Alapon

পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী আদর্শের পার্থক্য




ইউরোপে যেসব ধারণা-কল্পনা এবং যেসব নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ স্থাপিত ও বিকশিত হয়ে হয়েছে, তা থেকে একথা অনস্বীকার্যরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, তা সবই মানবতার পক্ষে নিঃসন্দেহে মারাত্মক। এসব নীতি ও ধারণা মানুষকে পাশবিকতা-চরম হিংস্রতার পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। যা আল্লাহর পৃথিবীকে জুলুম-পীড়ন ও রক্তপাতে জর্জরিত করে দেয় এবং মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ প্রতিরোধ করে। আদিকাল থেকে আল্লাহর প্রেরিত নবীগণ দুনিয়াতে যে মহান উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করেছেন, পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের এ নীতি তা সব ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আল্লাহর শরীয়াত যে উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় এসেছে, যেসব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও আদর্শ নিয়ে আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে, উপরোক্ত শয়তানী নীতি তার প্রতিরোধকারী। এটা মানুষকে সংকীর্ণমনা, সংকীর্ণ দৃষ্টি ও হিংসুক করে দেয়। এটা জাতি ও বংশসমূহকে পরস্পরের প্রাণের দুশমন বানিয়ে সত্য, ইনসাফ ও মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ করে দেয়। বৈষয়িক শক্তি ও পাশবিক বলকে এটা নৈতিক সত্যের স্থলাভিষিক্ত করে ইলাহী শরীয়তের মর্মমূলে কঠিন আঘাত হানে।

মানুষের পরস্পরের মধ্যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে বিশাল ও ব্যাপক কর্মক্ষেত্রে পরস্পরের সাহায্যকারী ও সহানুভূতিশীল বানিয়ে দেয়া ইলাহী শরীয়তের চিরন্তন উদ্দেশ্য। কিন্তু জাতীয়তাবাদ বংশীয়-গোত্রীয় ও ভৌগলিক বৈষম্যের ক্ষুরধার তরবারী দ্বারা এসব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় এবং জাতীয় হিংসা-দ্বেষ সৃষ্টি করে মানুষকে পরস্পরের শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করে।

মানুষের পরস্পরের মধ্যে যথাসম্ভব স্বাধীন সম্পর্ক ও সম্বন্ধ স্থাপনের উদার অবকাশ সৃষ্টি করাই ইলাহী শরীয়তের লক্ষ্য। কারণ মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা এরই উপর নির্ভর করে। ফলে এক জাতীয়তাবাদ এ সম্পর্ক-সম্বন্ধ স্থাপনে প্রবল বাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে এক জাতির প্রভাবান্বিত এলাকার অপর জাতির পক্ষে জীবন ধারণ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

খোদায়ী শরীয়তের লক্ষ্যবস্তু হলো প্রতিটি ব্যক্তি; প্রতিটি জাতি এবং প্রতিটি প্রজন্ম তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং জন্মগত যোগ্যতা লালন করার পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা লাভ করুক, যাতে সামগ্রিকভাবে মানবতার উন্নতি বিধানে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ প্রতিটি জাতি আর প্রতিটি প্রজন্মের মধ্যে এমন প্রেরণা সৃষ্টি করে, যাতে সে শক্তি অর্জন করে অন্য জাতি আর প্রজন্মকে তুচ্ছ, মূল্যহীন এবং হেয় সাব্যস্ত করত: তাদেরকে দাসে পরিণত করে তাদের জন্মগত যোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়ে কাজ করার সুযোগই না দেয়; বরং তাদের বেঁচে থাকার অধিকারই হরণ করে ছেড়ে দেয়।

খোদায়ী শরীয়তের শীর্ষ মূলনীতি এই যে, শক্তির পরিবর্তে নৈতিকতার উপর মানবাধিকারের ভিত্তি স্থাপিত হোক; এমন কি একজন শক্তিধর ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দুর্বল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অধিকার আদায় করবে যখন নৈতিক বিধান তাতে সমর্থন জ্ঞাপন করে। পক্ষান্তরে এর বিপরীতে জাতীয়তাবাদ এ নীতি প্রতিষ্ঠা করে যে, শক্তিই হলো সত্য, (Might is right) এবং দুর্বলের কোনো অধিকার নেই। কারণ অধিকার আদায় করার ক্ষমতা তার নেই।

খোদায়ী শরীয়ত যেমনি নৈতিকতার সীমারেখার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশের বিরোধী নয়, তেমনিভাবে তা জাতি সত্তার লালনেরও বিরোধী নয়। মূলতঃ ইলাহী শরীয়ত এজন্য সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। কারণ এক একটি জাতির স্ব স্ব স্থানে উন্নতি-অগ্রগতি সাধনের উপরই এমনভাবে জাতিকে লালন করতে চায়; যা বৃহত্তর মানবতার (Humanity at Large) প্রতি সহানুভূতি, সহায়তা এবং কল্যাণকামিতা নিয়ে অগ্রসর হয় এবং এমন ভূমিকা পালন করে, সমুদ্রের জন্য নদী যে ভূমিকা পালন করে। পক্ষান্তরে জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে এমন মানসিকতা সৃষ্টি করে, যার ফলে সে তার যাবতীয় শক্তি-সামর্থ সকল যোগ্যতা-প্রতিভা কেবল স্বজাতির শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নির্ধারণ করে নেয় এবং বৃহত্তর মানবতার সহায়ক হবে না কেবল তা-ই নয়ম বরং স্বজাতির স্বার্থের বেদীতে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থ বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করবে না। ব্যক্তিগত জীবনে ‘আত্মস্বার্থে’র যে স্থান, সামাজিক জীবনে সে স্থান ‘জাতিপূজার’। একজন জাতীয়তাবাদী স্বভাবতই সংকীর্ণমনা হয়ে থাকে। সে বিশ্বের তাবৎ রূপ-সৌন্দর্য আর গুণ-বৈশিষ্ট্য কেবল স্বজাতির আর স্ব-গোত্রের মধ্যে দেখতে পায়, অন্যান্য জাতি আর বংশ গোত্রের মধ্যে সে এমন কোনো মূল্যবান বস্তু দেখতে পায় না, যার টিকে থাকার অধিকার রয়েছে। এহেন মানসিকতার চূড়ান্ত প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই জার্মানীর জাতীয় সমাজতন্ত্রে। হিটলারের ভাষায় জাতীয় সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা হলো :
“যে কোনো ব্যক্তি যে জাতীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে এতোটা উর্দ্ধে তুলে ধরার জন্য প্রস্তুত, যার ফলে তার কাছে স্বজাতির মঙ্গল ও কল্যাণের উর্ধে আর কোনো কিছুই থাকতে পারে না। এবং যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত Germany above all-জার্মানী সকলের ঊর্ধে-একথার তাৎপর্য ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নিতে সক্ষম হয়েছে অর্থাৎ এ বিশাল বিস্তীর্ণ বিশ্বে জার্মান দেশ ও জাতির চেয়ে উন্নত কোনো বস্তু তার দৃষ্টিতে প্রিয় ও সম্মানযোগ্য থাকতে পারে না। এমন ব্যক্তিই হবে ন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট।”


আত্মচরিত ‘আমার সংগ্রাম’ -এ হিটলার লিখেন :
“মহাবিশ্বে মূল্যবান যা কিছু আছে-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং আবিষ্কার-উদ্ভাবন-এসব কিছুই গুটিকতেক জাতির সৃজনশীল প্রতিভার ফলশ্রুতি। আর এসব জাতি মূলত একই বংশধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা যদি মানব জাতিকে তিনভাগে ভাগ করি-যারা ষংস্কৃতি গড়ে তোলে, যারা সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে এবং যারা সংস্কৃতি ধ্বংস করে – তাহলে কেবল আর্য বংশই প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত হবে।”


এ বংশ গৌরবের ভিত্তিতেই জার্মানীতে অনার্যদের জীবন ধারণ সংকীর্ণ করে তোলা হয়। আর এর উপর জার্মানীর বিশ্বজয় দর্শনের ভিত্তি স্থাপিত। একজন জার্মান সোশ্যালিষ্টের মতে বিশ্বে জার্মান জাতির মিশন এই যে, সে নিম্নশ্রেণীর জাতিকে ধ্বংসে পরিণত করার মাধ্যমে সভ্যতা বিস্তারে ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহার করবে। আর এটা কেবল জার্মানীরই বৈশিষ্ট্য নয়, গণতন্ত্রপ্রেমী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এরই ভিত্তিতে বর্ণ বৈষম্য করা হয়। শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীরা কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রোদেরকে মানুষ বলে গণ্য করতে প্রস্তুত নয়। ইউরোপের প্রতিটি জাতির দৃষ্টিভঙ্গীও এটিই। সে দেশ বৃটেন, ফ্রান্স, ইটালী, হল্যাণ্ড যে কোনোটি হোক না কেন।

অতপর এ জাতি পূজাঁর এক অনিবার্য বৈশিষ্ট্য এই দাঁড়ায় যে, এহেন জাতিপূজা মানুষকে স্বার্থপূজারীতে পরিণত করে। পৃথিবীতে শরীয়তী বিধানের অগমন ঘটেছে মানুষকে নীতিবাদীতে পরিণত করার জন্য। ইলাহী শরীয়ত মানুষের কর্মধারাকে এমন স্বতন্ত্র নীতির অনুসারী বানাতে চায়, স্বার্থ আর মনস্কামনার সঙ্গে সঙ্গে যেসব নীতির পরিবর্তন ঘটবে না, পক্ষান্তরে এর ঠিক বিপরীতে জাতিপূজা মানুষকে নীতিহীন করে তোলে। জাতিপূজারীর জন্য স্বজাতির কল্যাণ কামনা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো নীতি নেই। নীতি বিজ্ঞান, ধর্মের বিধান এবং সভ্যতা দর্শন যদি এ উদ্দেশ্যে তার সহায়ক হয় তাহলে সে সানন্দে সেসব নীতির প্রতি ঈমান আনা তথা বিশ্বাস স্থাপন করার দাবী করবে। আর তা এ পথে প্রতিবন্ধক হলে সেসব বিসর্জন দিয়ে অন্য নীতি-দর্শন গ্রহণ করবে।

মুসোলিনীর জীবন চরিতে আমরা একজন জাতীয়তাবদীর চরিত্রের পূর্ণ নমুনা দেখতে পাই। বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সে ছিলো একজন সোশ্যালিষ্ট। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সে কেবল এজন্য সোশ্যালিষ্টদের থেকে পৃথক হয়ে যায় যে, ইটালীর যুদ্ধে যোগদানের মধ্যেই সে জাতীয় স্বার্থ নিহিত রয়েছে দেখতে পায়। কিন্তু যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মধ্যে ইটালী তার কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ লাভ না করতে পেরে সে নয়া ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের পতাকা উড্ডীন করে। এই নতুন আন্দোলনেও সে বারবার নীতির পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। ১৯১৯ সালে সে ছিল একজন লিবারেল সোশ্যালিষ্ট, ১৯২০ সালে হয় এনাকিষ্ট তথা স্বৈরশাসক। ১৯২১ সালে কয়েক মাস পর্যন্ত সে ছিল সোশ্যালিষ্ট এবং গণতান্ত্রিক শ্রেণীগুলোর বিরোধী; কয়েক মাস তাদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। অবশেষে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা নতুন নীতি গড়ে তোলে, বারবার এহেন রংবদল করা, এ নীতিহীনতা এবং এহেন স্বার্থান্বেষীতা কেবল মুসোলিনীরই একক বৈশিষ্ট্য নয়। বরং এটাই হলো জাতীয়তাবাদী প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিগত জীবনে একজন স্বার্থপর ব্যক্তি যা কিছু করতে পারে, একজন জাতীয়তাবাদী জাতীয় জীবনে ঠিক তা-ই করতে পারে। কোনো নীতি দর্শনে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা তার পক্ষে অসম্ভব।

কিন্তু ন্যাশনালিজম এবং ইলাহী শরীয়তের মধ্যে সংঘাত সবচেয়ে খোলাখোলীভাবে আরো এক দিক থেকেও হয়। একথা তো স্পষ্ট যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নবীই আগমন করবেন, কোনো এক জনপদেই তাঁর জন্ম হবে। তেমনিভাবে সে নবীকে যে কিতাব দেয়া হবে, তা অনিবার্যভাবেই সেই জনপদের ভাষায়ই হবে, যে জনপদে তিনি প্রেরিত হয়েছেন। অতপর সে নবুওয়াতের মিশনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী সেসব স্থান সম্মান ও মর্যাদার আসন লাভ করবে, সেসব স্থানও বেশির ভাগ সেই জনপদেই থাকবে। কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একজন নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্যবাণী এবং হিদায়াতের শিক্ষা নিয়ে আগমন করেন তা কোনো দেশ জাতির জন্য সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং তা সকল মানুষের জন্য থাকে । সর্বাব্যাপী গোটা মানবজাতিকে নির্দেশ দেওয়া হয় সে নবী এবং উপস্থাপিত কিতাবের প্রতি ঈমান আনার জন্য। চাই কোনো নবীর মিশন সীমাবদ্ধ হোক, যেমন হযরত হূদ এবং হযরত সালেহ আলাইহিস সালামসহ আরো অনেক, অথবা তাঁর মিশন ব্যাপক হয়, যেমন হযরত ইব্রাহীম এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সর্বাবস্থায় সকল নবীর প্রতি ঈমান আনতে এবং তাঁকে সম্মান করতে সমস্ত মানুষ আদিষ্ট ছিল।

যখন কোনো নবীর মিশন বিশ্বজনীন হয় তখন তো এটা স্বাভাবিক যে, তাঁর উপস্থাপিত কিতাব আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করবে, সে কিতাবের সাংস্কৃতিক প্রভাবও হবে আন্তর্জাতিক, তার পবিত্র স্থানসমূহ কোনো এক দেশে হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করবে। কেবল সে নবীই নয়, বরং তাঁর সঙ্গী-সাথী এবং তাঁর মিশনের প্রচার-প্রসারে শীর্ষ অংশগ্রহণকারী প্রাথমিক লোকগুলো একটা জাতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সমস্ত জাতির মধ্যে হিরো বলে অভিহিত হবে। এসব কিছুই একজন জাতীয়তাবাদী স্বভাব-রুচি তার আবেগ-অনুভূতি এবং তার দর্শন আর দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীত। একজন ন্যাশনালিষ্টের জাতীয়তাবোধ কিছুতেই এটা গ্রহণ করতে পারে না যে, এমন ব্যক্তিদেরকে সে হিরো হিসাবে স্বীকার করে নেবে, যে তার স্বজাতির লোক নয়, এমন স্থানকে পবিত্র বলে কেন্দ্র হিসাবে গ্রহণ করবে, যে স্থান তার স্বদেশ ভূমির অন্তর্ভূক্ত নয়। এমন ভাষার সাংস্কৃতিক প্রভাব স্বীকার করে নেবে, যা তার আপন ভাষা নয়। সে সমস্ত ঐতিহ্য দ্বারা আত্মিক প্রেরণা লাভ করবে যা বহির্দেশ থেকে আগত। এসব বিষয়কে সে কেবল বিদেশী বলে অভিহিত করবে না, বরং সে এমন ঘৃণা আর অসহ্যের দৃষ্টিতে দেখবে, যে দৃষ্টিতে দেখা হয় বৈদেশিক হামলাকারীদের সবকিছুই। স্বজাতির জীবন থেকে বাইরের সমস্ত প্রভাব দূর করার জন্য সে চেষ্টা চালাবে।

তার জাতীয়তাবোধের প্রেরণার স্বাভাবিক দাবীই এই যে, সম্মান আর মর্যাদার সমস্ত আবেগ আর অনুভূতিকে সে কেবল স্বদেশ ভূমির মাটির সঙ্গেই সম্পৃক্ত করবে, স্বদেশের নদী-নালা আর পর্বতমালার প্রশংসার গান গাইবে। স্বজাতির প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যকে জীবন্ত করবে (বহিরাগত ধর্ম যেসব ঐতিহ্যকে জাহিলী যুগ বলে অভিহিত করে থাকে) আর এ জন্য সে গর্ববোধ করবে। অতীতের সঙ্গে নিজের বর্তমানের সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং নিজের পূর্বসূরীদের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজের সংস্কৃতির সম্পর্ক স্থাপন করবে, স্বজাতির ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক বুযুর্গদেরকে হিরো হিসাবে গ্রহণ করবে এবং তাদের বাস্তবিক বা কাল্পনিক কীর্তি থেকে নিজের আত্মিক প্রেরণা লাভ করবে।

মোটকথা হলো এটা ন্যাশনালিজমের অবিকল স্বভাব প্রকৃতির অন্তভুর্ক্ত যে, বহিরাগত যে কোনো বস্তু থেকে বিমুখ হয়ে সে এমন বস্তুর দিকে মুখ করবে, যা তার নিজের ঘরের। এ রাস্তা যে চূড়ান্ত মনযিলে পৌঁছে তা এই যে, বহিরাগত ধর্মকেও চূড়ান্তভাবে বর্জন করা হবে এবং সেসব ধর্মীয় ঐতিহ্যকে জীবন্ত করে তোলা হবে, যা স্বজাতির জাহিলী যুগ থেকে কোনো জাতীয়তাবাদী লাভ করেছে। হতে পারে অনেক জাতীয়তাবাদী শেষ মনযিল পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না, মধ্যস্থলে কোনো মনযিলে থাকবে; কিন্তু যে পথে চলছে সে পথ সেদিকেই যায়।

অধুনা জার্মানীতে যা কিছু ঘটছে, তা জাতীয়তাবাদের এই স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যেরই পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। নাৎসীদের একটা দল তো প্রকাশ্যেই হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করছে; কারণ তিনি ইহুদী বংশোদ্ভূত ছিলেন। আর কোনো ব্যক্তি ইহুদী হওয়া এজন্য যথেষ্ট যে, আর্য বংশের। একজন পূজারী তাঁর সাংস্কৃতিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক যাবতীয় মূল্য ও গুরুত্ব অস্বীকার করবে। তাইতো এ দলের লোকেরা নির্দ্বিধায় বলে :
“মাসীহ ছিলেন একজন প্রোলেটারী ইহুদী। তিনি ছিলেন মাক্সের পূর্বসূরী। এজন্যইতো তিনি বলেছিলেন যারা নিঃস্ব সর্বহারা, তারাই পৃথিবীর ওয়ারিশ হবে।”
পক্ষান্তরে যেসব নাৎসীদের অন্তরে এখনো মাসীহের জন্য স্থান রয়েছে তারা তাঁকে নরডিক বংশোদ্ভূত বলে প্রমাণ করছে। যেন একজন জার্মান জাতীয়তাবাদী হয় মাসীহকে মানবেই না, কারণ তিনি ইহুদী ছিলেন; অথবা তাকে স্বীকার করলেও ইসরাঈলী মাসীহকে স্বীকার করবে না, বরং স্বীকার করবে নরডিক বংশোদ্ভূত মাসীহকে। সর্ববস্থায় তার ধর্ম বংশপূজার অধীন। কোনো অনার্যকে আত্মিক এবং নৈতিক সভ্যতার নেতা বলে স্বীকার করে নিতে কোনো জাতিপূজার জার্মান প্রস্তুত নয়।

চরম সত্য কথা এই যে, জার্মান জাতীয়তাবাদীর জন্য সে খোদাও গ্রহণযোগ্য নয়, যার ধারণা আমদানী করা হয়েছে বহির্দেশ থেকে। পূরাকালে টিউটন গোত্র যেসব দেবতার পূজা করতো, কোনো নাৎসী মহল সেসবকে জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাইতো প্রাচীন ইতিহাস তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করতঃ দেব দেবীর পূর্ণ কাহিনী প্রস্তুত করা হয়েছে। এবং ওটন (Wotan) নামক দেবতা, প্রাচীন জাহেলী যুগে টিউটন গোত্রের লোকেরা যাকে প্লাবণের খোদা বলে স্বীকার করতো তাকেই তারা মহাদেবতা বলে স্বীকার করছে। এই ধর্মীয় আন্দোলন তো সবে মাত্র নতুন শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারীভাবে অধুনা নাৎসী যুবকদেরকে যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তাতেও খোদাকে রাব্বুল আলামীন হিসেবে নয়, বরং কেবল রাব্বুল আলমানিয়্যীন তথা জার্মানীদের খোদা হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এ ধর্ম বিশ্বাসের শব্দমালা এই :
“আমরা খোদার প্রতি এ হিসাবে বিশ্বাস করি যে, যিনি শক্তি ও প্রাণের আদি উৎস, পৃথিবীতে এবং সৃষ্টিলোকে ……. জার্মান মানুষের জন্য খোদার ধারণা স্বভাবজাত। খোদা আর চিরন্তনতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা অন্য কোনো ধর্মবিশ্বাসের ধারণার সাথে কোনোভাবেই মিলবে না। জার্মান জাতি এবং জার্মানী অনাদি বলে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ, শক্তি ও জীবন অনাদি বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা জীবনের ন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট ধারণায় বিশ্বাসী। আমাদের জাতীয় লক্ষ্য সত্য বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা আমাদের নেতা এডলফে বিশ্বাস করি।”


অর্থাৎ খোদা এমন এক শক্তি ও জীবনের নাম যা জার্মান জাতিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে আর জার্মান জাতি হচ্ছে পৃথিবীতে সে খোদার প্রকাশ। আর হিটলার হচ্ছে সে খোদার রাসূল। আর জাতীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো সে রাসূলের উপস্থাপিত ধর্ম। একজন জাতীয়তাবাদীর মানসিকতার সঙ্গে ধর্মীয় ধারণার যদি কোনো মিল থেকে থাকে তবে তা কেবল এটাই।

~ ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ
লেখক : সাঈয়েদ আবুল আ'লা মওদুদি রহিমাহুল্লাহ

পঠিত : ২৬৬ বার

মন্তব্য: ০