Alapon

সভা সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকার


জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি হিসেবে সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র চারজন আইনজীবী ডি এম পি কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন একটি চিঠি নিয়ে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে কথা বলার জন্য। তারা ডি এম পি অফিসের গেটের সামনে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের গাড়ি পুলিশ ঘিরে ধরে এবং একজন সিনিয়র আইনজীবীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে টেনে হিচড়ে পুলিশের ভ্যানে তোলে। বাকী চারজনকে তাদের গাড়িসহ রমনা থানায় নিয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিরা যাবেন এই সংবাদ পেয়ে সাংবাদিকগণ আগেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের সামনেই পুলিশ আইনজীবীদের হেনস্তা করে এবং তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দৈনিক ইত্তেফাক ও প্রথম আলোর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার, আইনজীবীদের প্রতিবাদ এবং দেশ বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের ব্যাপক প্রতিবাদের কারণে পুলিশ তাদেরকে ছেড়ে দেয়। হেনস্তার শিকার হওয়া আইনজীবী এবং সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়-বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান, সকল আলেম-ওলামা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তিসহ দশ দফা দাবীতে আগামী ৫ জুন রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট হতে একটি বিক্ষোভ মিছিল করার জন্য তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। এ মিছিল বাস্তবায়নের জন্য পুলিশের সহায়তা চেয়ে আইনজীবীগণ গিয়েছিলেন পুলিশের কার্যালয়ে। ডি এম পি কার্যালয়ে প্রবেশের আগেই তাদেরকে গ্রেফতার করার এ তুলকালাম কাÐ ঘটে। শেষ পর্যন্ত অফিস কার্যদিবসে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ার কারণ দেখিয়ে ডি এম পি হতে জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ ঐ দিনে করতে দেয়া যাবে না বলে পুলিশের পক্ষ হতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ৫ জুনের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি নগরবাসীর নজর কেড়েছে। ৪ জুন পুলিশের তরফে বায়তুল মোকাররম ও তার আশেপাশের ফুটপাতের সকল দোকান সরিয়ে ফেলে। ৫ জুন সূর্যোদয়ের পূর্বেই পুলিশ রায়টকামান,পানিকামানসহ ব্যপাক প্রস্তুতি নিয়ে বায়তুল মোকাররমের আশে পাশে অবস্থান নেয়- যা বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইট চ্যানেল ও অনলাইন নিউজের পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছে। এর অর্থ ছিলো যে কোনো অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীকে তারা সমাবেশ করতে দিবে না। অবশ্য সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী শাখা ৫ জুনের পরিবর্তে আগামী ১০ জুন শনিবার সমাবেশের পুনঃতারিখ ঘোষণা করেছে। ঐ দিন পুলিশ কি করে এটি এখন দেখার পালা।
আইনজীবীদের হেনস্তা করার প্রতিবাদে ৩০ মে দুপুরে সুপ্রীম কোর্টের সামনে আইনজীবীগণ মানব বন্ধন ও সমাবেশ করেছেন এবং সে সমাবেশে সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক নন্দিত সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মাহবুব উদ্দিন খোকন, এডভোকেট রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ হেনস্তার শিকার হওয়া সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক নির্বাচিত সিনিয়র সহ সভাপতি এডাভোকেট জালাল আহমেদ, এডভোকেট আবদুল বাতেন, এডভোকেট গোলাম রহমান ভ‚ইয়া এবং এডভোকেট সাইফুর রহমানসহ সিনিয়র আইনজীবী নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছেন এবং এর প্রতিবাদ করেছেন। আইনজীবীদের হেনস্তা অবশ্যই আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, এ বিষয়ে আইনজীবীগণই শক্ত প্রতিবাদ করেছেন। এ নিবন্ধে যে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করতে চাই তা হচ্ছে- কয়েকজন অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তার এই বাড়াবাড়িমূলক কার্যক্রম আইন ও মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে কি না, কিংবা জামায়াতে ইসলামী কোনো সমাবেশ করার অধিকার রাখে কি না, অথবা সমাবেশ করার ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো আইনী ব্যত্যয় দেখেছে কি না? বিষয়গুলো অতি সংক্ষেেেপ আলোচনার দাবী রাখে।
সভা সমাবেশ করা যে কোনো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদের ৩৭ ধারায় বলা হয়েছে ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ সংবিধানের এই ধারা সাঅনুযায়ী যে কোনো দল বা মতের যে কোনো লোকের সভা সমাবেশ করার অধিকার দেয়া হয়েছে। এখানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে যে, এই সভা সমাবেশে কোনো ভায়োলেন্স হয় কি না। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখে আসছি। কেউ সভা সমাবেশ করার জন্য পুলিশের সহায়তা চাইলে তারা অযাচিত শর্তারোপ করে এবং কোনো কারণ ব্যতীতই সভা সমাবেশের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করে। বিগত ১৪ বছর যাবৎ দেখা যায় যে, বিরোধী দলের সমাবেশে পুলিশী হামলা, টিয়ার সেল, গুলি, আহত করা এবং হামলা করে গ্রেফতারের একটি সংস্কৃতি তারা গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে কোনোভাবেই সভা সমাবেশ করতে দেয়া হয় না। এমনকি তারা ঘরোয়াভাবে ৫-১০ জন লোক একত্র হলেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং নাশকতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা দায়ের করে। এমনকি পুলিশের এই গ্রেফতার অভিযান থেকে বাদ যায় না বিয়ের অনুষ্ঠান, জানাযা এবং তারাবীহ নামাযে আগত মুসুল্লীরাও। সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি যে, কোনো নাগরিকের সভা সমাবেশ করার জন্য অনুমতি দরকার হবে। পুলিশের ডি এম পি এ্যাক্টে অবশ্য এ বিষয়ে একটি ধারা আছে, যে ঢাকা মহানগরীর মধ্যে সভা সমাবেশ করলে তাদেরকে অবহিত করতে হবে। তবে কোথাও এ কথা বলা হয়নি যে, কোনো দল বা ব্যক্তি সভা সমাবেশ করলে তাতে বাধা দেয়া হবে, হামলা করা হবে, গুলি করা হবে, তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু পুলিশ অত্যন্ত পারঙ্গমতার সাথে বিগত ১৪ বছর যাবৎ এ কাজটি করছে। মূলত সভা সমাবেশ করার মৌলিক অধিকার থেকে জামায়াতে ইসলামীকে বঞ্চিত করার জন্যই সরকার এ কাজটি করে যাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী কোনো আইন বিরোধী সংগঠন নয়
বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের পর হতে জামায়াতে ইসলামী যে কোনো সময় যে কোনো ইস্যুতে সরব ভ‚মিকা পালন করেছে। এ দেশের আইন ও সংবিধান মেনেই জামায়াতে ইসলামী তার রাজনৈতিক অধিকার চর্চা করে আসছে। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা ১৯৪১ সালে হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করে ১৯৭৯ সালে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এক ঘোষণার মাধ্যমে সকল ইসলামী দল, সভা সংঘ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ১৯৭৪ সালে বাকশাল গঠন করে অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।এ সময়কালে জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামী দল ও সংগঠন সাংগঠনিক ও কার্মকাÐ পরিচালনা করার অধিকার হারায়।১৯৭৭ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে বহুদলীয় গণাতন্ত্রিক নীতি ঘোষিত হওয়ার পর সকল রাজনৈতিক দল আবার স্ব স্ব নামে রাজনীতি করার অধিকার লাভ করে। আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জামায়াত ১৯৭৯ সাল হতে আবার স্ব নামে তাদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। জামায়াতে ইসলামীর কর্মসূচী, কর্মপদ্ধতি এর সংগঠন পরিচালনা সব কিছুই বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান মেনে করা হয়। এ দেশের স্বাধীনতা সাার্বভৌমত্ব রক্ষা, আইন ও মানবাধিকারের বাস্তবায়নসহ দেশ ও জাতির কল্যাণে সকল সময় জামায়াতে ইসলামী সরব থেকেছে। জামায়াতে ইসলামী তার কর্মসূচী বা ঘোষণাপত্রের দ্বারা কখনো দেশ বিরোধী বা সংবিধান বিরোধী কোনো কর্মকাÐ গ্রহণ করেনি বরং বলা যায় আইন ও শৃঙ্খলা মানার ক্ষেত্রে অন্য সকল রাজনৈতিক দলের চেয়ে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই জামায়াতে ইসলামী পুলিশের সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে এবং এ জন্য তারা আইনজীবীদের পাঠিয়েছিলো। কিন্তু পুলিশ তাদের সাথে ন্যাক্কারজনক আচরণ করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মাইজভাÐারপন্থী একটি গণবিচ্ছিন্ন সংগঠনের এক নেতার করা মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনকে হাইকোর্ট স্থগিত করে। বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতের আপীল বিভাগে বিচারাধীন। উচ্চ আদালতে বিচারাধীন বিষয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নিয়ে। এর বৈধতা-অবৈধতার প্রশ্ন সেখানে আসতে পারে না। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ জামায়াতে ইসলামীর সাথে সম্পৃক্ত। জামায়াতে ইসলামীর কর্মী, সমর্থক এবং এর দায়িত্বশীলগণ সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তারা সবাই আইন ও সংবিধান মেনেই তাদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চা করতে চায়। এতে বাধা দিয়ে সরকার বরং আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করছে।


স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব সময় সোচ্চার থেকেছে
ফারাক্কা বাাঁধের বিরূপ প্রভাবের কারণে দেশের জলবায়ু, ভূমি এবং নাব্যতার ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী সব সময় প্রতিবাদ করে আসছে। ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেয়ার দাবীতে নানান সময়ে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ এবং স্মারকলিপি প্রদান করেছে। সীমান্তে নিরীহ নাগরিক হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ, স্মারকলিপিসহ সব সময় প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে আসছে। অসম পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রতিবাদ ১৯৯৭ সালে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ হতে রাঙামাটি অভিমূখে লংমার্চ কর্মসূচী পালিত হয়েছে। চারদলীয় জোটের উদ্যোগে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ, হরতালসহ সকল কর্মসূচীতে জামায়াতে ইসলামী সরব ছিল। সিলেট সীমান্তে টিপাই মূখ বাধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জলবায়ু, কৃষি ও নব্যতা চূড়ান্ত ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামী প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে। ২০১০ সালে দেশের সকল বিভাগীয় শহরে বড় বড় আটটি সমাবেশ করে। এর পরপরই জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হন।
অতীতের সকল সংসদে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিত্ব ছিল
বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রবর্তনের পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৯ সালে। এ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পিডিপি ও নেজামে ইসলামীকে নিয়ে জোট করে ‘আই ডি এল’নামে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছয় জন প্রার্থী বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে যায়। তারা হলেন, পিরোজপুর হতে মাওলানা আবদুর রহীম, ঝিনাইদহ হতে মাওলানা নুরুন্নবী সামদানী ও অধ্যাপক রেজাউল করীম, গাইবান্ধা হতে মাওলানা মোজাম্মেল হক, কুড়িগ্রাম হতে মো. সিারজুল ইসলাম এবং লক্ষীপুর হতে মাস্টার সফিকুল্লাহ এ সময় জামায়াতে ইসলামীর প্রাপ্তমোট ভোটের পার্সেন্টেস ছিলো ৬%+। ১৯৮৬ সালে জামায়াতে ইসলামী ১০ টি আসনে বিজয়ী হয় এবং এরশাদ সরকার তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে নির্বাচনকে বার বার প্রভাবিত করায় কেয়ার টেকার সরকারের দাবী আদায় এবং এরশাদের পদত্যাগের দাবীতে জামায়াতের দশজন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করে। ১৯৯১ সালে জাাময়াতে ইসলামী ২১৬ টি আসনে নির্বাচন করে ১৮টি আসনে বিজয়ী হয়। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর প্রাপ্ত মোট ভোটের পার্সেন্টেস ছিলো ১২%+। ১৯৯৬ সালে জাময়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে নির্বাচন করে কিন্তু আসন পায় মোট তিনটি। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর প্রাপ্ত মোট ভোটের পার্সেন্টেস ছিলো ৯%+। আওয়ামী দুঃশাসন জুলুম নির্যাতন এবং নির্বাচন নিয়ে টালবাহনার প্রতিবাদে ১৯৯৯ সালে গঠিত হয় চার দলীয় জোট। চার দলীয় জোটের শরীক হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ৩৭ টি আসনে নির্বাচন করে ১৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এ সময় জামায়াতের প্রাপ্ত ভোটের পার্সেন্টেস ছিলো ৫%+। তবে এ পার্সেন্টেস দিয়ে জামায়াতের মোট জনসমর্থনকে বোঝা যাবে না। কারণ জোটের ঐক্যের স্বার্থে জামায়াতে ইসলামী ২৩৩ টি আসনে নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি। এমনকি সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, কক্সবাজার, বাগেরহাট, নীলফামারীসহ অসংখ্য জেলায় জামায়াতের যেখানে ভোট ব্যাংক আছে সে সকল আসন জোটের স্বার্থে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এরপর ২০০৮ সালে যে মঈন ফখরুলের অধীনে যে নির্বাচন হয় সে নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী দুটি আসন পায়। এরপর থেকে আওয়ামীলীগ বিগত চৌদ্দ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। যার মধ্যে ২০১৪ সালে তারা বিনা ভোটে অটো পাস নিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখে এবং ২০১৮ সালে রাতের ভোটে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার সব কয়টি নির্বাচনে জাতীয় সংসদে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি ছিলো। যে রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশের প্রতিটি পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছে তাদেরকে সকল প্রকার রাজনৈতিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা, তাদেরকে কথা বলতে না দেয়া, তাদের কেন্দ্রীয় অফিস হতে সকল শাখা অফিস তালাবদ্ধ করে রাখা আইন এবং সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন
জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪১ সালে। তবে প্রথম সাত বছর জামায়াতে ইসলামী কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করেনি। ১৯৪৮ করাচীর জাহাঙ্গীর পার্কে প্রথম রাজনৈতিক জনসভা করে। একটি আদর্শ কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য চার দফা দাবী পেশ করে। ১৯৬২ সালে আইউব খান ব্যাসিক ডেমোক্রেসির নামে এক আজব নীতি প্রণয়ন করলে জামায়াতে ইসলামী এর প্রতিবাদে নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করে। আইউব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সকল দল মিলে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি গঠিত হয়। যাতে পি ডি পি, মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আওয়ামীলীগসহ সকল দল ছিলো। এ জোটের শরীক হিসেবে জামায়াতে ইসলামী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য ১৯৬৯ সালে যে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়, তাতে জামায়াতে ইসলামী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় ইয়াহিয়া সরকারের সাথে বার বার একত্রে আলোচনায় বসেছিলেন মাওলানা মওদূদী, অধ্যাপক গোলাম আযম এবং মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। যার ছবি এখনো সংরক্ষিত আছে। আমার আগেই উল্লেখ করেছি স্বাধীন বাংলাদেশে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মের নামে দল, সংঘ, সমিতি গঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ইসলামী দলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী আবার নতুনভাবে তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮২ সালে এরশাদ সাহেব তখনকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে বন্দুকের নলের মূখে সরিয়ে দিয়ে নিজে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করলে জামায়াতে ইসলামী সাথে সাথে তার প্রতিবাদ জানায়। ১৯৮৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমীর কেয়ার টেকার সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন করে জাতির সামনে বক্তব্য দেন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত স্বৈরাচার বিরোধী সকল আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী সামনের সাড়িতে থেকে ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৯৬ সালে বি এন পি ক্ষমতায় থেকে একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করলে জামায়াতে ইসলামী তাতে অংশগ্রহণ করেনি বরং সংবিধানে কেয়ার টেকার সরকারের বিধান সংযোজনের দাবীতে আন্দোলন করেছে। এ সময় কেয়ার টেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছে আওয়ামীলীগসহ প্রায় সকল রাজনৈতিক দল। তখন আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, তোফায়েল আহমদ, জাতীয় পার্টির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মওদূদ আহমদ, গণতন্ত্রী পার্টির প্রধান সুরঞ্জিৎ হালদার এবং জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেয়ার টেকার সরকারের দাবীতে আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছিলেন। ২০০৭ সালে অনাকাক্সিক্ষতভাবে মঈন-ফখরুলের নেতৃত্বে সেনা শাসিত সরকার ক্ষমতাসীন হলে সে সময়ও জামায়াতে ইসলামী সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন সংগ্রামে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী সব সময় কেয়ার টেকার সরকারের দাবীতে সোচ্চার থেকেছে। আওয়ামীলীগ-বি এন পি কখনো কেয়ার টেকার সরকার ব্যবস্থার পক্ষে আবার কখনো বিপক্ষে অবস্থান নিলেও জামায়াতে ইসলামী সব সময় এ দাবীতে সোচ্চার থেকেছে।
দূর্যোগ দুর্বিপাকে সদা তৎপর
দেশের যে কোনো দূর্যোগ দুর্বিপাকে জামায়াতে ইসলামী সদা তৎপর এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ ও কর্মী বাহিনী ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা মৃতদের লাশ দাফন, গৃহ নির্মাণ, খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, চিকিৎসা সেবাসহ নানামূখী তৎপরতা পরিচালনা করে। এরপর ১৯৯২, ১৯৯৮ এবং ২০০৪ সালের বন্যায় জামায়াতে ইসলামী ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করেছে। ২০০৭ সালে সিডরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সাথে বরিশাল অঞ্চলে সফর করে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করেন তৎকালীন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং খুলনা অঞ্চলে সফর করে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করেন তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। সাম্প্রতিককালে যতগুলো বড় বড় দূর্ঘটনা সকল বিপর্যয় এবং দূর্ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা সর্বাগ্রে থেকে ভূমিকা পালন করে আসছে। মহামারী করোনাকালীন সময়ে অক্সিজেন সিলিÐার সরবরাহ, মেডিকেল টিমের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা, অসহায় পরিবারগুলোতে খাদ্য বিতরণসহ নানাবিধ কাজ করেছে। ২০২১ এবং ২০২২ সালের বন্যায় জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাক্তার শফিকুর রহমান নিজে কাধে করে খাদ্য এবং ঔষধ পৌছিয়ে দিয়েছেন। এ ব্যতীত দেশের কয়েকটি স্থানে নৌকা ডুবি, অগ্নিকাÐে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্থ, সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত এবং আহত পরিবারের পাশে সবার আগে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন বর্তমান আমীর ডাক্তার শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতের কর্মীরা। মিডিয়ার সুবাদে সকলেই দেখেছে যে, ঢাকার বঙ্গবাজার এবং নিউ মার্কেটে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সাথে সাথে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা অগ্নি নির্বাপনসহ ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের পাশে থেকে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে। শত জুলুম নির্যাতন আর নিপীড়ন সত্বেও দেশ এবং জাতির কল্যাণে তারা কাজ নিয়মিত অব্যহত রেখেছে। জামায়াতে ইসলামীকে তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা দেয়া মানে মানবতার কল্যাণমূলক বাধাগ্রস্ত করা। তাদেরকে দেখামাত্র গ্রেফতার ও আটক করা মানে একটি দেশপ্রেমিক আদর্শ নাগরিককে গ্রেফতার করা। প্রকারান্তরে এ কার্যক্রম মানে দেশ ও জাতির কল্যাণকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।
আদর্শ সৎ দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরী
এ দলের সামগ্রিক কর্মকাÐই সততা এবং ন্যায় নিষ্ঠার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। মানবতার কল্যাণ সাধন প্রতিটি কর্মীর জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে তারা গ্রহণ করে। দলের অভ্যন্তরে রয়েছে আদর্শ ও নৈতিক মানুষ হওয়ার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। তাদেরকে নিয়মিত কুরআন হাদীস অধ্যয়ন করে সে আলোকে জীবন গঠনের জন্য ধারাবাহিক তালিম তারবিয়াতের ব্যবস্থা করা হয়। মানুষকে তার প্রতিটি কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে। দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, মৃত্যুর পর আর একটি জীবন আছে, যেখানে মানুষের সকল কাজের হিসেব দিতে হবে। আল্লাহ মানুষের সকল কর্মকাÐ দেখছেন- এ দলের প্রতিটি কর্মী এ অনুভূতি জাগরুক রেখে তার দুনিয়ার সকল কাজ পরিচালনা করে। একইভাবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যারা এ দলের সাথে যুক্ত হয় তাদেরকে তাদের ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার আলোকে জীবন গঠন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। কারণ কোনো ধর্মই মানুষকে মিথ্যা বলা, অন্যায় কাজ করা, চুরি করা, দূর্নীতি করার শিক্ষা দেয় না। এ দলের দু’জন শীর্ষ নেতা তিনটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেউ এক টাকা দূর্ণীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। একইভাবে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচতি পার্লামেন্ট সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র কাউন্সিলর যারা নির্বাচিত হয়েছে তাদের কারো বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কেউ দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। যারা দেশ জাতির কল্যাণে একদল সৎ দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরী করছে, তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া মানে দেশের কল্যাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া।
সভা সমাবেশ করা জামায়াতে ইসলামীর সাংবিধানিক অধিকার
সভা সমাবেশ করা, রাজনৈতিক কর্মকাÐ পরিচালনা করা জামায়াতে ইসলামীর আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার। যারা এ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কর্মী সমর্থক কেউই ভিন দেশ হতে এখানে আগমণ করেননি। তারা সকলে এই দেশের নাগরিক। তারা একদল দেশপ্রেমিক নাগরিক। তারা দূর্নীতিমুক্ত, সৎ নীতিবান নাগরিক। জামায়াতে ইসলামীর নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে কেউ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দখল, চাঁদাবাজি, টেÐারবাজি, মাদক, চোরাচালান, নেশাখোড়ি, ধর্ষনসহ কোনো প্রকার অনৈতিক কাজের প্রমাণ দেখাতে পারবে না। অথচ বর্তমান ক্ষমতাসীন মহলের বিশেষ করে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগ তো সকল অন্যায় অপকর্মের জন্য সব সময়ে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকে। এর বিপরীতে একটি আদর্শবাদী দলকে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাÐ পরিচালনা করতে না দেয়ার অর্থই হলো বর্তমান সরকার ও তাদের প্রশাসন দুষ্টের লালন এবং শিষ্ঠের দমনে অভ্যস্ত। আশা করি সরকার এবং প্রশাসনের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। তারা জামায়াতে ইসলামীকে সকল প্রকার সাংগঠনিক কর্মকাÐ পরিচালনা করতে সহায়তা করবে। তাদেরকে নির্ভিঘœ সভা সমাবেশ করতে দিয়ে একটি সূখী সমৃদ্ধ আদর্শ নৈতিকতাপূর্ণ, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজে সহায়তা করবে।

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান, ঢাকা,০৫ জুন-২০২৩

পঠিত : ৩৩৩ বার

মন্তব্য: ১

২০২৩-০৬-০৫ ১৪:৪৬