Alapon

একদিন ছুটি হবে!



একাকী চলতে চলতে চেনা জানা পরিচিত কোনো এক জায়গায় বসে বসে ভাবি ফুটন্ত ফুলের গন্ধ আর উড়ন্ত প্রজাপতি দূর দূরান্তে ছুটে চলা পাখির সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। সবুজের সমারোহ, প্রাকৃতিক নিসর্গ, আকাশের নীল চাদর এসবের প্রতি আমার মুগ্ধতা আছে সম্মোহন নেই। পাতা ঝরা মওসুম বিদায় নিয়েছে। বসন্ত দুয়ারে কড়া নাড়ছে। গাছের শাখা প্রশাখায় নতুন করে পত্র পল্লব ফিরে পেয়েছে প্রাণ। কোকিলের কুহু কুহু ডাকের আগমন ঘটেছে। পুরো শীতকালে তাকে কোথাও খুঁজে না পাওয়া গেলেও বসন্তের সময়ে হঠাৎ করে কোনো এক অজানা জায়গা থেকে ঘটে তার আগমন। দূর থেকে ভেসে আসছে ডাহুকের ডাক। এই ডাহুকই যখন নিস্তব্ধ রাতে থেমে থেমে ডেকে ওঠে তখন মনে হয় এই চেনা জানা পৃথিবীতে একমাত্র তারই রাজত্ব। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি ডাহুক কে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তেমনি একজন কবি ফররুখ আহমদ। নিজের কথামালাকে কাব্যে রুপ দিয়েছেন ডাহুক কবিতায়..

রাত্রিভর ডাহুকের ডাক
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধ দিঘি অতল সুপ্তির
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
.
.
আমার পছন্দের লেখক আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব একটু ভিন্ন ভাবে ভেবেছেন ডাহুক কে নিয়ে। তাই তো নিজের অব্যক্ত কথা মালাকে কাব্য রুপ দিতে ভুলে যান নি। সবুজ রাতের কোলাজ কাব্যগ্রন্থের কবিতা –

“একটানা সুরে একটা ডাহুক
ডাকছে ভীষণ, ডাকতে থাকুক।
ডাকতে ডাকতে হােক মৃতপ্রায়
গলায় উঠুক রক্ত
আজ রাতে তার ডানায় নামুক
তাহাজ্জুদের অক্ত।
যামিনীতে ফোটা কামিনী-সুরভী।
অন্তরে তার বাজাক পূরবী
সিজদাবনত শিউলির ঘ্রাণ
মাতাল করুক রাতজাগা প্রাণ।
ঝরে পড়া বেলি পায় না কাজ?
ওরা হয়ে যাক জায়নামাজ।
শেষ রাতে যদি একটু তাকাও
দেখবে, রুকুতে গাছের শাখাও!
ঝুঁকেছে তারকা আকাশের বুকে।
চলাে, আমরাও পড়ি তবে ঝুঁকে?
তাসবি জপছে হাসনাহেনারা।
পরাগেরা ভেসে বাতাসে বেড়াক
সেই বাতাসের শীতল ঝাপটা
নিভাক মনের কামনা-চেরাগ।
আজকে দু-চোখে বৃষ্টি ঝরুক
হৃদয়ে আসুক অশ্রু-শ্রাবণ
পাপের কালিমা ধুয়ে মুছে শুধু
শুদ্ধাচারের নামুক প্লাবন।"
.
.
যখন পাখির কথা উঠলো তখন ঘুঘুর কথা অনেক মনে পড়ছে। রাত বাড়ার সাথে সাথেই দূর থেকে ঘুঘুর ডাক ভেসে আসে। আবার কাছে কোথাও হতেও পারে। সাথে ঝিঝি পোকার শব্দাটা মনে হয় তালে তাল মিলায়। সেই একই সময়ে জোনাকির আলো আধারের মিলন মেলা আসলে মনোমুগ্ধকর। তবে ইলেকট্রিক ঝিকিমিকির আলো কে যে ভাবেই হোক হার মানাবে। মাঝেমধ্যে কাঠবিড়ালির ডাকটাও শুনা যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে বন্য টিয়া পাখির ডাক ও শুনতে পাওয়া যায়। তবে অল্প কিছু সময়ের জন্য। তো এই ঘুঘু দুই ভাবে ডাকে। দূরে কোথাও বার্তা দেওয়ার জন্য, নিজের অবস্থান বোঝাতে ডাকার সময় গলাটা উপর নিচে করে। আর এমনি ডাকার সময় মাথাটা উঁচুই থাকে। শব্দটা তখন মোটা হয়। তবে যে যা বলুক ঘুঘুর ডাক টা সকালে আর সূর্য ডোবার সময়ে অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করে। সকালে সেই নির্মল বাতাসে দূর থেকে ভেসে আসছে ঘুঘুর ডাক। কবি জীবনানন্দ দাস ভুলে যান নি ঘুঘুকে নিয়ে কবিতা লিখতে। তাইতো জীবনানন্দের কবিতায় ঘুঘুর কথা ফুটে উঠেছে (রুপসী বাংলা, পৃ. ৩৩)

এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে
এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে...
.
.
মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীতে যত বার্তাবাহক এসেছিল তাদের সবাই কবি ছিলেন। "কবিদের কি আসলেই মৃত্যু হয়? সেটা কীভাবে সম্ভব? তাদের কথামালা তাদের অমর করে রাখার গুরুভার তুলে নেয় কাঁধের ওপর।" [১] তা না হলে তাদের অল্প কথার মর্মতা বুঝতে পারাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় আমাদের মতো মানুষদের। যদিও এসব আমার নিছক ধারণা মাত্র। ঠিক এখন যেখানে বসে আছি এটার নাম দিয়েছি হরান। যদিও জায়গা টা অন্য নামে পরিচিত। এখান থেকে সোজাসুজি গেলে আমার বাড়ি। অনেকটা ঘুরে আসতে হয় বলে মাঝে মধ্যে খুব বিরক্ত লাগে। তবে পাশের গ্রাম হয়ে আসলে তাড়াতাড়ি আসা যায়। তার পরও ফেরার সময় সেই যা তাই। এজন্য ভাবি এদিক দিয়ে যদি একটা ব্রিজ থাকতো তাহলে হয়তো প্রতিদিন আমাকে দেখা যেত এই পারে একাকি নিঃসঙ্গ ডাহুকের মতো। তবে মজার কথা যতদিন ধরে এখানে যাওয়া আসা করি ততদিন ধরে ভেবে যাচ্ছি একটা ব্রিজ হোক। মাঝে মাঝে অনেক জন একসাথে হলে ভাবি এখানে তাবু টাঙানো গেলে ভালো হতো। একদিন এ কথা বলে বসলাম যুবায়ের কে। তবে কথার শেষ অংশে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। ঠিকই তো বললো যে যুগ চলছে তাতে বাড়ি ছেড়ে এখানে তাবু টাঙানো হলে নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীর লোক অথবা মাদক চোরাচালানকারি হিসেবে জেলে দেবে। এজন্য আর তাবু টাঙানো হয় না। তবে একদিন আশা রাখি তাবু টাঙাবো সে পৃথিবী হোক বা পরকালে । কথা হতে ছিল ঘুঘু পাখি কে নিয়ে। এই ঘুঘু পাখি কে খুঁজতে গিয়ে দেখা মিললো শিউলি ফুলের। এখন তো সময় জানা অজানা পাখপাখালির আগমন ফুলের সমারোহের। পাখির গল্প করতে করতে সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।
.
.
পড়ন্ত বিকেলে যদি বৃষ্টি পড়তো এবং সেই সাথে আবু ওবায়দার আস সুবহু বাদা অথবা সময়ের কফিনের গান টা আস্তে আস্তে যদি চলতো তাহলে কেমন হতো ! তাহলে ব্যাপার টা খুবই রোম্যান্টিক হত। মুখোমুখি গান টাও শোনা যেতে পারে। অবশ্য ঝুম বৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন সাথে শীতশীত বাতাস। এসময় কিছু খেতে পারলেও মন্দ হয় না৷ এত কিছু ভাবতে ভাবতে এখানেই ঘুম চলে আসলো। দূররররর থেকে বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ...

একদিন ছুটি হবে নিরুদ্দেশে...
Journey of pursuing the infinity....

Reference–

•[১] তাজরিয়ান আলম আয়াজ

•বই–
•রৌদ্রমখুর বৃষ্টিমুখর
•সবুজ রাতের কোলাজ
• রুপসী বাংলা

পঠিত : ৪০১ বার

মন্তব্য: ০