দৃশ্যমান হামাস নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ মুসা মোহাম্মদ আবু মারজুক। কিন্ত তিনি একই সাথে মার্কিন নাগরিক ছিলেন। আমেরিকায় পড়াশোনা ও চাকরি করেছেন। তাঁকে হত্যা করলে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। কাজেই টার্গেট ঘুরে গেল। এবার মোসাদ টার্গেট করল হামাসের আরেক পরিচিত নেতা খালিদ মিশালকে। ৪৫ বছর বয়সী খালেদ মিশাল হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান। পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান অফিস জর্ডানের রাজধানী আম্মানে। অর্থাৎ খালিদ মিশালের অফিস আম্মানে। তাঁকে হত্যা করতে হলে সেখানেই করতে হবে। কিন্ত একটা সমস্যা আছে। ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সাথে ইসরাইলের শান্তি চুক্তি হয়েছে। কাজেই নেতানিয়াহু আদেশ দিল হত্যা করতে হবে নিরবে, লোকচোক্ষুর অন্তরালে।
গোপন মিশনের প্রস্তুতি শুরু করল মোসাদ। মোসাদের এক কেমিস্ট এমন এক প্রকার বিষ তৈরি করল যার কয়েক ফোটা ভিক্টিমের শরীরে পড়লে ধীরে ধীরে সে নীরব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। ময়না তদন্তে এই বিষ প্রয়োগের কোন প্রমান পাওয়া যাবে না। এছাড়াও এই বিষের এন্টিডোট ইসরাইল ছাড়া দুনিয়ার অন্য কারো কাছেই নেই। ইসরাইলেই তৈরি বলে বিষের ফর্মুলাও অন্যদের কাছে নেই।
ড্যানি ইয়াতোম এই অপারেশনের দায়িত্ব দেন মোসাদের কিডন গ্রুপকে। কিডোন শব্দটি হিব্রু, বেয়নেটের সমার্থক শব্দ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরাইলের খুনের মিশন এই গ্রুপটি বাস্তবায়ন করে থাকে। আন্তর্জাতিক আইনে এই ধরনের কর্মকান্ড নিসিদ্ধ হলেও ইসরাইল দ্বিধাহীন ভাবে এই অপকর্ম করেই যাচ্ছে। ইতিপূর্বে কিডন গ্রুপ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা করেছে।
ভূয়া কানাডিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে কিডন গ্রুপের আট জন খুনি আম্মানে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে ডাক্তার একজন। হিটম্যান ২ জন। নাম যথাক্রমে জন কেনডাল ও ব্যারি বেডস। অপারেশনের মূল দায়িত্ব এদের। ৬ সপ্তাহ ধরে তারা খুনের প্রস্ততি নিতে থাকে। তারা ৪ জন করে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়। হিটম্যান দুজন থাকে প্রথম গ্রুপে, ব্যাকাপ হিসেবে থাকে দ্বিতীয় গ্রুপ। ডাক্তারের অবস্থান এই দ্বিতীয় গ্রুপেই।
সেদিন অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর আবু মাহের যে গাড়ি দেখেছিল তা এই দ্বিতীয় গ্রুপেরই। অর্থাৎ অপারেশন শুরু হয়ে গেছে।
আবু মাহের অফিসের সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন। খালিদ মাশালের চোখে পড়ল অফিসের পিলারের কাছে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেরই চোখে সানগ্লাস। একজনের হাত ব্যান্ডেজ করা। মিশাল তাদের এরকম অবস্থানকে সন্দেহ করলেন, আবু মাহেরকে বললেন, কিন্ত নিশ্চিত হতে পারলেন না। মিশাল পরবর্তীতে আল জাজিরাকে একটি সাক্ষাটকারে বলেছিলেন, “যদি আবু মাহের আগে গাড়ির ব্যাপারটা বলত তাহলে হয়তো আমি আরো নিশ্চিত হতে পারতাম। হয়তোবা আমি দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করতাম। কিন্ত এটা ছিল মহান রব্বুল আ’লামিনের ইচ্ছা।“
আল জাজিরার সেই সাক্ষাৎকারে আবু মাহের বলেন, “আমরা গাড়ি থেকে নেমে হাটা শুরু করলাম। আমি মিশালের পিছনে সতর্ক অবস্থায় ছিলাম, কারন তাদের সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল মাত্র, খারাপ কিছু মনে করে নয়। আমরা যখন দরজার কাছে গেলাম তখন তাদের একজন আমাদের কাছে এল। সে মিশালের কাছে গিয়ে হাত তুলল। আমি দ্রুত তার বাহুতে আঘাত করলাম। তার হাতে এমন ভাবে ব্যান্ডেজ করা ছিল যেন সে আহত।আসলে সেখানে স্প্রেইং ডিভাইস লুকানো ছিল।“
মাহের খুনির হাতে আঘাত করলেও দক্ষ স্পাই ততক্ষনে কাজ শেষ করেছে। কিন্ত মাহের আর মিশালের বাচ্চারাতো দূরের কথা স্বয়ং মিশালও সেটা তখনো বুঝতে পারেন নি। মিশাল বলেন যে তিনি শুধু ইলেকট্রিক শকের মত কিছু একটা অনুভব করেন যা তার দেহে একটা কাপুনি তৈরি করেছিল। আসলে তিনি তখনো মূল ঘটনা ধরতে পারেন নি। তিনি ভাবেন যে এটা একটা হত্যা চেষ্টা মাত্র,স্পাইরা সফল হয় নি। কারন তারা কোন বুলেট ছুড়তে পারেনি। আর তাছাড়া তিনি তখনো সুস্থ ছিলেন।
আবু মাহের যখন মিশালের নিরাপত্তায় ব্যস্ত তখন মোসাদের স্পাইরা পালানোর উদ্দেশ্যে দৌড় দেয়। কিন্ত ঠিক সে সময়ই মোহাম্মদ আবু সাইফ নামের এক হামাস সদস্য আফিসে আসেন। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর যেতেই তিনি ঘটনা দেখতে পান এবং স্পাইদের পিছু নেন।
আবু সাইফ আল জাজিরাকে বলেন, “১০০ মিটার দূরে তাদের জন্য ড্রাইভার সহ একটি কার অপেক্ষা করছিল। তারা দ্রুত গাড়িতে চড়ে এবং সাথে সাথেই যাত্রা শুরু করে। আমার গাড়ি তখন দূরে পার্ক করা ছিল। তাই আমি হাতে গাড়িটির নাম্বার লিখে নিই। নাম্বারটি ৫৩৭৪ এবং সেটি ছিল একটি সবুজ হুন্দাই। তখন আমি রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটি গাড়িকে থামাই এবং উঠে পড়ি। ড্রাইভারকে গাড়িটিকে ফলো করতে বলি। ড্রাইভার তখনো জানে না কি ঘটেছে।“
ওদিকে হুন্দাইয়ে থাকা মোসাদ এজেন্টরা তখনো জানে না আবু সাইফ তাদের পিছু নিয়েছে। ব্যান্ডেজওয়ালা খুনি তার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে। তারা একটি মসজিদের সামনে গাড়ি থেকে নামে। গাড়িটি চলে যায়। আবু সাইফও একই স্থানে নামে।
যদি স্পাইরা জানতো সাইফ তাদের পিছু নিয়েছে তাহলে হয়তো তারা নামতো না। সাইফ ভাবে তারা অন্য একটি গাড়িতে উঠবে। কিন্ত না, তারা রাস্তা পার হওয়া শুরু করে, ঠিক এ সময় সাইফকে দেখে ফেলে।
সাইফ যখন দেখে তাদের হাতে ব্যান্ডেজ নেই তখন বুঝে ফেলে তারা যে অস্ত্র দিয়ে আক্রমন করেছিল তা গাড়িতে রেখে দিয়েছে। সে পিছু ছাড়ে না। রাস্তার পাশের একটি জমিতে সাইফের সাথে দুই খুনির ধস্তাধস্তি শুরু হয়। জমিটিতে একটি ছোট নালা ছিল। সাইফ ভাবে একজনকে নালায় ফেলে দিয়ে অপরজনকে ধরবে। কিন্ত সে তা করতে পারে নি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, “প্রথমজনের হাতে একটি ধারালো বস্তু এবং অন্য জনের হাতে একটি ভারী এবং খাজকাটা শিলা ছিল। তারা আমাকে মেরে ফেলার জন্য শিলাটি দ্বারা আমার মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করে, কিন্ত আমি আঘাত এড়ানোর জন্য ডানে বামে মাথা নাড়াতে থাকি। সে আমার কাধে আঘাত করে।“
ইতোমধ্যে মারামাড়ি দেখে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। সাইফ শুধু দেখতে পায় একজন তাদের দিকে আসছে। সে ছিল সাদ আল খাতিব। সাদ প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মির একজন অফিসার। সে ট্যাক্সি করে ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল।
সাদ আল জাজিরাকে বলে, “আমি টেক্সি থেকে বেড়িয়ে এলাম। দেখলাম দুজন বিদেশী একজন আরবের সাথে মারামারি করছে। আমি দ্রুত সেখানে গেলাম। আমি শুনলাম আরব লোকটি চিৎকার করে বলছে তারা মোসাদ এজেন্ট এবং তারা খালিদ মিশালকে হত্যা করেছে।“
সাদ সেখানে নিজের পরিচয় দেয় এবং সাইফ তাকে খুনীদের গ্রেফতার করতে বলে। সাইফ এবং সাদ মিলে খুনী দুজনকে গাড়িতে তোলে এবং ওয়াদি আল সীর নামক পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যায়। গাড়িতে বসে সাইফ মিশালের অফিসে ফোন করে জানায় সে এজেন্ট দুজনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে।
এদিকে মিশাল তখনো বিষক্রিয়া অনুভব করে নি। কারন আগেই বলেছি বিষটি ধীরে ধীরে কাজ করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। একনজন হামাস সদস্যের সাথে যে স্পাই দুজনের রীতিমত যুদ্ধ হচ্ছে তাও তখন পর্যন্ত তারা জানতে পারে নি। আসলে সেদিন একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে আবু সাইফ ঘটনাস্থলে যায়। খালিদ মিশাল ঘটনাস্থল থেকে ফিরে যায় মোহাম্মদ আবু নাজাল নামের হামাস পলিটিক্যাল ব্যুরোর এক সদস্যের বাসায় যায়। সেখান থেকেই একটি জরুরি মিটিং ডাকে। ব্যুরো সদস্যরা নাজালের বাড়িতে একত্রিত হয়।


সেখানে মিশাল জানায় তার উপর হত্যা চেষ্টা হয়েছে মাত্র, কোন বুলেট ছুড়তে পারে নি, কোন বিষ্ফোরনও ঘটে নি। আবু নাজাল ভাবে হত্য চেষ্টা হয়ে থাকলে তা বানচাল হল কিভাবে! আসলে তখনো তারা বুঝতে পারে নি খুনিরা বিষপ্রয়োগ করেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছে। যা হোক, ব্যুরো সদদ্যরা একমত হয় যে ঘটনাটা মিডিয়াতে জানাতে হবে। আবু নাজাল বক্তব্য অনুযায়ী তাদের ধারনা, আসলে কি ঘটেছিল তা জানার জন্য শুধু মিডিয়াই সহায়ক হতে পারে। অন্যথায় ঘটনাটি চাপা পড়ে যাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবু নাজাল আম্মানস্থ AFP এর চীফ রান্দা হাবীবকে ফোন করে হত্যা চেষ্টার ঘটনা জানায়।
সকাল ১১টার দিকে এএফপি হত্যাচেষ্টার নিউজ প্রচার করে। কিন্ত জর্ডানের প্রসাশন ঘটনাটিকে অস্বীকার করে। এর কারন প্রথমত হত্যা চেষ্টার কোন প্রমান তখনো নেই। কোন ধরনের বিষ্ফোরন না ঘটায় এধরনের সন্দেহ সবাই করেছিল। এমনকি এএফপি চীফ রান্দা হাবীবও এই সন্দেহ করেন। কিন্ত তবুও তিনি নিজউ পাবলিশ করেন। দ্বিতীয় কারন এরকম ঘটনার ফলাফল খুবই মারাত্বক। কারন তখন জর্ডান আর ইসরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তি ছিল। এ ধরনের অপারেশন চুক্তি ভঙ্গের জন্য যথেষ্ট।
এ সময় রান্দা হাবীব কানাডিয়ান দূতাবাসে ফোন করে পুলিশ স্টেশনে থাকা স্পাই দুজন সম্পর্কে জানতে চায়। কারন তারা কানাডার পাসপোর্টধারী। কিন্ত দূতাবাস থেকে জানানো হয়, তারা পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিল কিন্ত আক্রমনকারীরা দূতাবাসের লোকদের সাথে কথা বলতে চায় নি। এ থেকে রান্দা হাবীব বুঝে ফেলেন যে আক্রমনকারীরা আসলে কানাডিয়ান নয়। কিন্ত তারা ইসরাইলী কি না তা নিয়ে হাবীবের তখনো সন্দেহ ছিল।
সে সময় পুলিশ স্টেশন থেকে খুনি দুজনকে মাত্র একবার ফোন করার সুযোগ দেয়া হয়। তার ফোন করে ইউরোপে তাদের অপারেশনাল হেড কোয়ার্টারে। এভাবেই মোসাদ প্রধান বুঝে ফেলেন মিশালকে বিষ প্রয়োগ করলেও তাদের অপারেশন ব্যার্থ হয়েছে। কারন স্পাই দুজন পুলিশের হাতে পড়ায় ঘটনা আর নীরব থাকে নি, প্রচার হয়ে গেছে। ড্যানি ইয়াতোম জর্ডানে থাকা বাকি স্পাইদের ইসরাইলী দূতাবাসে শরনার্থী হিসেবে ঢোকার নির্দেশ দেন।
এদিকে ঘন্টাখানেক পরে মিশাল তার উপর প্রয়োগকৃত বিষের ক্রিয়া বুঝতে শুরু করেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “……আমি আমার চারপাশের সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি কিন্ত আমার পূর্ণ চেতনা ছিল না।”
মিশালের অবস্থা অবনতির দিকে যেতে শুরু করলে তাঁকে আম্মানের ইসলামী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ইসলামী হাসপাতালটি জর্ডানের ইখওয়ানুল মুসলিমুন দ্বারা পরিচালিত। মূলত নিরাপত্তার জন্যই মিশালকে এ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
কিন্ত ডাক্তাররা অসুস্থতার কারন নির্ণয়ে ব্যার্থ হন। কারন আগেই বলেছি স্পেশাল বিষটি এক নীরব ঘাতক। কোন প্রমান রাখে না। আর মোসাদ ছাড়া দুনিয়ার কেউ বিষটি সম্পর্কে জানেও না। এসময় অসুস্থ মিশালের একটি ছবি প্রকাশ পায়। তখন কারো সন্দেহ থাকে যে আসলেই আম্মানে খালিদ মিশালের উপর মোসাদ আক্রমন চালিয়েছে।
তবে মোসাদ যেহেতু ব্যার্থতার কথা আগেই জানতে পারে তাই বাদশাহ হুসেইন ঘটনা জানার আগেই উদ্দীগ্ন নেতানিয়াহু সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য ড্যানি ইয়াতোমকে আম্মানে পাঠায় দুই দেশের ডিপ্লোমেটিক রিলেশন ঠিক রাখার জন্য।
ড্যানি আম্মানে এসে বাদশাহ হুসাইনকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে আসলে অপারেশন জর্ডানের বিরুদ্ধে নয় বরং হামাসের বিরুদ্ধে! কিন্ত বাদশাহ হুসাইন তাঁর অগোচরে তারই মাটিতে কোন অপারেশন হবে এটা মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। আর ড্যানির যুক্তি যে দূর্বল তাও কারো বুঝতে বাকি থাকে না। কারন খালিদ মিশাল শুধু হামাসের পলিটিক্যাল ব্যুরো চীফ নন তিনি জর্ডানেরও নাগরিক। তিনি সেনাবাহিনীকে দূতাবাস থেকে অবশিষ্ট স্পাইদের গ্রেফতাররের নির্দেশ দেন এবং হুমকি দেন যদি খালিদ মিশাল মারা যায় তাহলে শান্তি চুক্তি ভেস্তে যাবে। কাজেই বিষের এন্টিডোট সরবরাহ করাই একমাত্র উপায়। নেতানিয়াহু জানত এটা দিতে হবে, মূলত এন্টিডোট দেয়ার জন্যই ড্যানির আম্মানে আগমন!
খালিদ মিশালের অবস্থা আরো অবনতি হলে হুসাইন তাঁকে রাজকীয় হাসপাতালে ভর্তির নির্দেশ দেয় একই সাথে বাদশাহর ব্যাক্তিগত চিকিৎসকসকদের মিশালের সুস্থতার জন্য নিয়োগ করা হয়। এসময় বাদশাহর প্রধান চিকিৎসক ইসরাইল থেকে বিষের ফর্মুলা দাবি করার পরামর্শ দেয়। বাদশাহ হুসাইন নেতানিয়াহুকে ফোন করে ফর্মুলা সহ এন্টিডোট দাবি করে। কিন্ত নেতানিয়াহু ফর্মুলা দিতে অস্বীকার করে। হুসাইন তখন ফোন করে আমেরিকায়, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের কাছে। আসলে নেতানিয়াহুর উগ্রতার জন্য সবাই ক্ষুব্ধ ছিল। বিল ক্লিনটনও জর্ডানের মাটিতে এই অপারেশন সহজ ভাবে নেয় নি। ক্লিনটন নেতানিয়াহুকে ফোন করে ফর্মুলা দেয়ার জন্য। বাধ্য হয়ে ইসরাইল ফর্মুলা সহ এন্টিডোট সরবরাহ করে। এন্টিডোট প্রয়োগ করায় খালিদ মিশাল সুস্থ হয়ে ওঠে।
খালিদ মিশাল সুস্থ হলেও ঘটনা তখনো বাকি। জর্ডানের হাতে তখন মোসাদের দুই জন স্পাই বন্দী। হামলা হওয়ায় হামাস সদস্যরাও ক্ষুব্ধ। অপারেশন জর্ডানের মাটিতে হওয়ায় হুসাইনও ক্ষিপ্ত। কাজেই ইসরাইলকে শায়েস্তা করতে না পারলে বেশ বড় কয়েকটি বিশৃঙ্খলা তৈরি হবেই। বাদশাহ এখানে রাজনৈতিক খেলা খেললেন ইসরাইলের সাথে।
বন্দী বিনিময় হবে। বাদশাহ দাবী করলেন আট জন বন্দীর বিনিময়ে ইসরাইলকে হামাসের প্রধান আধ্যাতিক নেতা শায়খ আহমদ ইয়াসিন সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসরাইলী কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনী বন্দীর মুক্তি দাবি করেন। ৩০ শে সেপ্টেম্বর বাদশাহ হুসাইন জনতার সামনে এ নিয়ে এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন।
ইসরাইলের কাছে দুই স্পাইইয়ের জীবন যে কোন কিছুর চেয়ে মূল্যবান ছিল। তাই তারা দাবী মেনে নিয়ে ৩১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ তারিখে শায়খ আহমদ ইয়াসিন সহ ৪০ জন ফিলিস্তিনীকে মুক্তি দেয়।
৫ অক্টোবর, ১৯৯৭ তারিখে নেতানিয়াহু নেতৃত্বাধীন সরকার একটি প্রেস রিলিজ ইস্যু করে। যেখানে প্রথমবারের মত খালিদ মিশাল হত্যার প্রচেষ্টা স্বীকার করা হয়। মিশনের পুরস্কার হিসেবে পরবর্তীতে জেনারেল ড্যানি ইয়াতোমকে মোসাদ প্রধানের পদ থেকে বাধ্যতামূলক ভাবে পদত্যাগ করানো হয়!
ইসরাইলী সরকারের প্রেস রিলিজের পরের দিন ০৬ অক্টোবর, ১৯৯৭ তারিখে আম্মান থেকে দুটি হেলিকাপ্টার উড়ে যায়। একটিতে দুই এজেন্ট তেলাবিবে যায় অন্যটিতে শায়খ আহমদ ইয়াসীন গাজায় ফিরে যান। হামাসের আন্দোলন এতে নতুন গতি লাভ করে।

তথ্যসূত্রঃ
১. মোসাদ/ কায়কোবাদ মিলন
২. হামাস/ আলী আহমাদ মাবরুর
৩. https://www.youtube.com/watch?v=29DCoAFvQt8


#al_chemy_ii

পঠিত : ১০৭১ বার

মন্তব্য: ০