Alapon

"অতএব পুঁজি বিকিয়ে দেবেন না"



আমরা যারা ইসলামী আন্দোলন করি, আমরা নঈম সিদ্দিকীর 'চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান' প্রবন্ধটি পড়েই বড় হয়েছি। এখানে লেখক জোর দিয়েছেন কীভাবে আমরা আমাদের চরিত্র ঠিক রাখবো। আর চরিত্র ঠিক রাখা মানে হলো ইসলামী আন্দোলনে টিকে থাকা বা ইসলামকে গালিব করার জন্য কাজ করা।

চরিত্র নষ্ট বলতে লেখক বুঝিয়েছেন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইসলামী আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হওয়া। উনি যেসময় লেখাটি লিখেছিলেন তখন ওনার দৃষ্টিতে দুটি কারণ ধরা পড়ে চরিত্র নষ্ট হওয়া তথা হকের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার।

উনি বলতে চেয়েছেন যখন কোনো মানুষ ইসলামের দিকে ধাবিত হওয়ার চেষ্টা করে তখন শয়তান ঐ মানুষের প্রতি তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। তাকে দুইভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করে।

প্রথমত তাকে দুনিয়ার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লোভ দেখায়। যেটাকে নঈম সিদ্দিকী বলেছেন পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও স্বার্থপূজারী সভ্যতার হামলা।

দ্বিতীয়ত তাকে সাম্যবাদী সমাজের নামে ইসলামবিমুখ করার চেষ্টা করে। যেটাকে লেখক বলেছেন সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা।

বইটি লেখার প্রায় ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। বর্তমান সমাজে শয়তানের এই দুটি আক্রমণের মধ্যে ১ম টি প্রবলভাবে অব্যাহত আছে এবং এটি আজীবন থাকবে বলে মনে করি। কারণ এর মাধ্যমে বেশিরভাগ ঘায়েল হয়েছে ও হচ্ছে। মানুষ বরাবরই সম্পদ, খ্যাতি, ক্ষমতার কাঙ্গাল। এটি মানুষের কমন ফিতরাত। নফসের চাহিদাও তাই। ফলে বেশিরভাগ মানুষ দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শয়তানের ধোঁকায় পড়ে।

সমাজতন্ত্র সেসময় ট্রেন্ডি আদর্শ ছিল। মুসলিম যুবকরা কম্যুনিস্টদের কবলে পড়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তারা কিন্তু আদর্শের জন্য ডেডিকেটেড ছিল। যেহেতু তারা আদর্শের জন্য উন্মূখ ছিল তাই ওদের চেয়ে ভালো আদর্শ উপস্থাপন করতে পারলেই সমস্যা কেটে যাবে। জামায়াতে ইসলাম উপমহাদেশে সেই ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামকে সঠিকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরেছে। ফলে বহু কমিউনিস্ট নেতা তওবা করে সঠিক মুসলমান হয়েছে।

কমিউনিস্টদের আদর্শ বিশ্বব্যাপী মার খাওয়ায় সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা ষাটের দশকের চেয়ে অনেক অনেক কমে গিয়েছে। কিন্তু এই স্থান দখল করে নিয়েছে সেক্যুলারিজম। তারা ইসলাম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে দিয়েছে। ফলে একশ্রেণির মুসলিম তৈরি হচ্ছে যারা পার্সোনালি ইসলামকে ভালোবাসে। নামাজ রোজা করে কিন্তু রাষ্ট্র থেকে অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিহার করতে সচেষ্ট তো থাকেই না। উল্টো রাষ্ট্রকে ইসলামী কানুন থেকে আলাদা রাখতে চায়।

আজকে আমার আলোচনা আমাদের চারিত্রিক পুঁজিকে কেন্দ্র করে। নঈম সিদ্দিকীর লেখা থেকে বুঝতে পারি, সেসময় এক টাইপের মুসলিম পাওয়া যেত, যারা চরিত্র নষ্ট হওয়ার ভয়ে রাজনীতি করতেন না, দাওয়াতী কাজ করতেন না। নিজের যৎসামান্য ঈমানের পুঁজি নিয়ে নিজের মধ্যেই আবদ্ধ থাকতেন।

তাদের ব্যাপারে নঈম সিদ্দিকী বলেন, চরিত্রের যে ‘মূলধন’কে ক্ষতির আশঙ্কায় হামেশা সিন্দুকের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় এবং যা হামেশা অনুৎপাদক (Unproductive) অবস্থায় বিরাজিত থাকে, সমাজ জীবনের জন্যে তার থাকা বা না থাকা সমান।

মুসলমান নারী-পুরুষ এবং মুসলিম দলের নিকট চরিত্র ও ঈমানের কিছু ‘মূলধন’ থাকলে তাকে বাজারে আবর্তন (Circulation) করার জন্য ছেড়ে দেওয়া উচিত। তারপর মূলধন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যোগ্যতা থাকলে সে মূলধন লাভসহ ফিরে আসবে, আর অযোগ্য হলে লাভ তো দূরের কথা আসল পুঁজিও মারা পড়বে। কিন্তু বাজারে আবর্তিত হতে থাকার মধ্যেই পুঁজির স্বার্থকতা। অন্যথায় যত অধিক পরিমাণ পুঁজিই জমা করা হোক না কেন তা পুরোপুরি ব্যর্থ হতে বাধ্য।

বাজারে আবর্তন করেই পুঁজি বিকিয়ে দেওয়া যাতে না হয় সেজন্য তিনি বলেছেন, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ যখন তাদের চরিত্র ও ঈমানের ন্যূনতম পুঁজি এ পথে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তখন একে কেবল ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই নয়, বরং দেশ ও জাতির এবং আমাদের নিজেদেরকেও এ থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জনের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

যাই হোক, তত্ত্বগত আলোচনা বাদ দিয়ে প্র্যাকটিক্যাল কিছু কথা বলি।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ধর্মীয় পুঁজি কী?
জামায়াতের ধর্মীয় পুঁজি হলো, এদেশে আল্লাহর আইন কায়েম করা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামকে গালিব করা, তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের জনপ্রিয় স্লোগান হলো,
আল্লাহর আইন চাই
সৎ লোকের শাসন চাই

জনগণ আমাদেরকে এই কারণে পছন্দ করবে যে, আমরা ইসলামকে বিজয়ী করার জন্যই কাজ করছি। আমরা যদি ইসলামের চাইতে অন্যান্য বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেই তবে আমরা পুঁজি হারাবো। সেটা যতই ভালো কাজ হোক না কেন! যেমন আপনি মানুষকে যদি বলেন, জামায়াতে যোগ দিন, জামায়াত দেশ শাসন করলে প্রচুর উন্নয়ন করে দেশকে উন্নত রাষ্ট্র করে দিবে। আপনাদের পয়সাওয়ালা বানিয়ে দেবে।

উন্নয়ন করা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আপনি চান বা না চান এটা হবেই। মানুষ এই কারণে জামায়াতকে গ্রহণ করবে না। যদি উন্নয়নই শেষ কথা হয়, তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপিই করা উচিত। জামায়াতের দরকার নেই।

উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি থাইল্যান্ডের কথা। থাইল্যান্ড পর্যটন শিল্পকে তাদের প্রধান রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস বানিয়েছে। মদ, ক্যাসিনো, পতিতাবৃত্তিসহ নানাবিধ সুবিধা দিয়ে তারা পর্যটকদের কাছে টানে। এর মাধ্যমে তারা সম্পদশালীও হয়েছে।

জামায়াতের কাছে যদি বস্তুগত উন্নয়নই শেষ কথা হয় তবে নঈম সিদ্দিকীর ভাষ্যমতে আমরা চরিত্রহীন হয়ে পড়বো। অতএব জামায়াতের প্রথম ও প্রধান পুঁজি ইসলাম প্রতিষ্ঠা। আমরা যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কম বলে উন্নয়নের কথা বেশি বলি তবে বুঝতে বাজারে আমাদের পুঁজি মাঠে মারা যাবে। বেশি লাভ করতে যেয়ে আমরা যাতে পুঁজি হারিয়ে না বসি।

আপনি যদি জনগণকে উন্নয়ন শেখান তবে সে এর জন্য জামায়াতের কাছে আসবে না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জামায়াতের রাজনৈতিক পুঁজি হলো ভারত তথা মুশরিকদের বিরোধীতা।

এই অঞ্চলে ইসলামপন্থী/ তাওহীদপন্থী রাজনীতির এটাই হলো বেসিক কথা। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস হলো একত্ববাদ ও বহুঈশ্বরবাদের দ্বন্দ্ব। সেই দ্রাবিড় ও আর্যদের দ্বন্দ্ব।

বাংলাদেশের মানুষ আমাদের সমর্থন দেবে এইজন্য যে, আমরা মুশরিকদের সংস্কৃতি ও সাম্রাজ্যবাদীতা থেকে মুসলিমদের রক্ষা করবো। যদি আমরা ভারত ও ভারতীয় এজেন্ডাকে ঔন করি, তাদের এজেন্ডাকে নিজেদের এজেন্ডা মনে করি তবে জামায়াতের এই দেশে দরকার নেই।

কারণ ভারত ও ভারতের এজেন্ডার পক্ষে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ আছে। ভারতীয় এজেন্ডার জন্য আওয়ামী লীগ হচ্ছে উত্তম চয়েস। জামায়াত যদি ভারত বিরোধীতা ছেড়ে দেয় তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত অপ্রাসঙ্গিক। দরকার নেই।

অতএব, জামায়াতের নেতা কর্মীদের প্রতি আমার আহ্বান। পুঁজি বিকিয়ে দেবেন না। আপনি কী পুঁজি নিয়ে নামছেন তা আপনার জানা থাকা দরকার। আপনি যদি মনে করেন, আপনার পুঁজি দিয়ে কাজ হবে না। আওয়ামীলীগের পুঁজি ধার করতে হবে তবে আমার বিনীত অনুরোধ, ভালো হয় আপনি আওয়ামী লীগ করেন। জামায়াত করার দরকার নেই।

আন নাহদা পার্টির কথাই ধরুন। জনপ্রিয় হয়ে ক্ষমতায় আসলো। পশ্চিমা সুশীল সমাজ তাদের বিভিন্ন ইস্যুতে সমালোচনা করলো। বিরোধীরা তাদের সেকেলে বললো। অমনি তারা নিজের পুঁজির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললো। ধার করলো সেক্যুলারদের পুঁজি। এখন ক্ষমতাও হারালো, জনসমর্থনও হারালো।

জামায়াত এতো এতো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আদালত থেকে রায় নিয়ে নিকৃষ্ট সব অভিযোগে ফাঁসি দিয়েছে জামায়াত নেতাদের। অনেকে ভেবেছে এর ফলে জামায়াতের সমর্থকরা লজ্জায় জামায়াত ছেড়ে দেব। কিন্তু দেখুন, জামায়াত মোটেই তার সমর্থন হারায়নি। বরং সিম্প্যাথি নিয়ে জনসমর্থন গেইন করেছে। এর বড় কারণ তারা পুঁজি ধরে রেখেছে।

এখন যদি বহিঃবিশ্বের সুবিধা হাসিল করার জন্য নিজের পুঁজি বিকিয়ে দেয় তবে জামায়াত সব হারাবে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, আল্লাহ তায়ালা জামায়াতকে বহুবার মর্যাদার সাথে বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে সবসময় বাঁচাবে। জামায়াত যদি নিজেদের চরিত্র নষ্ট করে, নিজেদের পুঁজি বিকিয়ে দেয়, তবে বাংলাদেশে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই অন্য আরেকটি তাজদিদি দল প্রতিষ্ঠা করবেন।

এটা আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা। তিনি সূরা তাওবার ৩৯ নং আয়াতে এই ওয়াদা করেছেন। অতএব পুঁজি বিকিয়ে দেবেন না। চরিত্র নষ্ট করবেন না।

পঠিত : ২৪৩ বার

মন্তব্য: ০