Alapon

অন্যান্য ইসলামি প্ল্যাটফর্মগুলো সম্পর্কে ইমাম মওদূদীর অবস্থান এবং চিন্তাধারা কেমন ছিলো ?




বিগত শতাব্দীতে মুসলমি মানসে প্রভাব বিস্তারকারী যে কয়জন প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তক ও আলিমে দ্বীনের আগমন ঘটেছে, আল-ইমাম আল-উস্তায সাঈয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহিমাহুল্লাহ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। যদিও অন্যান্য যুগের অন্যান্য ওলামাদের মতো তাঁরও কিছু ভুলচুক হয়েছে বা আছে, মানুষ হিসেবে তা থাকতেই পারে। কিন্তু দ্বীনকে খোদার জমিনে গালিব করার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিলো, যে অনবদ্য ভূমিকা আর প্রচেষ্টা, যে নিষ্ঠাপূর্ণ আন্তরিকতা তারঁ ছিলো, সেটা সত্যিই এক বিরল ব্যাপার।


তাঁর যতোটুকুন ভুল না হয়েছে কিংবা আছে —তারচেয়ে বেশি তিনি সমালোচনার শিকার হয়েছেন। কখনো কখনো তো সেসব সমালোচনা জুলুমেও পরিণত হয়েছে। তবুও যাঁরা তাঁর প্রতি জুলুম করেছে, সমালোচনায় বাড়াবাড়ি করেছে, নির্মম আর নির্দয়ভাবে আঘাত করেছে-আক্রমণ করেছে, তিনি তাদেরকে কখনোই সেরকম আঘাত বা আক্রমণ করেননি। তাঁরা তাঁকে দূরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু তিনি তাঁদেরকে দূরে সরাননি ৷তিনি যা সত্য বলে মানতেন, যা দ্বীনের জন্য মঙ্গল মনে করতেন, সেসব ব্যাপারে তিনি কখনো কম্প্রোমাইজ করেননি। তিনি মুতাকাব্বির তথা অহংকারী ছিলেন না —তবে এক অগাধ আত্মমর্যদাবোধের অধিকারী ছিলেন। যেমন তাঁর বিনয় ছিলো, তেমন তাঁর ইলমও ছিলো। নিজের ইলমের আমানতের সাথে কখনো তিনি খেয়ানত করতেন না। তাঁর এমন বিনয় অথচ এমন অনঢ় মনোভাবের প্রেক্ষিতেই তাঁর সাথে তাঁরই সামসময়িক কিছু আলিম দ্বীনের মতবিরোধ হয়েছে।

তিনি ছিলেন ওলামায়ে দেওবন্দের ছাত্র। ইলম শিখেছেন তাঁদের থেকে । কাজও করেছেন তাঁদের সাথে। একজাতি তত্ত্ব নিয়ে তাঁর সাথে নববী বাগান দারুল ইলমের তৎকালীন মুহতামিম শাইখুল হাদিস, ওলামায়ে রব্বানী মুহতারাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি রহিমাহুল্লাহ’র সাথে মতবিরোধ হয়। তিনি তখন জমিয়তের মুখপাত্র তাজ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম ভিন্ন জাতি বলে মনে করতেন মওদূদী মরহুম ৷ অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই একজাতি — ভারতীয় জাতি— মনে করতেন মুহতারাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি রহিমাহুল্লাহ। হিন্দুমুসলিম একজাতি তত্ত্বের পক্ষে পত্রিকা সম্পাদনা করতে হবে বিধায় মওদূদী সাহেব তাঁর নিজ আত্মমর্যাদাবোধ বলি বা দ্বিমত বলি, সেই জায়গা থেকে তিনি তাজ পত্রিকার সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

তবে শুধু মাওলানা মওদূদী রহিমাহুল্লাহ নয়, দেওবন্দি অন্যান্য আরো অনেক আলিমগণও মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি রহিমাহুল্লাহ’র সাথে একমত হননি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মুফতি তকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহর বাবা, মুফতি শফী রহ. শাব্বির আহমদ উসমানী, হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহিগণ।


দ্বিমত সে জায়গা থেকে শুরু হলেও কিন্তু পরে আরো বেশি বিস্তৃতি ঘটে। যেমন খেলাফত ও মুলুকিয়াত গ্রন্থ, কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা — ইত্যাদি গ্রন্থগুলো নিয়ে। এক্ষেত্রে উস্তায মওদূদীর পরম হিতাকাঙ্ক্ষীসুলভ শালীন ও ন্যায়ভিত্তিক সমালোচক ছিলেন জামায়াতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, মুফাক্কিরে ইসলাম ইমাম সাঈয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহিমাহুল্লাহ। তিনিও মওদূদী রহিমাহুল্লাহর সাথে দ্বিমত হবার পরে জামায়াতে ইসলামী ছেড়েছেন। কিন্তু মওদূদীর সাথে সুন্দর সম্পর্কও বজায় রেখেছেন।

যাহোক, এরপর থেকে অন্যান্য ইসলামি প্ল্যাটফর্ম থেকে মাওলানা মওদূদী রহিমাহুল্লাহকে নিয়ে অন্যায় সমালোচনা করলেও, তাঁকে বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলকে ফিতনাবাজ বললেও তিনি কখনো অন্যদের অবমূল্যায়ন করতেন না। গালাগাল করতেন না। অন্যদের প্রতি প্রতিহিংসা রাখতেন না। করতেন না কোনো বদনামও। যদিও মওদূদী রহিমাহুল্লাহ’র অবস্থান থেকে ইদানীং কিছু জামায়াতে ইসলামীর কিছু ভাই সরে গেছেন, তবে এটার অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে তারা আলিমদের সোহবতে না যাওয়া বা থাকা। অথবা মাওলানাকে যথাযথভাবে অধ্যয়ন না করা।

এই যে আলিমদের সোহবতে না যাওয়ার কথা বললাম— এটারও একটা কারণ আছে, সেটা হচ্ছে কিছু আলিমদের তাদের প্রতি অতিরঞ্জিত বাড়াবাড়ি বা ঘৃণা আর নেগেটিভ মনোভাবমূলক সমালোচনা। তবে সার্বিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর ভাইয়েরা অন্যান্য ইসলামি প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যাপারে এখনো মওদূদী রহিমাহুল্লাহ'র দৃষ্টিভঙ্গি ফলো করে।

তো একাধিক ইসলামিক প্ল্যাটফর্ম, ইসলামি সংগঠন বা ইসলামি জামায়াতের ব্যাপারে আল-ইমাম আল উস্তায, সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী রহ. এর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিলো সেটা জেনে আসি।

মাওলানাকে তাবলীগ জামায়াতের এক ভাইয়ের করা একটা প্রশ্নের জবাবে মাওলানা বলেন —
“তাবলীগ জামায়াতের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই । নিজেদের বুদ্ধি এবং কর্মসূচী অনুযায়ী তারাও দীনের কাজ করছেন , আমরাও করছি । বর্তমান সময়ে বাতিল এতোটা প্রভাব বিস্তার করে আছে যে , দীনের কাজ করার জন্য দু'চারটি নয় বরং শত শত দলও যদি কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়, সেটাও বেশি নয় । তাই এসব দলের মধ্যে শত্রুতার কোনো কারণ নেই। শত্রুতা তো তাদের মধ্যে হতে পারে, যাদের মানসিকতা দোকানদারসুলভ এবং যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ এবং নামের জন্য কাজ করে।......বর্তমানকালে যারা দীনের কাজ করছে , আপনারা তাদের সকলের বই-পুস্তক পাঠ করুন এবং তাদের কাজ দেখুন । এরপর যেদিকে আপনাদের মন চায় , তাদের সাথে মিলিত হয়ে নিষ্ঠার সাথে দীনের খেদমত করুন, কিন্তু শুধু শুধু দীনের অপর খাদেমদের পেছনে পড়বেন না ।" ( বই : কুরআনের দেশে মাওলানা মওদুদী)



এই হচ্ছে আজকের দুনিয়ায় গত দেড় শতাব্দী যাবৎ মুসলিম মানসে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করা অন্যতম একজন সেরা ইসলামি চিন্তাবিদ ও আলিমে দ্বীনের অবস্থান ও চিন্তাধারা।

তাঁর মননে সর্বদা দ্বীনের কট্টোর দুশমন যারা, ইসলাম বিরোধী এজেন্ডার ঝান্ডাবহক যেসকল ব্যক্তিগণ, দ্বীনের সাথে সাংঘর্ষিক যেসব মতবাদ, তিনি শুধু তাদের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন। তিনি সকল মুসলিমকে কখনো বাতিল মতাদর্শী মতবাদের পেছনে না ছোটারই অনুরোধ করেছেন। তিনি একই কথা তাঁর সত্যের সাক্ষ্য নামক বইতেও বলেছেন। তিনি বলেছেন,

জামায়াতে ইসলামী যদি আপনাদের পছন্দ না হয়, তাহলে অন্য আরেকটি ইসলামি প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দ্বীনের খিদমত আঞ্জাম দিন। যদি কাউকেই পছন্দ না হয়, তাহলে নিজেই একটি দ্বীনি জামায়াত গড়ুন —তবুও বাতিল মতবাদের পেছনে যাবেন না।



তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলকেই কেবল হকের ঝাণ্ডাবাহী সাব্যস্ত করেননি। এমনকি অন্যান্য দ্বীনি জামায়াতগুলোকেও হক থেকে বিচ্যুত সাব্যস্ত করেননি। তিনি এ সম্পর্কে আরো বলেন-

আমরা নিজেদের জামায়াত সম্পর্কেও কোনরূপ গোঁড়ামি করিনি অথবা কখনো এমন কথা বলিনি যে, সত্য কেবল আমাদের জামায়াতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। আমরা পুরোপরি দায়িত্ব সচেতন হয়েই এ কাজের জন্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি এবং আপনাদেরকেও আপনাদের দায়িত্বের কথা স্বরন করিয়ে দিচ্ছি। এখন আপনারা আমাদের সাথে উঠে দাঁড়াবেন, কি নিজেরাই স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব পালন করবেন কিংবা অন্য কোন দায়িত্ব পালনকারীর সাথে মিলে কাজ করবেন, তা আপনাদেরই বিবেচ্য। ( বই : সত্যের সাক্ষ্য )



আমরা অন্যান্য সকল ইসলামি প্ল্যাটফর্মগুলো (এবং জামায়াতে ইসলামী-ছাত্রশিবির সকল ভাইয়েরাও) যদি এমনই মনোভাবের হতাম, তাহলে সত্যিই আমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো বিরোধ থাকতো না। আমরা সত্যিই খোদার দ্বীনের জন্য একে অন্যের কাজে সহযোগী হতে পারতাম।

আল্লাহ আমাদের সকলের অন্তরকে নির্মল আর পরিশুদ্ধ করে দিন। আমরা যেনো দ্বীন কায়েম ও দ্বীন হেফাজতের আন্দোলনে একে অন্যের সহযোগী মুজাহিদ হতে পারি। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদেরকে কবুল করুন। আ-মী-ন!


~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ২৮০ বার

মন্তব্য: ০