Alapon

কুরআন কি বিজ্ঞানসম্মত, নাকি তারও ঊর্ধে...



কুরআন কথা বলে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে - মানব দৃষ্টিকোণ এবং আল্লাহর দৃষ্টিকোণ। এই দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতগুলো কথা বলে। কখনো কখনো আয়াতগুলো কথা বলে আপনার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী। আপনি পর্যবেক্ষণ করেন যে, রাত্রি সূর্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে এরকমই মনে হয় এবং এভাবেই কুরআন এটাকে বর্ণনা করেছে। কখনো আল্লাহ কথা বলেন তাঁর নিজের দৃষ্টকোণ থেকে। আর সেই দৃষ্টিকোণটি বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণেরও ঊর্ধে। অন্য কেউ এই দৃষ্টিকোণের অধিকারী নয়।

আর এরকম সাধারণত দেখা যায় যখন তিনি আধ্যাত্মিক বাস্তবতা নিয়ে কথা বলেন; এমন বাস্তবতা যা আমাদের দৃষ্টি-ক্ষমতার অনেক ঊর্ধে। এভাবেই আল্লাহ তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলেছেন। আর তিনি যখন তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলেন, এর মাধ্যমে তিনি শুধু আমাদেরকে জানিয়ে দেন যে, এই বাস্তবতা তোমাদের অনুধাবন করা সম্ভব না, এটা সম্পর্কে তোমরা তেমন কিছুই জানো না।

একটি বিষয় হোলো, স্বাভাবিক ভাষার ক্ষেত্রে, জনসাধারণে প্রচলিত ভাষার ক্ষেত্রে, আমরা বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় কথা বলি না। এভাবে মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে না। এটা ঠিক যে আমরা বৈজ্ঞানিক যুগে বসবাস করছি। কিন্তু তার পরেও আমরা বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় কথা বলি না। যদি কেউ অন্য কাউকে অপমান করে আর আপনি বলেন যে, “তাকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে”। বৈজ্ঞানিকভাবে এখানে কোনো পোড়া দাগ দেখা যাচ্ছে না। আপনাকে এ্যম্বুলেন্স ডাকতে হবে না। কিন্তু তার পরও আপনি বলেন সে জ্বলে যাচ্ছে।

মানুষের ভাষা এরকমই। আমরা ব্যবহার করি উপমা, আমরা ব্যবহার করি উদাহরণ, আমরা ব্যবহার করি রূপক, আমরা এমন ক্রিয়াপদ ব্যবহার করি যা কখনো ভিন্ন জিনিসের ইঙ্গিত প্রদান করে; তাই না ? যেমন, “বাস্কেটবল খেলায় সে আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে”, “দৃশ্যটা যখন দেখলাম, আমি মারা গেলাম”, ইত্যাদি। আপনি মারা যাননি, স্পষ্টভাবেই আপনি এখনো জীবিত আছেন। আমরা এই ধরণের কথা বলে থাকি। এই বিষয়ে আমার প্রিয় উদাহরণটি হোলো, যখন দাদা-দাদীরা বলেন, “নাতি-নাতনীরা আমার হৃদয় চুরি করেছে”। হৃদয়টি কিন্তু এখনো এখানেই রয়েছে, আলহামদু লিল্লাহ।

তো এখানে মূল বিষয় হোলো, আমাদেরকে এতো বেশী আচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে কুরআনে বৈজ্ঞানীক তত্ত্ব খুঁজতে যাওয়া উচিৎ না। হ্যাঁ, হয়তো এটাতে কিছু বৈজ্ঞানীক তত্ত্ব রয়েছে। কিন্তু এরকম করাটা অতি-আচ্ছন্নতা; কারণ সাধারণত আমরা মনে করে থাকি যে এই যুগে জীবন সম্পর্কে চিন্তা করার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই হোলো উৎকৃষ্টতম পন্থা। তাই কুরআন যুক্তিসম্মত হবে যদি আমরা বেশি থেকে বেশি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কুরআনে খুঁজে পাই - এটা দুর্বল চিন্তাপদ্ধতি। এর ফলে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়ে যায় যে, যে কোনো ভাবে, আল্লাহর বাণীকে আধুনিক বিজ্ঞানের মান অনুযায়ী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত এটা তা না করে, এটা আসলে ততোটা শক্তিশালী বিবেচিত হবে না, অথবা এটা খুব একটা সন্তোষজনক হবে না।

এটা একটা সমস্যাজনক চিন্তাপদ্ধতি; বেশ কয়েকটি কারণে। কারণ, বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞান পরিবর্তিত হচ্ছে এক শতাব্দী থেকে পরের শতাব্দীতে, এরপর পরের শতাব্দীতে। বল এবং গতি নিয়ে এখনকার সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব, অথবা, পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্বগুলোই হয়তো একশ বছর পরে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে; আমরা জানি না। কারণ একশ বছর আগেরগুলোও সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। আর সেই সময়, পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানীগণ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত ছিলেন যে, এটাই হোলো সত্য। তখন কেউ তাদের সাথে দ্বিমত করলে এর জন্য সে নির্বোধ সাব্যস্ত হোতো। আর সেই একই তত্ত্বগুলো এই যুগে রূপকথা হিসেবে বিবেচিত। তো আমরা যদি কুরআনকে বিজ্ঞানের সাথে গেঁথে ফেলি কুরআনের অলৌকিকতা প্রদর্শণ করার জন্য, আর তারপর যদি বিজ্ঞান স্থান পরিবর্তন করে সামনে যায়, তখন আমরা কুরআনকেও পেছনে ফেলে যাচ্ছি।

কারণ এর ফলে আপনি কুরআনকে এমন তত্ত্বের সাথে বেঁধে রাখছেন যা আর বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য নয়। হ্যাঁ, হয়তো প্রকৃতি এবং বিজ্ঞান নিয়ে খুবই সুস্পষ্ট কিছু বিষয় রয়েছে যা থেকে আমরা হয়তো বলতে পারি যে, এখানে কিছুটা যোগসূত্র রয়েছে। যেমন উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ বলেছেন, চাঁদ হোলো সূর্যের অনুগত। যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোটামুটি সত্য। চাঁদের আলো সূর্যের আলোর উপর নির্ভরশীল, এটা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে। আর মাধ্যাকর্ষন শক্তির বিবেচনায়, সূর্য হোলো সৌরজগতে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সত্ত্বা, আর অন্য সবকিছু তার অধীনস্ত, সেগুলো এটার অনুসরণ করছে। তো এই বিবেচনায় এটা সত্য। কিন্তু এটাকে এর থেকে আরো দূরে নিয়ে যাওয়া হোলো সমস্যাজনক। অথবা এটা ব্যবহার করে এরকম বলা যে, এর দ্বারা কুরআন এমন সত্য প্রকাশ করছে যা এর আগে অন্য কেউ আবিষ্কার করেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, এই পথে অগ্রসর হওয়াটা বিপদজনক।

তাহলে কুরআনের মুজেযাটি আসলে কোথায় ? কুরআনের মুজেযার বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত হোলো, এটা সময়ের উর্ধে। মুজেযার জন্য এটাকে কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল অথবা সম্পর্কিত করা উচিৎ না। আপনি কুরআনকে সত্যায়িত করতে পারেন এর নিজের মধ্য থেকে, আর তারপর আপনি কুরআনকে সত্যায়িত করতে পারেন বাইরের কিছু জিনিস দ্বারা। বিজ্ঞান হোলো বাইরের জিনিস। কুরআনের প্রথম সত্যায়ন হোলো এর নিজের মধ্য থেকে, এর নিজের বক্তব্যের মধ্যে, এর নিজের শক্তিশালী বাণীতে, এর নিজের ভাষাগত মাধুর্য্যে - এমন কিছু এতে রয়েছে যা সময়ের উর্ধে; কেউ যদি তা নিয়ে গভীর চিন্তা করে, সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا ; তার মধ্য এই প্রত্যয় জন্মাবে যে এটা শুধুই সৃষ্টিকর্তার বাণী। অর্থাৎ এর অন্তর্নিহিত যুক্তিগুলিই হোলো এর মৌলিক যুক্তি।

তারপর আসছে দ্বিতীয় স্তর। দ্বিতীয় স্তরটি হোলো, سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ, অর্থাৎ, আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ তাদেরকে প্রত্যক্ষ করাবেন দিগন্তজুড়ে, এবং তাদের হৃদয়ের গহীনেও, যতক্ষণ না তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে এটাই প্রকৃত সত্য। অন্য কথায়, কিছু জিনিস আল্লাহ আমাদের নিজেদের সম্পর্কে বলছেন। কিছু জিনিস আল্লাহ বলছেন আমাদের চারপাশের জগতের প্রকৃতি এবং ইতিহাস নিয়ে, যা নিজে থেকে প্রকাশিত হবে, যা সত্যে পরিণত হবে। আর যখন এগুলো সত্যে পরিণত হবে, মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে উঠবে যে, এটাই আসলে সত্য।

কিন্তু আমি যদি এগুলোকে সাজাই, তহলে কুরআনের প্রথম মহা-যুক্তি হোলো এটি নিজে। কুরআনের দ্বিতীয় মহা-যুক্তি হোলো, যেভাবে এটা আমাদের মানব-প্রকৃতিতে অনুরণিত হয়। মানব যুক্তি নয়, বরং মানব-প্রকৃতি। এটা আপনার সাথে এমনভাবে কথা বলে যে, আপনার ভেতর থেকে কিছু একটা বলে ওঠে - এটাই সত্য। এটাই আমি সবসময় অনুভব করে এসেছি। এটার প্রতিই আমি সবসময় অনুরক্ত হয়েছি। এটাকে বলা যায় আধ্যাত্মিক যুক্তি; এটা গাণিতিক যুক্তি নয়। এটা এমন কিছু যা আল্লাহ আমাদের ভিতরে দিয়ে দিয়েছেন।

- নোমান আলী খান

পঠিত : ১৮৯ বার

মন্তব্য: ০