Alapon

সিরিয়া পরিস্থিতির মূল্যায়ণ...

প্রশ্ন উঠেছে, সিরিয়া পরিস্থিতিকে আমরা কিভাবে দেখবো? আপনি যদি এখনকার পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সিরিয়ার ঘটনাটি বুঝতে চান, বা ব্যাখ্যা করতে চান, তাহলে বস্তুনিষ্ট এবং ন্যায়সঙ্গত মতামত দেয়া আপনার পক্ষে কঠিন হবে। যেকোন ঘটনাকে বিচার করতে হয় সামগ্রিকভাবে, পটভুমিসহ। উপসংহারের দিকে তাকিয়ে মূল্যায়ণ করলে আপনি নিশ্চিতভাবেই ভুল করবেন।

ঘটনার মারপ্যাঁচের কারণে অনেকে মনে করে এখানে সব পক্ষই দোষী। সবারই দোষ আছে। প্রকারান্তরে আন্দোলনকারীদেরকেও এই কথার নিশানা বানানো হয়। সিরিয়ার জনগনকে এই ধারায় ফেলা একদমই অনুচিত এবং বিবেচনাবহির্ভুত। সব পক্ষকে দোষী ধরার ধারণাটি সব সময় ন্যায়সঙ্গত হয় না। এখানের আন্দোলনটি সিরিয়ারবাসীর সাধারণ জনগনের মুক্তির আন্দোলন। এটা সম্পূর্ন শান্তিপূর্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল, মিসর তিউনিসিয়ার মতো। আসাদই তাদের বিরুদ্ধে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রথমে আক্রমন করে। ট্যাংক এবং মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ে শতশত মিছিলকারীকে হত্যা করে। ধরে ধরে জেলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে। হাফেজ আল আসাদও তার বিরুদ্ধে উঠা প্রতিটি আওয়াজকে এভাবে দমন করেছিল। হামার গনহত্যায় ২৫ হাজার মানুষ হত্যা করেছিল। আসাদ মনে করছে সেও বাপের মতো সামরিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করবে। তাই, কারও কথা শুনে নি। ঘটনার শুরুতেই দেভুতুগলো দামেস্কে গিয়ে তাকে কিছু ছাড় দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু সে শুনে নি। আত্মঘাতি পথ বেছে নিয়েছিলল। প্রতিবাদকারীরা তাদের আন্দোলনকে সামরিকায়ণ করে নি। আসাদই করেছিল। আক্রমনের নারকীয়তা এতো বেশী ছিল যে, স্বয়ং সেনাবাহীনির একটি উইং বিদ্রোহ করে সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। পরবর্তিতে এটার পরিধি বড় হয়। ঠিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন বাঙ্গালী সেনারা বিদ্রোহ করেছিল। এখন যারা সিরিয়াবাসীর এই পদক্ষেপকে ভুল বলবে তাদের আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও ভুল বলতে হবে।

যদি বলেন, 'এখানে আমেরিকা রাশিয়া জড়িয়ে পড়েছে। এটাকে স্রেফ সরকারবিরোধী আন্দোলন বলা যায় না এখন।' এটা একটা অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। কারণ, দুনিয়ার সব বড় ঘটনায় বৃহৎশক্তিগুলো জড়িয়ে পড়ে। এটা নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। ইতিহাস দেখলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথাই ধরুন। এখানেও বৃহৎ শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়েছিল। ভারত রাশিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার পক্ষে থাকে। ভারত সরাসরি সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে। আর রাশিয়া অস্ত্রের যোগান দেয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে প্রটেক্ট করে। আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এরা জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এনে যুদ্ধকে মাঝ পথে ঠেকিয়ে দিতে চায়ছিল। কিন্তু, সোভিয়েত রাশিয়ার কারণে পারে নি। তো, এভাবে সব সংগ্রামে বিদেশী শত্তিগুলো জড়িয়ে পড়ে। এর কারণে কোন জাতির সংগ্রামের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না।

এটা ঠিক, পরবর্তিতে তাদের ন্যায়সঙ্গত এবং সফল হতে যাওয়া সংগ্রামটিকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। সফল হতে দেয়া হয় নি। ঠিক মিসরে যেমন করা হয়েছে। পদ্ধতিটা জাষ্ট ভিন্ন। আইএস আর জিহাদীদের দমন করার নামে সিরিয়াবাসীর একটি সফল আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়া হয়। তার বহু কারণের মধ্যে একটা কারণ হচ্ছে, আসাদ সরে গেলে সিরিয়ার ক্ষমতায় আসবে ইসলামিস্টরা। তা না হলেও অন্তত জনগনের সরকার আসবে। এটাই ইসরাইল এবং তার দোসরদের ভয়। ফলে আসাদকে টিকিয়ে রাখার মধ্যেই সকল বিশ্ব মোড়ল কল্যাণ দেখতে পেল। আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে জনগনকে। দুনিয়ার কোন সংগ্রামের বৈধতাকে আপনি তার ফলাফল দিয়ে মাপতে পারবেন না। বরং, তার প্রকৃতি ও নৈতিক ভিত্তি দিয়ে বিচার করতে হয়। ফলাফল ক্ষয়ক্ষতি যা-ই হোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু, ক্ষয়ক্ষতি বা জয় পরাজয়ের ভিত্তিতে উচিত অনুচিত বলা যাবে না। দুনিয়ায় এমন হাজারও মহৎ লড়াই হয়েছে যেগুলোর পরিনতি হয়েছে হার। কিন্তু, তাই বলে সেগুলো অনুচিত ছিল না। ইসলামের ইতিহাসেও এর ভুরিভুরি প্রমান আছে। রাশিয়ান জারদের বিরুদ্ধে ইমাম শামিলের নেতৃত্বে চেচেনদের যুদ্ধ, এবং জওহর দুদায়েভের নেতৃত্বে রুশ বিরোধী যুদ্ধকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। এগুলোতে চেচনিয়া ককেশাস প্রায় মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। কিন্তু চেচেনদের পরাজয়ও হয়েছিল। কিন্তু বিবেকের বিচার হচ্ছে- এই যুদ্ধ বৈধ ছিল। জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধকেও উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারেন। সেখানেও আমেরিকা কমিউনিষ্ট সরকারকে দমন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু 'হো চি মিনে'র নেতৃত্বে ভিয়েতনামিরা আমেরিকান আগ্রাসন রুখে দাঁড়ায়। ১০ বছরের যুদ্ধে আমেরিকা দেশটিকে তামা বানিয়ে ছাড়ে। জ্বলার মতো আর কোন গ্রাম জঙ্গল বাকি ছিল না। কিন্তু, এর দিকে তাকিয়ে কেউ এ- কথা বলে না যে, হো চি মিন ভুল করেছিলেন। কি দরকার ছিল এতোগুলো প্রানকে বিসর্জন দেয়ার? এটা কেউ বলে না। বলা অনুচিত।

তো, পরবর্তি পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে একটি জাতির মুক্তি আন্দোলনকে ভুল বলা যায় না। জুলুমের প্রতিবাদ সংগ্রাম করা সবার মানবিক অধিকার। তাহলে তো কথাগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বলতে হবে। মানে, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এখানেও ব্যাপক হতাহত, এমনকি গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও আছে। তাই চুপ থাকাই উত্তম হবে। মানবজাতি যদি এরকম ভেবে আসতো তাহলে দুনিয়ার কোথাও আজ জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন দেখা যেতো না। পশ্চিমের যে ফেয়ার রাষ্ট্রব্যাবস্থা দেখি তা তারা রাতারাতি অর্জন করে নি। প্রচুর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। ফরাসী বিপ্লব এবং দুই মহাযুদ্ধের ইতিহাস একটু সচেতনভাবে পড়ে দেখলে বুঝে আসবে।

তাছাড়া, দুনিয়ার কোন সশস্ত্র সংগ্রামই প্রথম থেকেই সশস্ত্রের রুপ নেয় না। প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের বৈধ অধিকারের দাবি জানানো হয়। কিন্তু, স্বৈরাচাররা সেটার প্রতি কর্ণপাত না করে বন্দুকের নলের উপর নির্ভর করে। ফলে গৃহযুদ্ধে বা স্বাধিকার যুদ্ধে রুপ নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়াও আরো প্রচুর উদাহরণ পাবেন। তো, স্বৈরাচারদের ভুল পদক্ষেপের কারণে একটি শান্তিপূর্ণ বৈধ আন্দোলন যদি সহিংস আন্দোলনে রুপ নেয় তাহলে এর জন্য আপনি উভয় পক্ষকে দায়ী করতে পারেন না এবং এই জন্য গোটা আন্দোলনটার বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন না। আর কোন আন্দোলন পরিনতি দেখার পরে শুরু হয় না। এখন, সহিংসতার সম্ভাবনা থাকলে আন্দোলন করা যাবে না, এমন 'কিউট' ধারণা অনুর্বর মগজে জন্ম নিতে পারে। বাস্তবে এর কোন মূল্য নাই। এমন হলে দুনিয়াটা জুলুমের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হবে।

তাই, আমাদের মূল্যায়ণগুলো সামগ্রিক হওয়া উচিত। সাময়িক এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে করতে গেলে সত্য ধামাচাপা পড়ে যায়।

সমস্যাটা হচ্ছে, সবাই সিরিয়ার এই ঘটনায় কেবল আমেরিকা, রাশিয়া, ইসরাইল, ইরান, তুরস্ক, আইএস দেখে। সিরিয়াবাসীকে কারো নজরে পড়ে না। এটা যে, একটা জাতির ৪০ বছরের জুলুম থেকে মুক্তির আন্দোলন সেটা সবাই ভুলে যায়। কেউ মালহামা আর ইমাম মাহদী খোঁজে। আবার কেউ নিরেট বিশ্বরাজনীতির একটা খেলাঘর বলে বিকৃতির আশ্রয় নেয়। ফলে মাজলুমকে মাজলুম বলার মতো বিবেকের বিলুপ্তি ঘটে।

.

পঠিত : ৬২৪ বার

মন্তব্য: ০