Alapon

জান্নাতের পাখি জাফর রাঃ

ইসলাম গ্রহণ মানেই তো এক অন্য জীবন! ইসলাম গ্রহণ মানেই তো এক আলোকিত পথ। আলোকিত, কিন্তু মসৃণ নয়। কংকর বিছানো, কাঁটা ছড়ানো, পাথরের পর্বত ডিঙানো- কত রকমের বন্ধুর পথ মাড়িয়ে, কতশত অগ্নিপরীক্ষায় পাস করে তবেই না পৌঁছানো যায় এই পথের কাঙ্ক্ষিত মনজিলে!

একথা সে সময়ে প্রত্যেক মুসলমানই জানতেন। জানতেন জাফর এবং তার স্ত্রীও। ইসলাম গ্রহণের ফলে সেই সময়ে অন্য মুসলমানের ওপর যে ধরনের শারীরিক, মানসিক এবং বহুমুখী নির্যাতন নেমে এসেছিল, সেইসব নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হলো তাদেরও।

তখন চলছে কুরাইশদের মধ্যে চিরুনি অভিযান। কে মুসলমান হলো? খবর নাও। ধর তাকে। মারো তাকে। নির্মূল করে ফেল তাকে পৃথিবী থেকে। এ ধরনের অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হলেন আল্লাহর রাসূল সাঃ এর চাচা আবু তালিবের ছেলে জাফরও।

এমনি এক দুঃসময়ে তিনি, তার স্ত্রী এবং আরো কিছু সাহাবা চলে গেলেন প্রাণপ্রিয় রাসূলের (স) কাছে। নবীর কাছে তারা সবাই হিজরাতের অনুমতি চাইলেন। আবেদন শুনে রাসূল (স) তাদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরাতের অনুমতি দিলেন। 

দিলেন বটে! কিন্তু অত্যন্ত ব্যথাভরা হৃদয়ে। কিসের ব্যাথা? ব্যাথা একটিই। রাসূলের (স) হৃদয়কে আকুল কর তুলছে বারবার। ভাবছেন- এই তো, এই সেই মাটি, এই তো সেইসব গৃহ, পথপ্রান্তর, আলো-বাতাস, যেখানে এরা ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যেখানে এরা পেরিয়ে এসেছে শৈশব, কৈশোর। আজ, সেই আপনভূমি ছেড়ে এদেরকে পাড়ি দিতে হচ্ছে অজানার পথে! বিদেশ বিভূঁইয়ে! এরচেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে!

কিন্তু এদের অপরাধ কি? কোন অপরাধে এদের ছাড়তে হচ্ছে প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি?অপরাধ আর কিছু নয়। সে কেবল ইসলাম গ্রহণ। সত্য গ্রহণ। একমাত্র ইসলাম গ্রহণের ফলেই এদেরকে ছাড়তে হচ্ছে স্বদেশ। রাসূলের (স) জন্যে ছিল এটা একটা আফসোসের বিষয় বটে।

জাফর চলছেন তার সাথীদের নিয়ে। কাফেলাটি এগিয়ে চলেছে আবিসিনিয়ার দিকে।তার নেতৃত্বে একসময় তারা পৌঁছে গেলেন হাবশায়। আশ্রয় নিলেন সেখানকার সৎ এবং দরদী নাজ্জাশীর দরবারে।

নাজ্জাশীর দরবারে আশ্রয় লাভ করে তারা হাঁপ ছাড়লেন। কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন। নাজ্জাশীর দরবার কোনো শংকা নেই, কোনো ভয় নেই, নেই কোনো সংকোচ। বরং প্রাণ খুলে তারা এখানে মহান রাব্বুল আলামীনের ইবাদাত করার সুযোগ পেলেন।

মক্কার কুরাইশ কাফেরা তখনো ক্ষিপ্ত। তখনো তারা কূট-কৌশল আর ষড়যন্ত্র থেকে পিছিয়ে নেই। কী কৌশলে আবিসিনিয়ায় হিজরাতকারী ঐসব মুমিন-মুসলিমকে হত্যা করা যায়? কিংবা ফিরিয়ে আনা যায়? কিভাবে? অনেক ভাবলো তারা।

যত না ভাবলো, তার চেয়েও বেশি বিস্তার করলো ষড়যন্ত্রের জাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ষড়যন্ত্রই তাদের কাজে এলো না। সবই বিফল হল সত্যের কাছে। সাহসের কাছে। রাব্বুল আলামীনের ফয়সালার কাছে।

সত্যিই তো, কাফের মুশরিক কিংবা ইসলামের শত্রুদের কোনো ষড়যন্ত্রই শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে না। সফল হয় কেবল আল্লাহর রহমত এবং ফয়সালা। আবিসিনিয়ায় হলোও তাই। চক্রান্তকারীরা ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে এলো।

জাফর এবং তার স্ত্রী হাবশার নাজজাশীর দরবারে পরম যত্নে, পরম সম্মানের সাথে, নিশ্চিন্তে এবং নিরাপতে একে একে দশটি বছর পার করে দিলেন।

দশ বছর পর। সপ্তম হিজরিতে জাফর তার স্ত্রীসহ আরো কিছু মুসলমান আবিসিনিয়া থেকে ইয়াসরিবের (মদীনা) দিকে যাত্রা করলেন।

কী বিস্ময়কর ব্যাপর! তারাও মদীনায় পৌঁছলেন আর এদিকে রাসূলও (সা) খাইবার বিজয় শেষ করে মদীনায় ফিরলেন। জাফরকে দেখে রাসূল (স) এত খুশি হলেন যে তার ‍দু’চোখের মাঝখানে চুমু দিয়ে দয়ার নবীজী (স) আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, আমি জানিনে, খাইবার বিজয় আর জাফরের আগমন- দুটির কোনটির কারণে আমি আজ এত বেশি খুশি।

রাসূলের (স) ভালোবাসা, আদর আর সাগর সমান স্নেহে ধন্য এই জাফরই তো শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছিলেন অসীম সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখে। যুদ্ধে তার দু’টি হাতই কেটে পড়ে গিয়েছিল। তার শাহাদাতের পর হযরত জিব্রাঈল আঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলকে (সা) জানান সে সুসংবাদ।

তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা জাফরকে তার কর্তিত দু’টি হাতের বদলে দান করেছেন দু’টি রক্তরাঙা হাত। তিনি এখন জান্নাতে ফেরেশতাদের সাথে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন।

আল্লাহর দেয়া নতুন দু’টি হাত নিয়ে জাফর ফেরেশতাদের সাথে বেহেশতে কবুতরের মত উড়ে বেড়াচ্ছেন!- বিষয়টি হয়তো আমরা আগেও জেনেছি। কিন্তু আমরা কি জানি, এই জাফরই আবার ব্যক্তিজীবনে কী অসাধারণ এক মানুষ ছিলেন?

আবু হুরাইরার (রা) বর্ণনায় আমরা তার যে সামান্য ইঙ্গিত মাত্র পাচ্ছি- তাওতো বিরল এক দৃষ্টান্ত। তিনি বলেছেন: ‘আমাদের মিসকিন সম্প্রদায়ের প্রতি জাফর ছিলেন অত্যন্ত সদয় এবং দয়ালূ। আমাদের সংগে নিয়ে তিনি বাড়িতে যেতেন। তার বাড়িতে যে খাবার থাকতো তা আমাদের খাওয়াতেন। যখন খাবার শেষ হয়ে যেত তখন তার ঘি-এর মশকটি বের করে আমাদের দিতেন। মশকটির ঘি শেষ হলে সেটা ফেঁড়ে তার ভেতরের গায়ে যেটুকু লেগে থাকতো, তাও আমরা চেটে-পুটে শেষ করে ফেলতাম।’

এমনই ছিল জাফরের উদার হৃদয়! আর মানুষ হিসেবে? রাসূল (স) নিজেই বলতেন:
‘আমার আগে যত নবী এসেছেন তাঁদের মাত্র সাতজন বন্ধু দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমার বিশেষ বন্ধুর সংখ্যা চৌদ্দ এবং জাফর তার একজন।’

কী অসাধারণ উচ্চারণ রাসূলের (সা)! কী এক দরদভরা কণ্ঠ দয়ার নবীজীর (সা)! অপূর্ব এক বিস্ময়ে ভরা জীবন ছিল হযরত জাফরের! যেন নীলে ঢাকা বিশাল আকাশ।– সেই আকাশের বুকে জেগে আছে সোনার থালার চেয়েও উজ্জ্বল এক গ্রহ! যখন ঘুমিয়ে আছে পৃথিবী। যখন ঘুমিয়ে আছি এবং সকলেই। তখনো তিনি- সেই সোনার গ্রহ- হযরত জাফর জেগে আছেন, উড়ছেন এবং হাসছেন!

আমরা কি তার সেই হাসির শব্দ শুনতে পাই? আমরা কি তার সেই উজ্জ্বল বাহু দু’টি দেখতে পাই? রাসূলের (সা) নির্দেশ মত, আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান মত চললেই কিন্তু আমরা সে সবই দেখতে পাব। দেখতে পাব আমাদের অনুভবে, আমাদের সবুজ হৃদয়ে। চোখ বন্ধ করলেই কিংবা ঘুমের মধ্যেও দেখতে পাব সেই সোনালি গ্রহের ছায়া।

এর জন্য আমাদের প্রয়োজন কেবল রাসূলের (সা) পথ অনুসরণ করা এবং জাফরের মত সর্বস্ব ত্যাগের এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। কাজটি হয়তো সহজ নয়।– কিন্তু তাই বলে আবার অসাধ্যও কিছু নয়। আল্লাহর খুশি ছাড়া, রাসূলের (সা) ভালোবাসা ছাড়া আমাদের আর কিইবা চাইবার থাকতে পারে?

আর এমন কিইবা আছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের খুশির চেয়ে মূল্যবান? হযরত জাফরের মত আল্লাহর পথে জীবন দিয়ে গ্রহ কিংবা গ্রহের ছায়া হয়ে ওঠা- সত্যিই এক দারুণ সৌভাগ্যের ব্যাপার।

পঠিত : ২২১৮ বার

মন্তব্য: ০