Alapon

গ্রানাডা পতনের ইতিহাস এবং কিছু কথা...



আপনাদের মনে আছে, গ্রানাডার পতন কত খ্রিস্টাব্দের হয়েছিল? —১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে। আর কলম্বাস কত সালে আমেরিকা আবিস্কার করেছিল? —এই ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দেই! এ বছরই ক্রিস্টফার কলম্বাস স্পেন থেকে সমুদ্র অভিযাত্রা করে এবং আমেরিকা আবিস্কার করে। একই বছর গ্রানাডার পতন এবং আমেরিকা আবিস্কার কি কাকতালীয় ঘটনা?
.
বেশ আগ্রহোদ্দীপক বিষয়! যে বছর গ্রানাডার পতন হল, সে বছরই কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করে ফেলল! এটা কী কাকতালীয়? আমার মতে, এটি একেবারেই কাকতালীয় নয়। আমি আন্দালুসের ইতিহাস পড়েছি কিন্তু আন্দালুসের পতনের সাথে আমেরিকা আবিস্কারের সরাসরি সম্পর্ক আছে, এ বিষয়টি কখনোই আমার মাথায় কাজ করেনি। আমি এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। জানলাম কখন? আন্দালুস সফরে গিয়ে। আমি গ্রানাডায় আছি তখন। ‘ট্যুর গাইড’ আমাকে আল-হামরা প্রাসাদের বিভিন্ন অংশ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন, ইতিহাস বলছেন। প্রাসাদের উদ্যানে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তি! ‘ট্যুর গাইড’ আমাকে জানালো— ‘কলম্বাসের এ মূর্তিটা ঠিক সেখানেই দাঁড় করানো হয়েছে, যেখানে সে দাড়িয়েছিল গ্রানাডার পতনমূহুর্তে। যখন ফার্দিনান্দ ও ইজাবেলার কাছে গ্রানাডার সুলতান আবু আব্দুল্লাহ আত্মসমর্পন করছিলেন, শহরের চাবি তাঁদের কাছে হস্তান্তর করছিলেন, তখন ক্রিস্টোফার কলম্বাস এখানে দাঁড়িয়ে ছিল।’
.
তাঁর কাছে এটা জেনে আমি অবাক হয়ে গেলাম! কি বলছে সে? গ্রানাডায় মুসলিম শাসনের সেই পতনমুহুর্তে কলম্বাস এখানে ছিল, ঐ ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দেই? আমি ইতিহাসের দুটো ঘটনা—গ্রানাডার পতন এবং আমেরিকা আবিস্কারের সংযোগ খুজতে আগ্রহ বোধ করলাম। ‘ট্যুর গাইড’কে জিজ্ঞেস করলাম—
‘কলম্বাস এখানে কি করছিল?’
সে জানালো—
‘কলম্বাস দুনিয়া সফরের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের ফান্ডিং-এর জন্য ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের পিছু পিছু অনেক দিন ধরেই ঘুরছিল। যেখানে যুদ্ধ হত, ইসাবেলা-ফার্দিনান্দ সেখানেই হাজজহাজির থাকত অর্থপ্রাপ্তির আশায়। সে গ্রানাডায়ও এসেছিল তাঁদের পিছু পিছু। গ্রানাডা বিজয়ের পর ইসাবেলা-ফার্দিনান্দ মুসলিমদের বিপুল অর্থ-সম্পদের দখল পায়। সেখান হতে তাঁরা কলম্বাসকে ফান্ডিং করে। এর আগে কলম্বাসের দুনিয়া সফর প্রকল্পের মত এত উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে ফান্ডিং-এ তাঁরা রাজি ছিল না কারণ তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতো ভালো ছিল না যে তাঁরা এমন বৃহৎ উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে ফান্ডিং করতে পারত।’
.
তাঁর এ বর্ণনা শুনে আমি অবাক ও বিস্মিত হলাম। আমার মন-মস্তিষ্ক চারদিকে ঘুরছিল তখন! আমি তাঁকে আরও জিজ্ঞেস করলাম—
‘তুমি আমাকে কলম্বাসের সাথে সম্পর্কিত আরও কোনো দর্শনীয় স্থান দেখাতে পারো?’
সে আমাকে একটি শহরের কথা বলল।
‘লারাবিদা শহর। এখান থেকে এক ঘন্টার পথ। এই লারাবিদা শহরে ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছয় মাস অবস্থান করেছিলেন। তাঁর ডেস্ক, চেয়ার-টেবিল—সব এখনো সংরক্ষিত আছে।’
আমরা ভাড়া গাড়িতে করে সেখানে গেলাম। দেখলাম, এটি এখন একপ্রকার গ্রাম, বড়জোর একশ লোকের বাস এখন। আমরা দর্শনীয় সেই স্থান খুজে বের করলাম। মনে হল, এখানে খুব বেশি পর্যটক আসেন না। খালি, শুনশান এলাকা। আমরা দেখলাম একজন বৃদ্ধা মহিলা টিকেট বিক্রি করছেন। সে আমাকে দেখে খুব আগ্রহের সাথে কথা বলতে লাগল। সাবলিল স্প্যানিশ ভাষায় এবং আকারে ইঙ্গিতে কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করছিল। আমি তাঁকে বুঝানোরে চেষ্টা করলাম,
‘আমি আমেরিকার টেক্সাস থেকে এসেছি, স্প্যানিশ ভাল পারিনা।’
পরে সে ভাঙা স্প্যানিশ ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আমাকে জিজ্ঞেস করল—
‘আপনি কি মুসলিম?’
আমি বললাম—
‘হ্যা। আমি মুসলিম।’
সে এবার আরও বেশি আগ্রহী। আরও এক্সাইটেড, আমাকে কিছু দেখাতে চায় সে। এভাবে সে একরকম আমার ট্যুর গাইড হয়ে গেল। নিজের অফিস ছেড়ে সে আমাকে একটা স্থাপনার ভিতরে নিয়ে গেল, যার ভিতরে বসে বসে কলম্বাস তাঁর দুনিয়া সফরের পরিকল্পনা করেছে। সে আমাকে দেখাতে লাগল, আর বলতে লাগল—
‘এটা মুসলিম শাসনামলে মসজিদ ছিল, ওরা এটাকে ওরা চার্চ বানায় পরে। এই যে দেখুন মিহরাব, মিম্বার!’
এরপর সে চার্চের বাহিরে উপরের অংশ দেখিয়ে বলল—
‘এখানে মসজিদের মিনার ছিল। এটা কেটে খ্রিস্টানেরা ক্রুশ বসিয়েছে। দেখেছেন? চিনতে পেরেছেন, এটা যে মিনার ছিল?’
.
যাহোক, বৃদ্ধা মহিলার বর্ণনা আমাকে স্তদ্ধ করে দিল। আমার মন-মস্তিষ্ক বিস্ফোরিত হতে লাগল! ক্রিস্টোফার কলম্বাস একটা মসজিদে বসে আমেরিকা আবিস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন। আমরা তাঁকে মসজিদে বাস করার জন্য দোষারোপ করছিনা, হতে পারে গ্রানাডা কয়েকশ মাইল দূরে এসে কারো কাছে জিজ্ঞেস করেনি কোন দিকে গেলে কোথায় যাওয়া যাবে। কারণ, সবাই বুঝে যাবে— ‘এ লোক এখানে নতুন। এর সব মালামাল ছিনিয়ে নেয়া যাক!’ ফলে সে নিজেই পথচেনা মুসাফিরের ভাব নিয়ে এখানে অবস্থান করে, ঠিক করে সে কোন পথে, কিভাবে দুনিয়ার নতুন নতুন স্থান আবিস্কার করবে। কারণ, সেকালে ঐ পরিস্থিতিতে নতুন কোনো স্থানের পরিচয় কারো কাছে জিজ্ঞেস করার চেয়ে সেটাকে ‘ইন্ডিয়া’ মনে করে পরিচিত ভাব ধরে থাকা নিরাপদ! যাহোক, সে লারাবিদা শহরের এই মসজিদে ছয় মাস অবস্থান করেছে।
.
আচ্ছা, ‘লারাবিদা’ শব্দটি স্প্যানিশ। এটার আরবি কি জানেন? আমি চিন্তা করে বের করলাম, এর আরবি হল ‘আর-রাবিতাহ’। এ শহর ছিল আসলে 'মাদিনাতুর-রাবিতাহ'। সুবহানাল্লাহ! আমার মন-মস্তিষ্ক আমাকে দারুনভাবে আন্দোলিত করছিল, আমি নতুন অনেক কিছু জানছিলাম। ইতিহাসের এক ঘটনার সাথে আরেক ঘটনার সাথে সংযোগ বুঝতে পারছিলাম।
.
সুতরাং, ১৪৯২ সালে আন্দালুসের পতন এবং কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিস্কার—এ দুটি ঘটনা মোটেও কাকতালীয় ঘটনা নয়। আন্দালুসের সাথে আমেরিকা আবিস্কারের সরাসরি কার্যকারণগত সম্পর্ক আছে। আন্দালুস না থাকলে আমেরিকা আবিস্কার হয়তো হতোনা। আমরা এখানে থাকতাম না, এ দেশই হয়ত দুনিয়ার মানুষ চিনত না! আমেরিকা না থাকলে পৃথিবী আরও ভালো থাকত কিনা—সে বিতর্কে নিয়ে আমি আপনাদের ইতিহাস পাথের গুরুত্ব বুঝাতে চাচ্ছি। যাতে আপনি মুসলিম হিসেবে, নিজের সাথে ইতিহাস এবং ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার সাথে বিভিন্ন আন্তঃসংযোগ আবিস্কার করেন। যাতে বুঝতে পারেন, আমরা মুসলিম উম্মাহ দুনিয়ার জন্য অনেক কিছু করেছি।
.
আমাদের গর্ব করার মত অনেক কিছু আছে। আবার এটাও সত্য, আমাদের এমন ইতিহাসও আছে, যা মোটেও গর্ব করার মত নয়। আমরা যদি নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে আন্দালুসের ইসলামী খিলাফতকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে পারতাম, তাহলে গোটা ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম ছড়িয়ে যেত। কিন্তু আমরা ক্ষমতা দখলের লড়াই করেছি, গৃহযুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অবিচার করেছি। এসব আমাদের পতন ত্বরান্বিত করেছে।
.
- খালিদ সাইফুল্লাহ

পঠিত : ৩০৮ বার

মন্তব্য: ০