Alapon

কুরআনের আলোকে জাহিলি যুগের হজ ও মহানবী (সা.)-এর বৈপ্লবিক সংস্কার




হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সময়েই আল্লাহ তাআলা হজের বিধান দিয়েছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে মানুষ তাতে ব্যাপক বিকৃতি সাধন করে। এক সময় কাবাঘরে মূর্তি স্থাপন করে সেই বিকৃতির চূড়ান্ত রূপ দেয়। ইবরাহিম (আ.)-এর পর থেকে ইসলামের আগ পর্যন্ত এই যুগটিকে ইসলামের ইতিহাসে জাহিলি যুগ হিসেবে চিত্রিত করা হয়।

তখন আরবের নেতৃস্থানীয় গোত্রগুলো ছোট-ছোট সমমনা গোত্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় হজ করতে রওনা হতো। সেকালের কবিরা গোত্রের বীরদের সাহস, কীর্তি, মর্যাদা, শক্তি ও বদান্যতার প্রশংসা করত। একই সঙ্গে অন্য গোত্রগুলোর কাপুরুষতা, কৃপণতা, দুর্বলতা ইত্যাদি নিয়ে অতিরঞ্জিত বয়ান হাজির করত এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত। গোত্রগুলোর মধ্যে দান-সদকা ও বদান্যতার প্রতিযোগিতা চলত।

নিজেদের সেরা প্রমাণ করতে গোত্র সর্দারেরা এখানে-ওখানে বড় বড় কড়াই বসাত। একের পর এক উট জবাই করত। মাংস রান্না করে হজযাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দিত। এত বদান্যতার পেছনের কারণ ছিল—পুরো আরবে তাদের নাম উচ্চকিত হবে, এই সুপ্ত বাসনা। এই গোত্র এত এত উট জবাই করেছে এবং এত এত মানুষকে খাইয়েছে—এটি জানান দিয়ে মানুষের প্রশংসা কুড়ানোই ছিল গোত্রগুলোর উদ্দেশ্য। পথে পথে গান-বাজনা হতো তখন। অবাধে মাদক গ্রহণ করত মানুষ। অবৈধ যৌনাচার স্বাভাবিক ছিল। আল্লাহর ভয় অন্তরে লালন করেন এমন মানুষের সংখ্যা ছিল নিতান্ত হাতেগোনা। তাওয়াফের বিধান সাত চক্করের বদলে এক চক্কর করা হয়েছিল। নারী-পুরুষ উভয়েই সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করত তখন। তারা বলত, ‘আমাদের মায়েরা যেভাবে আমাদের জন্ম দিয়েছেন, সেভাবেই আমরা আল্লাহর সামনে হাজির হব।’

মাকামে ইবরাহিমে নামাজ আদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হাততালি, বাঁশি বাজানো ও শিঙায় ফুঁক দেওয়ার আচার। তালবিয়া তথা লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইকে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হতো ঠিক, তবে এই পবিত্র স্লোগানও বিকৃত করে ফেলা হয়। তালবিয়ায় পৌত্তলিকতার অনুমোদন সংবলিত কথাও যুক্ত করেছিল জাহিলি যুগের মানুষ। তারা তালবিয়ায় বলত, ‘আপনি যাদের অনুমোদন দিয়েছেন তারা ছাড়া আপনার কোনো অংশীদার নেই। আপনি তাদের প্রভু এবং তারা যা কিছুর মালিক তারও প্রভু।’

কোরবানি আল্লাহর নামেই দেওয়া হতো ঠিক, তবে কোরবানির পশুর মাংস ও রক্ত কাবার দেয়ালে ছিটানো হতো। তাদের বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ রক্ত-মাংস দুটোই চান। হজের মৌসুম হিসেবে পরিচিত চার মাস—শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ ও মহররমেও তাদের অপকর্ম থামত না। এই মাসগুলোতে তারা যুদ্ধ বাঁধাত। পবিত্র মাসে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বলত, ‘এই মাসে যুদ্ধ করে নিই, আগামী বছর আরেকটি মাস কাফফারা হিসেবে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকব।’

এক শ্রেণির ধার্মিক ছিল, যারা হজের পথ পাড়ি দেওয়ার পাথেয় জোগাড় না করেই হজ করতে বেরিয়ে পড়ত। পথে পথে ভিক্ষা করতে করতেই তারা মক্কায় পৌঁছাত। এই ভিক্ষাবৃত্তিকে তারা দীনদারি মনে করত। তাদের দাবি ছিল, তারা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী তথা মুতাওয়াক্কিলদের দলভুক্ত। তাই আল্লাহর ঘরে যেতে তাদের কোনো পাথেয় জোগাড় করার দরকার নেই।

হজের যাত্রাপথে জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা করা বা অন্য কোনো কাজ করাকে হারাম মনে করা হতো। কেউ আবার পানাহার থেকেও বিরত থাকত এবং একে হজের অংশ মনে করত। কেউ কেউ হজের সময়জুড়ে কথা বলা থেকেও বিরত থাকত।

এভাবেই প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে চলছিল হজের বিকৃত আচার-অনুষ্ঠান। এই দীর্ঘ সময়ে আরবে কোনো নবীর জন্ম হয়নি, বাইরের কোনো নবীর শিক্ষাও আরবে পৌঁছায়নি। অবশেষে ৫৭০ সালে ইবরাহিম (আ.)-এর বংশ থেকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম হয় এবং ৪০ বছর বয়সে নব্যুয়ত পান। তিনি ইবরাহিম (আ.)-এর সময়ের হজ ও কোরবানির বিধানগুলোতে ফের প্রাণের সঞ্চার করেন।

মহানবী (সা.) জাহিলি যুগের সব কুসংস্কার ও মূর্তিপূজার রীতি বিলুপ্ত করেন। কাবাঘরের সব মূর্তি ভেঙে ফেলা হয় এবং সেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করা নিষিদ্ধ করা হয়। হজকে ঘিরে সব ধরনের কৌলীন্য, কুসংস্কার ও কুপ্রথা রহিত করা হয় এবং অনৈতিকতা ও অশ্লীলতায় ভরা মক্কার আনন্দমেলাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আসমানি আদেশ আসে, আল্লাহর নির্দেশিত পথেই আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। নবী (সা.) বলেছেন,
‘হজের আচার-অনুষ্ঠান তোমরা কেবল আমার কাছ থেকেই গ্রহণ করো।’ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা হজের সময় সব ধরনের অশ্লীল ও অনৈতিক কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরশাদ হয়েছে, ‘হজের সময় কোনো অশ্লীল কাজ ও ঝগড়া-বিবাদ করা যাবে না।’ (সুরা বাকারা: ১৯৭)


বংশের গৌরব নিয়ে কবিদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলত, তাও বন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
‘এরপর যখন হজের আচার-অনুষ্ঠান শেষ করবে, তখন আল্লাহর স্মরণে মশগুল হও, যেমন তোমরা নিজেদের বাপ-দাদাদের স্মরণে মশগুল থাক; বরং তার চেয়েও বেশি স্মরণ করো।’ (সুরা বাকারা: ২০০)


স্রেফ নাম-যশের জন্য বদান্যতার যে প্রতিযোগিতা চলত, তাও বন্ধ হয়ে যায় এবং এর বদলে ইবরাহিম (আ.)-এর সময়ের রীতিনীতিগুলো চালু হতে থাকে। আল্লাহর নামে জবাই করা পশুগুলো গরিব-অসহায় হজযাত্রীরা খাবার হিসেবে পেতে লাগলেন।

এ সম্পর্কেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
‘খাও ও পান করো, তবে অপচয় কোরো না। অপচয়কারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ: ৩১)
অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং যখন এসব প্রাণী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে, তখন এগুলোর ওপর (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। যখন তা এক পাশে পড়ে যায় (মারা যায়), তখন তা থেকে খাও। যারা (ভিক্ষা না করে) তৃপ্ত থাকে তাদেরও খাওয়াও এবং যারা আকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা করে তাদেরও খাওয়াও।’ (সুরা হজ: ৩৬)

কোরবানি করার পর পশুর রক্ত-মাংস কাবার দেয়ালে ছিটানোর রীতিও বন্ধ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘আল্লাহর কাছে ওগুলোর গোশতও পৌঁছে না, রক্তও পৌঁছে না; বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।’ (সুরা হজ: ৩৭)


উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করার রীতিও আল্লাহর নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে বলেন,
‘বলো, যেসব সৌন্দর্য-শোভামণ্ডিত বস্তু (কাপড়) ও পবিত্র জীবিকা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন—তা কে হারাম করল?’ (সুরা আরাফ: ৩২)

যে পবিত্র মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম, সেগুলোকে হালাল বানানোর মতো স্বেচ্ছাচারও কঠোরভাবে নিষেধ করে দেওয়া হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘নিষিদ্ধ মাসকে পিছিয়ে দেওয়া কুফরির ওপর আরেক কুফরি কাজ, এর মাধ্যমে কাফিরদের পথভ্রষ্ট করা হয়। এক বছর তারা একটি মাস হালাল করে, আরেক বছর ওই মাসকে হারাম করে, যাতে আল্লাহর হারাম করা মাসগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করা যায়।’ (সুরা তাওবা: ৩৭)


হজে যাওয়ার পাথেয় জোগাড় না করেই বের হয়ে পড়াও নিষিদ্ধ করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘তোমরা (হজের জন্য) পাথেয়র ব্যবস্থা করবে। (কারণ পৃথিবীর কোনো ভ্রমণের জন্য পাথেয় না নেওয়া পরকালের পাথেয় নেওয়ার সমার্থক নয়।) আর আল্লাহর ভয়ই (পরকালের) শ্রেষ্ঠ পাথেয়।’ (সুরা বাকারা: ১৯৭)

হজের যাত্রাপথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে উপার্জন করা হারাম মনে করার ধারণাও বাতিল করা হয়। এরশাদ হয়েছে, ‘
তোমাদের কোনো গুনাহ নেই—যদি তোমরা (ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে) তোমাদের রবের অনুগ্রহ খোঁজ করো।’ (সুরা বাকারা: ১৯৮)

একইভাবে হজের সময় পানাহার ও কথা থেকে বিরত থাকার রীতিও বাতিল করা হয়।
জাহিলি যুগের এসব কুপ্রথা বাতিল করে ইসলাম হজকে দীনদারি, তাকওয়া, শুদ্ধতা, সরলতা ও নিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। হজযাত্রীরা যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, তখনই তাদের পার্থিব সব দূষণ, যৌনতা, অশ্লীল কথাবার্তা ও কাজকর্ম থেকে বিরত থাকার আদেশ দেওয়া হয়।

মিকাত থেকে ইহরাম পরতে হয়। দুই টুকরো সাদা কাপড় পরে মানুষ ভুলে যায় দেশ, জাতি, গোত্র, বর্ণের ভেদাভেদ। ইহরাম অবস্থায় সব ধরনের পশুপাখি শিকার করাও হারাম। শান্তির পরিবেশ তৈরি করতে এবং হজযাত্রীদের মন আধ্যাত্মিকতায় ভরিয়ে তুলতেই এই আদেশ দিয়েছে ইসলাম।

হজের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহকেই স্মরণ করা হয়। হজের একমাত্র স্লোগান—তালবিয়া। তালবিয়ার মর্ম হলো—
‘আমি আপনার দরবারে হাজির, হে আল্লাহ। আমি হাজির, আমি হাজির। আপনার কোনো অংশীদার নেই। আমি হাজির। সব প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই। সার্বভৌমত্ব আপনারই। আপনার কোনো অংশীদার নেই।’

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বচ্ছ, সুন্দর, নিঃস্বার্থ ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হজ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর জন্য হজ করে এবং যৌনতা ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকে, সে সদ্যোজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

পঠিত : ১৩০ বার

মন্তব্য: ০