Alapon

দুইজন নারী নবাবের কথা

কুমিল্লার লাকসাম জংশনের কাছেই পশ্চিমগাঁও নামের একটি গ্রাম। গ্রামের মত হলেও ঠিক গ্রাম নয়। পশ্চিমগাঁও এখন লাকসাম পৌরসভার অংশ।

এই পশ্চিমগাঁওয়ের জমিদার ছিলেন নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী। বইতে পড়েছি, উপমহাদেশের মাত্র দুইজন নারী নবাবের পুরুষালী উপাধী অর্জন করেছিলেন। ফয়জুন্নেসা ছিলেন নবাব খেতাব পাওয়া প্রথম নারী। দ্বিতীয়জনকে এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে।

নবাব ফয়জুন্নেসাকে এখন আর তেমন স্মরণ করা হয়না। কেবল কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেসা গার্লস স্কুল, জানবিবির নবাব ফয়জুন্নেসা হলের মতো দুই একটি স্থাপনার উছিলায় কালেভদ্রে শোনা যায় এই মহীয়সী নারীর নাম। শুনেছি ১৯৯৬ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়েছিলো।

নবাব ফয়জুন্নেসা মূলত শিক্ষানুরাগী হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। শুধু শিক্ষানুরাগীই নয়, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের একটা বড় অংশ তাঁর দানে প্রতিষ্ঠিত। নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীর কার্যত খুব কম তথ্য বইপত্রে আছে। আমি তাঁর সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য জেনেছি পারিবারিক সূত্রে।

নবাব ফয়জুন্নেসা ছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা। একাকী জীবনে ফিরে পিতার জমিদারীর মালিক হয়ে জনহিতৈষী কর্মকাণ্ড আর সাহিত্যচর্চা নিয়েই মেতে থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পর্দানশীন। কিন্তু এটা তাঁর প্রশাসনিক যোগ্যতায় প্রভাব ফেলেনি। যার ফলে তিনি রাতের বেলায় ঘোড়ায় চড়ে তাঁর জমিদারী পরিদর্শন করতেন।

শিক্ষানুরাগ, দানশীলতা ও সাহিত্যচর্চার মতো বহুমুখী প্রতিভা সেই সময় বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে তো বটেই, সারা উপমহাদেশেই বিরল ছিলো। এর জন্যই বেগম ফয়জুন্নেসা নবাব খেতাবের জন্য মনোনীত হন। তবে এর পেছনে আরেকটি ঘটনা রয়েছে, যা আমি আমার আব্বার কাছ থেকে শুনেছি।

ফয়জুন্নেসাকে প্রথমে ব্রিটিশরা বেগম খেতাব দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ফয়জুন্নেসার কাছে যখন তাঁর বেগম উপাধী প্রাপ্তির খবর দিতে যান, তখন ফয়জুন্নেসা নাকি বলেছিলেন যে, তাঁর প্রজারা তাঁকে বেগম সাহেবা বলেই সম্মান করে। তিনি মনে করেন না, বেগম খেতাবটি নতুন করে তাঁকে ব্রিটিশদের দেয়ার কোন অধিকার আছে।

এরপর ১৮৯৯ সালে ফয়জুন্নেসাকে নবাব উপাধী দেয়া হয়। তিনি কঠোর পর্দা মানতেন বিধায়, উপাধী প্রাপ্তি নিয়ে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে তাঁর আলাপ হতো কয়েক স্তর পর্দার ভেতর থেকে। এমনকি নবাব উপাধী নিতে যখন তিনি কুমিল্লা শহরের চর্থায় হাজির হন, তখনো তাঁর জন্য পর্দার ব্যবস্থা করতে হয়। নবাব উপাধীর আনুষঙ্গিক তমঘা ও চাপকান তিনি পর্দার আড়ালে থেকে স্বীয় পরিচারিকাদের মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে গ্রহণ করেন। পর্দানুরাগের জন্যই কিছু কাল্পনিক স্কেচ ছাড়া নবাব ফয়জুন্নেসার কোন ছবি নেই।

উপমহাদেশের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ খেতাবপ্রাপ্ত নারী নবাব ছিলেন মধ্য ভারতীয় দেশীয় রাজ্য ভুপালের বেগম সাহেবা সুলতান কায়খুসরো জাহান। ১৯০১ সালে তিনি নবাব উপাধী পান। সেই যুগের হিসেবে ভুপালের উত্তরাধিকার নীতি ছিলো আধুনিক। সেখানে পুরুষ উত্তরাধিকারীর বদলে নারীরাও তখতে আসীন হতো। 'নবাব-বেগম' উপাধীধারী সেই নারীরা সাধারণভাবে ভুপালের বেগম নামে পরিচিত হতেন।

বেগম কায়খুসরো জাহানও নবাব ফয়জুন্নেসার মতোই বিদ্যানুরাগী ছিলেন। এমনকি অবাক করা তথ্য হচ্ছে, নবাব কায়খুসরো জাহান ছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চ্যান্সেলর। প্রায় এক দশক তিনি এই পদে আসীন ছিলেন।
বেগম সুলতান কায়খুসরো জাহান ছিলেন ভুপালের শেষ নবাব মেজর জেনারেল (তিনি এয়ার ভাইস মার্শালের মনসবও লাভ করেছিলেন) হামিদুল্লাহ খানের মাতা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভুপালের নবাব হামিদুল্লাহ খান ভৌগলিক বাস্তবতাকে একপাশে রেখে পাকিস্তানে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। তবে শেষতক তা সফল হয়নি। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যক্তিগত বন্ধু। তবে এতদসত্ত্বেও তিনি আমৃত্যু তাঁর সামরিক মসনদ অক্ষুণ্ন রেখে দেশীয় রাজা হিসেবে বৃত্তি পেয়ে গেছেন।

১৯১১ সালে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লীতে স্বীয় অভিষেকের দরবার আহবান করেন। এই দরবারে সম্রাট কতৃক ঘোষিত দুটি ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ। একটি হচ্ছে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বাতিল, এবং আরেকটি হচ্ছে, কলকাতা থেকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরের ঘোষণা।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ১৯১১ সালে দিল্লী দরবারে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে আগত ভুপালের বেগম নবাব সুলতান কায়খুসরো জাহানকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন ব্রিটেনের প্রিন্স অভ ওয়েলস এডওয়ার্ড। উল্লেখ্য, এডওয়ার্ড ১৯৩৬ সালে অষ্টম এডওয়ার্ড নামে ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ওয়ালিস সিম্পসন নামের এক মার্কিন স্বামী পরিত্যক্তা নারীর প্রেমে সাড়া দিতে সেই বছরেই সিংহাসন ত্যাগ করেন।

পঠিত : ১০৯৪ বার

মন্তব্য: ০