Alapon

মহাভারতে বহুগামিতা



মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর পরিচয়, তিনি কুরুরাজ্য তথা হস্তিনাপুরের মহারানী ও রাজমাতা, কৌরব ও পাণ্ডবদের প্রপিতামহী (ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতামহী)! হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুকে বিয়ের আগেই অবশ্য সত্যবতীর আরেক পুত্র সন্তান ছিল- বেদব্যাস, বড়নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস (গায়ের রঙ কালো ছিল বলে কৃষ্ণ, যমুনা নদীর এক দ্বীপে জন্ম হয় বলে দ্বৈপায়ণ আর শাস্ত্রগ্রন্থ বেদ এর ব্যবহারিক-বিন্যাসকারী বলে বেদব্যাস), সংক্ষিপ্ত নাম শুধুই ব্যাস- যিনি পরবর্তীতে অনেক বিখ্যাত মুনি হন, তিনিই ছিলেন মহাকাব্য মহাভারতের মূল লেখক বা সংকলক।

এই বেদব্যাস এর জন্ম হয় কুমারী সত্যবতীর গর্ভে। যমুনা নদীতে একটি খেয়া নৌকার ভিতর পরাশর মুনি জেলেনি সত্যবতীর সাথে মিলিত হন। পরপারের ঋষিদের চোখে যাতে ধরা না পরে, পরাশর মুনি মিলনের পূর্বে চারদিক তমসাচ্ছন্ন করে দেন, সত্যবতী যখন বললেন, ‘আমি কুমারী, আমার কন্যাভাব দূষিত হয়ে গেলে কিভাবে গৃহে ফিরবো?’, তখন এই মিলনকর্ম করার পরেও যাতে সত্যবতী কুমারী থাকতে পারেন, ঋষি পরাশর সে ব্যবস্থা করে দিলেন (কিভাবে? যেভাবে মাতা মেরীও ভার্জিন ছিলেন, সেভাবে)! কিন্তু, তাতেও শেষরক্ষা হলো না, সত্যবতী গর্ভবতী হলেন- জন্ম হলো বেদব্যাসের।

যেহেতু সত্যবতী ছিলেন কুমারী, মানে অবিবাহিতা (প্রাচীণ সমস্ত সাহিত্যের “কুমারী” বা “ভার্জিন” এর অর্থ আমি ‘অবিবাহিত’ ধরি), ফলে বেদব্যাসের উপরে তার বা কারোরই অধিকার ছিল না, সত্যবতীর পক্ষেও তাকে মাতৃপরিচয়ে নিজের কাছে রেখে লালন পালন করা সম্ভব হয়নি। জন্মের পর পরই তাই বদরিকাশ্রমে চলে যান বেদব্যাস, সেখানেই কঠোর তপস্যার মাধ্যমে কালে অনেক বড় ঋষি হন!

এই ঋষি-মুনিরা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হতেন না, তবে বিভিন্ন নারীর সাথে মিলিত হতেন। সেসব নারীকে আধ্যাত্মিক বরের সাথে সাথে সন্তানও দান করতেন। হ্যাঁ, সম্প্রদান কারকের দান, মানে কোন রকম স্বত্ত্ব তাদের থাকতো না। বিবাহিত নারী হলে সমস্যা হতো না, কেননা রীতি বা পরম্পরা মোতাবেক, কিংবা শাস্ত্র মোতাবেক- স্বামী হচ্ছে স্ত্রীর মালিক, ফলে সেখানে (স্ত্রীগর্ভে) জন্ম নেয়া সন্তানেরও মালিক বা পিতা! পুরাণে আছে- কার বীজ এটা কোন বিষয় নয়, কার শস্যক্ষেত্র- সেটাই হচ্ছে মূল বিবেচ্য।

অর্থাৎ বীজের মালিক নয়, বরং শস্যক্ষেত্রের মালিকই হবে ফসলের মালিক তথা সন্তানের পিতা (“নশ্যতি বৈ ক্ষিপ্রং বীজং পরপরিগ্রহে”- পরস্ত্রীতে নিক্ষিপ্ত বীজও বীজী পুরুষটির নষ্ট হয়ে যায়, যেহেতু তা থেকে উৎপন্ন সন্তানটি হয় ক্ষেত্রস্বামীর- মনু সংহিতা, ৯/৪৩)। এখন, মুশকিল হচ্ছে বিয়ের আগে কুমারী নারীর যেহেতু স্বামী নেই, অর্থাৎ সেই শস্যক্ষেত্রের মালিক যেহেতু নেই- তার সন্তানের পিতার কোন পরিচয়ও নেই। ফলে, এমন সন্তানকে নিজের কাছে রাখা তো দূরের কথা, এমনকি সমাজে জানাজানি হলে সেই নারীর কপালে অনেক দুর্নাম জুটে।

যাহোক, মূল গল্পে ফেরা যাক! দুষ্মন্ত – শকুন্তলার পুত্র ভরত বহু রাজ্য জয় ও বহু যজ্ঞ করে সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী সম্রাট হয়েছিলেন, সেই ভরত রাজার বংশের এক রাজা ছিলেন হস্তী, তিনি হস্তিনাপুর নগরী স্থাপন করেন। রাজা হস্তীর চার পুরুষ পরে রাজা হন কুরু, তার নামানুসারেই বিশাল এক রাজ্যের নাম হয় কুরুরাজ্য, যার রাজধানী ছিল হস্তিনাপুর। কুরু রাজার অধস্তন সপ্তম পুরুষের নাম প্রতীপ, আর তার পুত্র হচ্ছে মহারাজা শান্তনু। মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর সাথে মহারাজা শান্তনুর বিবাহ হয়, তাদের দুই পুত্র সন্তান জন্ম নেয় – চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। মহারাজা শান্তনুর মৃত্যুর পরে তাদের জ্যেষ্ঠপুত্র চিত্রাঙ্গদ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন, কিন্তু দ্রুতই গন্ধবরাজের সাথে যুদ্ধে মারা যান।

ফলে, কনিষ্ঠপুত্র বিচিত্রবীর্যের রাজ্য অভিষেক হয়। রাজার জন্যে রানী দরকার, তাই সত্যবতীর সৎপুত্র দেবব্রত ভীষ্ম কাশীরাজের স্বয়ম্বর সভায় হাজির হন, কাশীরাজের দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে জয় করে নিয়ে আসেন (তাদের বড় বোন আম্বাকেও জয় করেছিলেন, কিন্তু আম্বা আরেক রাজের প্রণয় বন্ধনে আবদ্ধ থাকায়, তাকে ভীষ্ম সেই রাজের কাছে পাঠিয়ে দেন, সেই রাজা স্বয়ম্বর সভায় ভীষ্মের কাছে পরাজিত হওয়ার অপমানে আম্বাকে গ্রহণ করেন না, এতে আম্বা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ভীষ্মের উপরে প্রতিশোধ নিতে বদ্ধ পরিকর হন- সে আরেক গল্প)। দুই বোনের সাথে বিয়ে হয়ে যায় অভিষিক্ত রাজা বিচিত্রবীর্যের।

এখানে, সত্যবতীর সৎপুত্র দেবব্রত ভীষ্মের গল্পটিও একটুখানি বলে রাখি। তিনি ছিলেন মহারাজা শান্তনুর জ্যেষ্ঠপুত্র, শান্তনুর প্রথমা স্ত্রী গঙ্গাদেবীর গর্ভে তার জন্ম হয়। মহারাজা শান্তনু যখন গঙ্গাদেবীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, গঙ্গাদেবী শর্ত জুড়ে দেন- ‘রাজন! আমি আপনার মহিষী হবো, তবে আমি শুভ বা অশুভ যাই করি, আপনি যদি বারণ করেন বা ভর্ৎসনা করেন, কিংবা নিদেন কোন প্রশ্ন তুলেন, তবে নিশ্চয়ই আমি আপনাকে পরিত্যাগ করবো’! শান্তনু তাতেই রাজী হন। তাদের বিয়ে হলো!

এরপরে একে একে তাদের সাত সন্তান হলো- এবং প্রতিবারই গঙ্গাদেবী তার নিজ সন্তানকে গঙ্গাজলে ডুবিয়ে মারলেন। কিন্তু দুঃখে ভীষণ কাতর হওয়ার পরেও শান্তনু শর্তের কথা স্মরণ করে কিছুই বললেন না। অষ্টম পুত্র যখন জন্ম নিলো, মহারাজা শান্তনু আর নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না, গঙ্গাদেবীকে প্রশ্ন করলেন, ‘পুত্রঘাতিনী! তুমি কে? তুমি কেন এই মহাপাপ করছো?’ শর্ত ভঙ্গ করায় গঙ্গাদেবী বিদায় নিলেন, সাথে জানালেন তার প্রকৃত পরিচয় এবং সাত সন্তানকে জলে ডুবিয়ে দেয়ার কারণ (তারা আসলে সাত দেবতা ছিলেন, যারা মুনি বশিষ্ঠের শাপে মনুষ্য-নারীযোনীতে জন্ম নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

গঙ্গাদেবীকে দেখে অনুরোধ করেছিলেন, যেন তার গর্ভে তাদের জন্ম দেন এবং জন্মের সাথে সাথেই মেরে ফেলেন, যাতে দ্রুতই আবার স্বর্গে দেবতারূপে ফিরতে পারেন) এবং সাথে নিয়ে গেলেন জীবিত সন্তান দেবব্রতকে। দেবব্রতকে রাজনীতির পাঠ দিলেন মুনি বশিষ্ঠ, আর অস্ত্র-যুদ্ধবিদ্যা শিখালেন ঋষি পরশুরাম। তারপরে যুবা বয়সে গঙ্গাদেবী পুত্রকে তার পিতার নিকট ফেরত দিলেন। হস্তিনাপুর পেল সমস্ত দিক দিয়েই যোগ্য, অর্থাৎ প্রচণ্ড বলবান, রাজনীতি ও যুদ্ধবিদ্যায় ভীষণ পারদর্শী, ধর্মনিষ্ঠ – ন্যায়বান উত্তরাধিকারীকে।

মহারাজা মহানন্দে পুত্রকে যুবরাজ হিসেবে অভিষেক করালেন, এর অর্থ শান্তনুর পরে দেবব্রতই হবেন পরবর্তী মহারাজা। এরই মধ্যে রাজার প্রেম হয় মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর সাথে। শান্তনু সত্যবতীর পিতার কাছে যান বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু সত্যবতীর পিতা জুড়ে দিলেন এক শর্ত- সত্যবতীকে হতে হবে রাজমাতা। মহারাজা বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই তিনি হবেন মহারানী ও রাজমাতা। সত্যবতী বলেন, কিন্তু শান্তনুর পরে রাজা তো হবেন গঙ্গাপুত্র দেবব্রত। রাজা বলেন, তার জ্যেষ্ঠপুত্র দেবব্রত তো তারও পুত্র, তিনি হবেন দেবব্রত’র মাতা। সত্যবতী বললেন, তদুপরি সে তো সৎপুত্র। আপন পুত্র রাজা না হলে আর কিসের রাজমাতা! মহারাজা শান্তনু বললেন, তা কি করে সম্ভব? সত্যবতীও জানালেন, তাহলে এই বিয়েও সম্ভব নয়। রাজা ভঙ্গ হৃদয় নিয়ে ফিরে আসলেন, বেদনায় কাতর। পুত্র দেবব্রত পিতার এহেন অবস্থা দেখে হলেন বিচলিত।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, সত্যবতীর কথা। চলে গেলেন সত্যবতীর কাছে, পিতার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে অনুনয় করলেন। সত্যবতী তাকেও একই কথা বললেন, শুনে দেবব্রত পিতার সুখের কথা চিন্তা করে নিজের অধিকার ছেড়ে দিলেন। সত্যবতী বললেন, ‘তুমি রাজা না হলেও তোমার বংশধররা যখন রাজ্যাধিকার দাবি করবে, তখন আমার পুত্রের বংশধরদের কি হবে?’ দেবব্রত তখন কথা দিলেন, জীবনেও বিয়েশাদি করবেন না, মানে ব্রহ্মচর্য পালন করবেন এবং সত্যবতীর বংশধরদের জন্যে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনকে জীবন দিয়ে রক্ষা করবেন! এই কঠিন প্রতিজ্ঞার কারণে তার নাম হয় ভীষ্ম, পাণ্ডব ও কৌরবদের পিতামহ বলে, তাকে ডাকা হয় পিতামহ ভীষ্ম বলেও! এই হচ্ছে, ভীষ্মের গল্প। এবারে মূল আলাপে ফেরা যাক!

সত্যবতীর কনিষ্ঠপুত্র বিচিত্রবীর্য রাজা হলেন, কাশীরাজের দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সাথে বিয়েও হলো। কিন্তু, এই বিচিত্রবীর্য ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির, যৌনক্ষমতাহীন তথা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। সে কারণে কিংবা বিয়ের পরপরই রাজ্যাভিষেকের সময়ই তার মৃত্যু হয় বলে, মৃত্যুর সময়ে বিচিত্রবীর্য ছিলেন নিঃসন্তান! ফলে, হস্তিনাপুর রাজ্যের সামনে ভীষণ সংকট এসে উপস্থিত হয়, একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী ভীষ্ম কোনদিন রাজা হবেন না, ব্রহ্মচর্য করায় তার কোন সন্তানও হবে না।

ফলে কুরুবংশ কি থেমে যাবে? মানে, কুরু বংশ তখন ধ্বংসের মুখে! এখন উপায়? নিজ বংশধরকে রাজা বানানোর ইচ্ছে বা স্বপ্ন আর সৎপুত্র ভীষ্মকে দেয়া শর্তের কথা সব ভুলে সন্তানহারা সত্যবতী ভীষ্মেরই কাছে গিয়ে অনুনয় করলেন, ‘হয় নিজে রাজ্যভার গ্রহণ ও বিয়ে করে, নতুবা ভ্রাতৃবধুদের সাথে মিলিত হয়ে সন্তান দান করে এই রাজবংশকে রক্ষা করো, পূর্বপুরুষদের নরকে নিক্ষেপ করো না’। কিন্তু কঠোর তপস্বী ভীষ্ম ত্রিলোকের সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে রাজী আছেন, কিন্তু যেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা ত্যাগ তিনি করবেন না! তাহলে এখন উপায়? শাস্ত্রজ্ঞানী ভীষ্মই এক পথ বাতলে দিলেন।

নিয়োগ পদ্ধতিতে বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রী যদি কোন মুনির সাথে মিলিত হন, তাহলে সেখান থেকে যেই সন্তান জন্ম নিবে, তারাই হবে এই রাজ্যের উত্তরাধিকারী! ভীষ্ম বেদ জ্ঞান থেকে জানান, ‘ক্ষেত্রজ পুত্র বিবাহকারীরই পুত্র হয়’। ইতিহাস থেকে উদাহরণ দেন, ‘পুরাকালে পরশুরাম যখন এই দুনিয়াকে নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন, তখন স্বামিহারা ক্ষত্রিয়নারীগণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সাথে সহবাস করেই সন্তান উৎপাদন করেছিলেন (এভাবেই পরবর্তী ক্ষত্রিয় পুরুষ রাজ্যভার গ্রহণ করেছিলেন)’! ‘অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমাকে দেখতে পেয়ে বলি রাজা নিজে সন্তান উৎপাদনের জন্যে তাকে ধরে নিয়ে আসেন এবং মহিষী সুদেষ্ণাকে তার কাছে যেতে বলেন।

সুদেষ্ণা প্রথমে দীর্ঘতমার কাছে তার ধাত্রীকন্যাকে পাঠান, এগার সন্তান জন্ম নেয়। এরপরে নিঃসন্তান বলি রাজা নির্বন্ধ অনুরোধ করলে সুদেষ্ণা ঋষি দীর্ঘতমার কাছে যান, এবং তাদের মিলনে পাঁচজন তেজস্বী পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। অর্থাৎ, বলি রাজার বংশধরেরা মূলত ঋষি দীর্ঘতমা থেকেই উৎপন্ন হয়েছিলেন’।

শাস্ত্রজ্ঞানী ভীষ্মের এমনসব কথা আর উদাহরণ শুনে সত্যবতী জানে পানি পেলেন। তিনি তার জ্যেষ্ঠপুত্র মুনি বেদব্যাসকে ডাকেন। বেদব্যাস রাজপ্রাসাদে কয়েকদিন কাটিয়ে যান। তাতেই অম্বিকার গর্ভে জন্ম নেন জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র আর অম্বালিকার গর্ভে জন্ম নেন পাণ্ডু (সংগমের সময়ে কৃষ্ণকার, জটাধারী, কুৎসিতদর্শন ও বিকট গন্ধী বেদব্যাসকে দেখে ভয়ে চোখ বুজেছিলেন অম্বিকা, তাই তাদের সন্তান হয় অন্ধ।

অন্যদিকে এটি শুনে সংগমের সময় অম্বালিকা চোখ খুলে রাখলেও, বেদব্যাসকে দেখে ভয়ে তিনি পাণ্ডু বর্ণ ধারণ করেছিলেন, ফলে সন্তানও জন্ম নেয় পাণ্ডু বর্ণ নিয়ে। সেকারণে অম্বালিকার পুত্রের নাম হয় পাণ্ডু)। ঋষি-মুনির কাজ কারবারই আলাদা, তিনি এসেছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যের দুই রানীর সাথে মিলিত হতে, কিন্তু তাতেও বোধ হয় তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। দেখা গেলো, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর সাথে সাথে আরেক দাসীর গর্ভেও জন্ম নিলেন আরেক সন্তান – বিদুর, যিনি পরবর্তীতে হস্তিনাপুরের মহামন্ত্রী হন।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মহারাজা শান্তনুর উত্তরাধিকার হিসেবে যে রাজা পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্র রাজসিংহাসনে বসলেন, তাদের দুজনের কেউই প্রকৃত প্রস্তাবে শান্তনুর বংশধর নন তথা কুরু বংশের নন, মানে মহারাজা শান্তনুর রক্ত ধৃতরাষ্ট্র বা পাণ্ডু- কারোরই ধমনীতেই প্রবাহিত নয়! তারপরেও যে তারা রাজা, তার মূল জায়গাটিই হচ্ছে – শস্যক্ষেত্রের মালিকানার সেই রীতি। রানী অম্বিকা ও অম্বালিকা যেহেতু বিচিত্রবীর্যের স্ত্রী, ফলে কার বীর্যে ধৃতরাষ্ট্রের বা পাণ্ডুর জন্ম হয়েছে, সেটা বিবেচ্যই নয়। অম্বিকা ও অম্বালিকার সন্তান মৃত বিচিত্রবীর্যেরই সন্তান- তথা হস্তিনাপুর সাম্রাজ্যের রাজকুমার তারা।

একইভাবে, পাণ্ডুপুত্র হিসেবে পরিচিত, যাদেরকে ডাকা হয় পাণ্ডব (পাঁচজন পুত্র – তাই পঞ্চপাণ্ডব), সেই পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম পাণ্ডুর ঔরসে নয়। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব- পাঁচজনের কারোর শরীরেই পাণ্ডু বা শান্তনুর রক্ত কিংবা জিন প্রবাহিত হয়নি। হতে হবেই, এমন কথাও নেই অবশ্য! বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রকেই পরবর্তী রাজা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন ভীষ্ম ও সত্যবতী। অন্ধ হলেও ভীষ্মের কাছ থেকে যুদ্ধবিদ্যায় ভীষণ পারদর্শী হয়েছেন, ছিলেন দারুণ বলবান।

অন্যদিকে পাণ্ডু যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হলেও ধৃতরাষ্ট্রের মত বলবান নন। পাণ্ডুর প্রধান জায়গাই ছিল- তিনি ভীষণ ন্যায়বান ও ধর্মনিষ্ঠ! আর, দাসীপুত্র বিদুর হয়েছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ, মানে পণ্ডিত। ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যাভিষেক এর আগে পাণ্ডু সেনাপতি হিসেবে এবং বিদুর মহামন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এরপরে যখনই ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যাভিষেক হতে যাবে, সেই মুহুর্তে মহামন্ত্রী হিসেবে বিদুর বাগড়া দিয়ে বসেন।

শাস্ত্র থেকে পাওয়া জ্ঞানে তিনি জানান, রাজা হওয়ার জন্যে জ্যেষ্ঠতার চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যোগ্যতা। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র কোনদিনও প্রজার দুঃখ কষ্টের দিকে তাকানওনি, ফলে ন্যায়পরায়ন ও প্রজা বৎসল পাণ্ডুরই রাজা হওয়া উচিৎ! নরম মনের পাণ্ডু আজীবন নিজেকে সেনাপতি হিসেবে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করবেন- এভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, ফলে বিদুরের এমন প্রস্তাবে তিনি আপত্তি জানান। কিন্তু, শাস্ত্রজ্ঞান বলে কথা, তাছাড়া সত্যবতী ও ভীষ্মও ধৃতরাষ্ট্রের বদমেজাজি ও আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবের জন্যে নিশ্চিত ছিলেন না, রাজা হিসেবে তিনি কেমন হবেন। তাই বিদুরের প্রস্তাব তারা লুফে নিলেন।

পাণ্ডু হলেন রাজা। রাজার একজন রানী দরকার, তাই তিনি মথুরার যাদববংশীয় রাজা শূরসেনের কন্যা ও কুন্তিভোজের পালিত কন্যা- কুন্তীর স্বয়ম্বরসভায় গিয়ে হাজির হন এবং কুন্তীকে জয় করে নিয়ে আসেন। বিয়ের পরে তাকে মদ্রদেশের যুবরাজ শল্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হয়, এবং সেখানে গিয়ে যুবরাজ শল্যের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায় ও দুই রাজ্যের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের নিমিত্তে শল্যের বোন মাদ্রীকে বিয়ে করে হস্তিনাপুরে চলে আসেন। এরপরে মহারাজা পাণ্ডু সেনাবাহিনী নিয়ে বের হন, নানাদেশ জয় করে ও বহু ধন নিয়ে ফিরেও আসেন।

তারপরে, একদিন পাণ্ডু তার দুই রানীকে নিয়ে বনে শিকারে বের হলে ভুলবশত পাণ্ডু ঋষি কিন্দমের স্ত্রীকে হরিণ মনে করে মেরে ফেলেন। ঋষি কিন্দম রাজা পাণ্ডুকে অনেক শাপ-শাপান্ত করেন। ভারাক্রান্ত ও অপরাধবোধে ভোগা পাণ্ডু রাজপ্রাসাদে ফিরে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বনবাসে যাবেন, যেহেতু একজন নিরীহ প্রজাকে মেরে ফেলেছেন- সেহেতু রাজা থাকার অধিকার তিনি হারিয়েছেন। দুই স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বনে গিয়ে একটি কুটির বানিয়ে বাস করতে লাগলেন। এই পাণ্ডু রাজার শারীরিক তথা যৌন সমস্যা ছিল, মানে যৌনকার্য করার বল তিনি ধারণ করতেন না, ফলে যৌনকর্ম ঠিকভাবে করতে পারতেন না, কিছুক্ষণের মধ্যেই একদম কাহিল হয়ে যেতেন, শ্বাস প্রশ্বাসও ঠিকভাবে নিতে পারতেন না।

মহাভারতে অবশ্য বলা হয়েছে – ঋষি কিন্দম ও তার স্ত্রী হরিণের বেশে সঙ্গমরত অবস্থায় পাণ্ডুর তীরে কিন্দমের স্ত্রী মারা যান, তাই রেগে গিয়ে কিন্দম এই অভিশাপ দেন যে, পাণ্ডু যখনই কারো সাথে সহবাস করতে যাবেন, সাথে সাথে মারা যাবেন (এই শাপ দেয়ার আগে, মানে ওই বন্যশিকারে যাওয়ারও আগে দুইদুটি স্ত্রী থাকার পরেও তিনি নিঃসন্তান ছিলেন! তার স্ত্রীদের সাথে কখনো মিলিত কি হননি পাণ্ডু? না হলে, কেন?) সে যাই হোক- বনবাসে গেলেন পাণ্ডু। সাথে দুই স্ত্রী, কিন্তু কারো সাথেই যথাযথভাবে যৌনমিলন হচ্ছে না বা শাপের ভয়ে মিলিতই হচ্ছেন না। মিলিত না হলে সন্তান হবে কিভাবে? সন্তান না হলে কুরু রাজ্যের ভবিষ্যতের কি হবে? সে এক মহাচিন্তা! অনেক চিন্তাভাবনা করে পাণ্ডু ঠিক করলেন, তাদেরও তো নিয়োগ পদ্ধতি সন্তানলাভ হতে পারে।

পাণ্ডুর নিজের জন্ম যে প্রকারে হয়েছে এরকম নিয়োগ পদ্ধতিতে, মুনি বেদব্যাসের ঔরসে, মাতা অম্বালিকার গর্ভে, একইভাবে তার স্ত্রীরাও কোন মুনি-ঋষির সাথে মিলিত হয়ে সন্তানদান করতে পারেন। পাণ্ডু গিয়ে কুন্তীকে এই কথা বলেন। তখন কুন্তী জানান, তিনি বিশেষ এক বরপ্রাপ্তা। পাণ্ডুর সাথে বিয়েরও আগে কুন্তী মুনি দুর্বাশার অনেক সেবাযত্ন করেছিলেন, তাতে দুর্বাশা খুশি হয়ে এক অদ্ভুত বর দেন। কুন্তী যখনই মন্ত্র পড়ে কোন দেবতাকে কামনা করবেন, সেই দেবতা এসে তার অনুরূপ এক পুত্র সন্তান দান করবেন। এই কথা শুনে, পাণ্ডু খুশীতে লাফিয়ে উঠে বলে- আর দেরী নয়, এখনই চলো! কুন্তী প্রথমে ডাকলেন দেবতা ধর্মরাজকে। ধর্মরাজের সাথে মিলিত হয়ে কুন্তী সন্তানলাভ করলেন যুধিষ্ঠিরকে। সেকারণে পাণ্ডুপুত্র বা জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে ধর্মপুত্রও বলা হয়।

এরপরে পাণ্ডু চাইছিলেন ভীষণ বলবান এক সন্তানকে, ফলে কুন্তী কামনা করলেন মহা বলশালী হনুমানের পিতা- দেবতা বায়ুরাজ বা পবনদেবকে। তার সাথে মিলিত হয়ে কুন্তী লাভ করলেন ভীমকে। এরপরে তিনি দেবরাজকে ইন্দ্রকে কামনা করেন, ইন্দ্রের সাথে মিলনে জন্ম হয় অর্জুনের। পাণ্ডুর ইচ্ছা ছিল পাঁচ সন্তানের। কুন্তীর কাছ থেকে তিন সন্তান পাওয়ার পরে, এবারে এগিয়ে আসেন মাদ্রী। মহাভারত মতে, তিন সন্তান জন্মানোর পরে চতুর্থ সন্তান নেয়ার আগে কুন্তী দেখলেন, নিঃসন্তান মাদ্রী প্রচণ্ড দুঃখী। তাই এবারে তিনি সেই মন্ত্র মাদ্রীকে শিখিয়ে দিয়ে বললেন, এবারে তুমি দেবতাকে কামনা করো। মাদ্রী অশ্বিনীকুমার নামে দুই জমজ দেবতাকে কামনা করলেন। এবং দেবতা ভ্রাতৃদ্বয়ের সাথে মিলিত হলেন। ফলে, তার একবারে দুই সন্তান জন্ম নিলো। নকুল ও সহদেব!

এভাবেই, রাজ্য পরিত্যাগ করা পাণ্ডু পাঁচ সন্তান পেলেন, এবং কুন্তী ও মাদ্রীর স্বামীর পদাধিকারবলে এই পাঁচ সন্তানের পিতা হলেন। সন্তানরাও হয়ে গেলেন পাণ্ডব! পদাধিকারবলে পিতা পাণ্ডু হলেও, পাঁচ পাণ্ডবের প্রত্যেকের পিতা ভিন্ন, পাঁচজনের পাঁচ পিতা। তার মধ্যে আবার জমজ ভাই নকুল ও সহদেব- উভয়েরই দুজন পিতা, যেহেতু সে সময়ে ডিএনএ টেস্ট করার উপায় ছিল না, ফলে অশ্বিনীকুমার ভাই দুজনই নকুলের বাবা, সহদেবেরও! কে কার পিতা, বা কে কার সন্তান – সেই হিসাবটা বাদ দিয়ে পাণ্ডু ও তার দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীর সম্পর্কের দিকে দেখা যেতে পারে।

পাণ্ডু তার দুই বিবাহিত স্ত্রীর সাথে এক ধরণের ওপেন রিলেশনে আবদ্ধ ছিলেন। পাণ্ডুর আছে দুই নারীর সাথে সম্পর্ক। আর, কুন্তীর সাথে সম্পর্ক পাণ্ডু, ধর্মরাজ, পবনদেব ও ইন্দ্রের। পাণ্ডুর সাথে বিয়ের আগে কুমারী কুন্তী মিলিত হয়েছিলেন দেবতা সূর্যদেবের সাথে। তখন জন্ম নিয়েছিলেন কর্ণ। যেহেতু কুমারী ছিলেন, তাই লোকনিন্দার হাত থেকে বাঁচতে প্রথম পুত্র কর্ণকে পাত্রে বসিয়ে তিনি ভাসিয়ে দিয়েছিলেন (সেই কর্ণ ভীষ্মের রথচালকের ঘরে সূতপুত্র হিসেবে বেড়ে উঠেন, পরে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ হলেও জন্মপরিচয়ের কারণে কোথাও সম্মান পাচ্ছিলেন না বিধায়, ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনের মিত্রে পরিণত হন এবং কুরুযুদ্ধে পঞ্চপাণ্ডবের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আপন অনুজ ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন)।

তার মানে হিন্দুশাস্ত্রমতে সবচেয়ে সতী পাঁচনারীর একজন এই কুন্তীর সাথে সম্পর্ক ছিল পাঁচ পুরুষের, তাদের চারজনের ঔরসে তার চার সন্তানের জন্ম হয়! আর, পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীর সাথে সম্পর্ক তিনজনের, এবং তাদের দুজনের ঔরসে তার দুই সন্তানের জন্ম হয়! আর, বেচারি পাণ্ডুকে দুই স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়, এবং ভীষণ যৌন সমস্যার কারণে কিংবা ঋষি কিন্দমের শাপে- মাদ্রীর সাথে যৌনসঙ্গম করতে গিয়েই মৃত্যুলাভ করেন!

কাহিনীর এখানেই শেষ নয়! পঞ্চপাণ্ডব তখন মাতা কুন্তীকে নিয়ে বনবাসে, সন্ন্যাসবেশ ধারণ করে পাঁচ ভাই দান সংগ্রহ করেন, তাতেই তাদের চলে। এরকম সন্ন্যাসবেশে তারা গিয়ে হাজির হয়েছেন পাঞ্চাল রাজ্যে, সেদিনই সেখানে চলছিলো পাঞ্চাল রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভা। কৃষ্ণের পরামর্শে পাঞ্চালরাজের ইচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ অর্জুনের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন, তাই স্বয়ম্বর সভায় এমন এক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছেন, যা কেবল অর্জুন (এবং কর্ণ) এর পক্ষেই জয়ী হওয়া সম্ভব। কর্ণ দুর্যোধনের পক্ষে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চাইলে দ্রৌপদী তাকে নিবৃত্ত করেন এই বলে যে, সূতপুত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না।

উপস্থিত রাজারা ও রাজকুমাররা সকলেই ব্যর্থ হলে, উপস্থিত সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আহবান জানানো হয়, ছদ্মবেশী অর্জুন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জয়ী হন এবং দ্রৌপদীকে নিয়ে তাদের কুটীরে আসেন। সেখানে পুজারত মাতা কুন্তীকে পেছন থেকে যখন অর্জুন জানায়, দেখো মা কি দান নিয়ে এসেছি, মাতা অভ্যেস মোতাবেক আদেশ করেন- যে দানই নিয়ে আসো, পাঁচ ভাই সমান ভাগে ভাগ করে নাও! পুজা শেষে তাকিয়ে দেখেন, কি সর্বনাশ! অর্জুন তো সাথে করে দ্রৌপদীকেও নিয়ে এসেছেন। দ্রৌপদীকেও তার পিতা দান করে দিয়েছেন! মাতৃ আজ্ঞা বলে কথা! মা আদেশ দিয়েছেন, তাই মানতেই হবে ।

মা বলেন, না -কোন দরকার নাই, এই আদেশ মানতে হবে না! যুধিষ্ঠির বলেন, যেই মুহুর্তে মাতা কুন্তী দান সমান ভাগ করে নিতে বলেছেন, সেই মুহুর্তে দ্রৌপদীর অধিকারলাভ হয়ে গিয়েছে, ফলে দ্রৌপদীকে কখনো তার পক্ষে অনুজ ভ্রাতার বধু হিসেবে দেখা সম্ভব নয়। যেমনটি নকুল – সহদেবের পক্ষেও অগ্রজের স্ত্রীর মত মাতৃস্থানীয় হিসেবে দেখা সম্ভব নয়। যুধিষ্ঠির সমাধান দিলেন, অর্জুন দ্রৌপদীকে বিয়ে করুক, আর তারা বাকি চার ভাই সন্ন্যাসব্রত নিয়ে ব্রহ্মচর্য করেই কাটাবেন! কিন্তু, তাহলে কুরু রাজ্যের ভবিষ্যৎ কি হবে? যুধিষ্ঠির রাজ্যের অধিকার ত্যাগ করলে ধর্মের প্রতিষ্ঠা কিভাবে হবে? ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুষ্ট দুর্যোধন তো অধর্ম রাজ্য বানিয়ে ফেলবে!

অতএব, যুধিষ্ঠিরের সন্ন্যাসব্রত, ব্রহ্মচর্য- একেবারেই অসম্ভব! অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, মাতৃআজ্ঞাই মানা হবে। পাঁচ ভাই দ্রৌপদীকে বিয়ে করবেন। তাই হলো, দ্রৌপদী একসাথে হলেন পাঁচ পাণ্ডব – যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের স্ত্রী। এই বিয়ের শর্ত ছিল দুটোঃ কোন এক সময়কালে কেবল এক ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবেই থাকবেন দ্রৌপদী। এই সময়কালটি ছিল এক বছরের। সেই একবছরে অন্য ভাইরা দ্রৌপদীর সাথে মিলিত হতে বা তার ঘরে পর্যন্ত উপস্থিত হতে পারবেন না। এতে করে নকুল আর সহদেবের প্রকৃত পিতা বের করার সমস্যাটি আর তাদের ক্ষেত্রে হয়নি। পাঁচ পাণ্ডবের ঔরসে দ্রৌপদীর গর্ভে পাঁচ পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। যুধিষ্ঠিরের পুত্র প্রতিবিন্ধ্য, ভীমের পুত্র শুতসােম, অর্জুনের পুত্র শ্রুতকীর্তি, নকুলের পুত্র শতানীক এবং সহদেবের পুত্র তসেনা।

দ্বিতীয় শর্ত ছিল কোন কারণে পঞ্চপাণ্ডবের কেউ যদি দ্রৌপদীভিন্ন অন্য কোন নারীকে বিয়ে করেন, তবে তাকে স্ত্রীরূপে তাদের সংসারে, মানে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসতে পারবেন না। এই শর্তটি অবশ্য ভঙ্গ করেন অর্জুন, তিনি কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রাকে বিয়ে করে ইন্দ্রপ্রস্থ রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন, এবং শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদী অর্জুনকে ক্ষমা করে দেন ও সুভদ্রাকে রাজপ্রসাদে প্রবেশের অনুমতি দেন।

এখানে দ্রৌপদী ও পাঁচ ভাইয়ের সম্পর্কটাও অনেকটা ওপেন রিলেশনের মতই ছিল। পাণ্ডু – কুন্তী – মাদ্রীর সম্পর্কের সাথে এখানে পার্থক্য হচ্ছে- কেবল পাণ্ডুর সাথে কুন্তী ও মাদ্রীর সম্পর্কটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ, কিন্তু কুন্তী ও মাদ্রীর সাথে অন্যান্য সম্পর্কগুলো বিবাহবহির্ভূত ছিল। অন্যদিকে দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যকার ও অন্যদের সাথে সমস্ত সম্পর্কই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।

দ্রৌপদীর ছিল পাঁচ স্বামী – পাঁচ ভাই! প্রত্যেকের ঔরসেই একটি করে পুত্র সন্তান গর্ভে ধারণ করেন দ্রৌপদী। আর, দ্রৌপদীর সাথে বিয়ের আগেই ভীম বিয়ে করেছিলেন রাক্ষসী হিড়িম্বাকে। তাদের ছিল এক পুত্র- ঘটোৎকচ। দ্রৌপদীর সাথে বিয়ের পরেও পঞ্চপাণ্ডব অন্য নারীদের সাথেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যুধিষ্ঠির বিয়ে করেন দেবিকাকে, তাদের এক সন্তান- যৌধেয়। ভীমের তিন স্ত্রী, দ্রৌপদী ও হিড়িম্বা ছাড়াও তিনি বিয়ে করেন কাশীরাজ্যের রাজকন্যা বলন্ধরাকে, তাদের পুত্রের নাম সগর্ব। অর্জুন দ্রৌপদী ও সুভদ্রাকে বিয়ে করার মাঝখানে বিয়ে করেছিলেন কৌরব্যনাগের কন্যা উলূপী (ইনি পূর্ব-বিবাহিতা ছিলেন) এবং মণিপুররাজ চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে। অর্থাৎ অর্জুনের চার স্ত্রী ছিল।

পুত্রের সংখ্যাও চার- শ্রুতকীর্তি (দ্রৌপদীর পুত্র), ইরাবান্ (উলুপীর পুত্র), বভ্রুবাহন (চিত্রাঙ্গদার পুত্র) ও অভিমন্যু (সুভদ্রার পুত্র)! নকুল বিয়ে করেন চেদি রাজা শিশুপাল এর কন্যা করুণামতীকে। তাদের এক পুত্র সন্তান – নিরামৃত। সহদেবও বিয়ে করেন মদ্ররাজ দ্যুতিমতের কন্যা বিজয়াকে, তাদের এক পুত্র – সুহত্রা! অর্থাৎ, প্রতি জোড়া দম্পতির ছিল একটি করে পুত্র সন্তান! কুরুযুদ্ধে অবশ্য পাণ্ডবদের ৭ সন্তান মারা যান (ভীম-হিড়িম্বার পুত্র ঘটোৎকচ আর অর্জুন-সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যুকে বধ করেন পাণ্ডবদেরই জ্যেষ্ঠভ্রাতা কর্ণ আর কুরুযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরে দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন – দ্রোনাচার্যপুত্র অশ্বত্থামা)।

দুনিয়ার সব অঞ্চলের পুরাতন সাহিত্যে বা ধর্মগ্রন্থে পুরুষের বহুগামিতার ছড়াছড়ি। এককভাবে পুরুষেরই বহুগামিতা! আর নারীমাত্রই কঠোরভাবে একগামী! আমাদের এই অঞ্চলের প্রাচীণ সাহিত্যে ব্যাপারটি অন্যরকম। এই সাহিত্যের সময়কালটিতে সমাজে পুরুষের আধিপত্য দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীরা স্বামীর অধীনস্ত বা সম্পত্তি হিসেবেও বিবেচিত, রাজ্যশাসন কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষেরই একচ্ছত্র আধিপত্য (সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত), পুরুষের বহুগামিতা স্বাভাবিক ও খুবই নৈমিত্তিক! কিন্তু নারীমাত্রই একগামী নয়। এখানে পুরুষ ও নারী – উভয়ই বহুগামী!

এই ব্যাপারটি আরো ভালোভাবে বুঝা যায়, পাণ্ডু যখন কুন্তীকে নিয়োগ পদ্ধতিতে সন্তান লাভ করার ব্যাপারে বুঝাচ্ছিলেন, তখন শাস্ত্র থেকে যেসব যুক্তি ও ঐতিহাসিক পরম্পরার কথা বলছিলেন, সেসবে যদি দৃষ্টি দেয়া যায়। পাণ্ডু কুন্তীকে রীতি সম্পর্কে জানান, ‘আপদকালে স্ত্রীলোক উত্তম বর্ণের পুরুষ বা দেবর থেকে সন্তান লাভ করতে পারে’। এরপরে, পাণ্ডু প্রাচীণ ধর্মতত্ত্ব থেকে জানান, “পুরাকালে নারীরা স্বাধীন ছিল। তারা স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিচরণ করত, তাতে কোন দোষ হত না, কারণ প্রাচীণ ধর্মই এই প্রকার। উত্তরকুরুদেশবাসী এখনো সেই ধর্মানুসারে চলে। এদেশেও সেই প্রথা অধিককাল রহিত হয়নি”।

এরপরে, কিভাবে সেই প্রথা পাল্টে গেলো, সেটিও পাণ্ডু জানান, উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন, তার পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদিন শ্বেতকেতু দেখলেন, তার পিতার সামনেই এক ব্রাহ্মণ তার মাতার হাত ধরে নিয়ে গেলেন (মিলনের উদ্দেশ্যে)। শ্বেতকেতু তা কোনভাবেই মানতে পারেন না। পিতা বললেন, ‘তুমি ক্রুদ্ধ হয়ো না। সনাতন ধর্মই এই। পৃথিবীর সকল স্ত্রীলোকই গরুর ন্যায় স্বাধীন’! শ্বেতকেতু তখন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে স্ত্রীলোকের সেই স্বাধীনতা খর্ব করলেন। তিনি বললেন, “আজ থেকে যে নারী পরপুরুষগামিনী হবে, যে পুরুষ পতিব্রতা পত্নীকে ত্যাগ করে অন্য নারীর সংসর্গ করবে এবং যে নারী পতির আজ্ঞা পেয়েও ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনে আপত্তি করবে, তাদের সকলেরই ভ্রূণহত্যার পাপ হবে”।
এভাবেই স্বাধীন স্ত্রীলোকের পরপুরুষগমন বন্ধ হলো (যদিও পুরুষ ভ্রুণহত্যার পাপের ভয়ে অন্য নারীর সংসর্গ ত্যাগ করলো না), তবে পতির অনুমতিক্রমে বা নির্দেশে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের নিয়মটি বহাল হলো বা থাকলো! এখান থেকেও বুঝা যাচ্ছে, এই মহাভারতে এককালে নারী ও পুরুষ উভয়েই বহুগামী ছিলো এবং এই বহুগামিতা তাদের বিয়ে ও সংসারে তেমন বাঁধা সৃষ্টি করতো না!

লেখা: অনুপম সৈকত শান্ত

পঠিত : ৯৯৮ বার

মন্তব্য: ০