Alapon

গরু জবাই : মুসলমানদের কালচারাল আইডেন্টিটি



মূল আলাপে প্রবেশে পূর্বে চলুন ইতিহাস নামক ফিল্মের পেছনে একটু টেনে দেখে আসি।
সময়টা ১১৭৮ সাল। আরব থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য বাংলায় আসেন সুফি বাবা আদম শহীদ (র.)। তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে এক কোরবানির সময় গরু জবাই করেন। এক কান দু'কান হতে হতে এই কথা পৌঁছে যায় রাজা বল্লাল সেনের কান পর্যন্ত। সে ক্রোধান্বিত হয়ে হামলা করে বাবা আদম শহীদের দরগায়। নৃশংস ভাবে তাকে শহীদ করা হয়।
পরবর্তীকালে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মুন্সিগঞ্জ বিজয় হয়।

প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে সিলেটের রামপালের, ফানাইচং গ্রামে ১৩০৩ সালে। শেখ বোরহান উদ্দিন নামক এক ব্যক্তির ছেলের আকিকার জন্য গরু জবাই করা হয়। কথিত আছে, এক টুকরো গোশত চিল উড়িয়ে নিয়ে রাজা গৌড় গোবিন্দের দরবারে নিয়ে ফেলে। খোঁজ নিয়ে রাজা শেখ বোরহান উদ্দিনের হাত কেটে দেন এবং তার শিশুপুত্রকে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে এই এই ঘটনার প্রতিশোধের প্রেক্ষিতে সিলেট বিজয় হয়।

সম্রাট আকবরের সময়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) যখন আন্দোলন শুরু করেন তখন তার অন্যতম একটি দাবি ছিলো মুসলমানদের তাদের নিদর্শন প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখা যাবে না। গরু খাওয়ার অধিকার দিতে হবে।

ইংরেজরা উপমহাদেশে শাসনকালে হিন্দুদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া হতো। সেই সুযোগ ব্যবহার করে অনেক হিন্দু মুসলিমদের উপর ষড়যন্ত্রের জাল বুনতো। মুসলিমরা যখন বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে দিশেহারা তখন সংস্কারের জন্য হাজী শরীয়তুল্লাহ'র নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু হয়। সে আন্দোলনের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হিন্দু জমিদারদের চাপিয়ে দেয়া ছিলো গরু জবাই নিষিদ্ধের বিধান উঠিয়ে নেয়া।

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ শহীদ তিতুমীর। তার আন্দোলনেরও একটা কারণ ছিলো মুসলমানদের কুরবানির সময়ে গরু জবাই করতে না দেয়াটা। তার আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রের মধ্যে একটা ষড়যন্ত্র ছিলো 'হিন্দুদের কালি মন্দিরে গরু জবাই করে রক্ত লাগিয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়'।পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলনের কারণে তাকে শহীদ করা হয়।

এই বাংলাতে ঢাকায় নবার পরিবারের প্রভাব থাকার কারণে তারা গরু কুরবানি দিতো তাছাড়া অন্য কোথাও তেমন সুযোগ করতে পারতো না। সকলে কুরবানির সময় ছাগল কুরবানি দিতো। সেই থেকেই কুরবানির ঈদকে বলা হতো বকরীর ঈদ। বিভিন্ন সাহিত্যেও বকরী ঈদ নামে উল্লেখিত আছে। বাংলাদেশের জাতীয কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'বকরীদ' নামে একটি কবিতাও রয়েছে।

উপমহাদেশে হিন্দু এবং মুসলিম দুটি আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার পেছনেও গরু জবাই একটি অন্যতম কারণ।
৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান সময়েও বাংলার কিছু কিছু জায়গায় গরু কুরবানী করতে ভয় পেতো। ১৯৫৭ সালে নাটোরের পর ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর এই অঞ্চলে নিয়মিত গরু কুরবানি দেয়া শুরু হয়।

কোনো নারী হিজাব পড়লে তাকে মুসলমান স্বাভাবিক ভাবে ধরে নেয়া হয়। কোনো পুরুষ টুপি পড়লে তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয়।
তেমনি আমাদের উপমহাদেশে গরু খাওয়া মুসলিম কালচারাল আইডেন্টিটি। গরু জবাই করা এক ধরনের সাহসীকতা। মাথা যে উঁচু রয়েছে তার একটি বিশেষ প্রমাণ গরু জবাই করা।
মানুষ মনের ভেতরে কি লালন করে তা ফুটে উঠে তার কর্মে, তার সংস্কৃতিতে, তার চলাফেরাতে। উপমহাদেশে গরু জবাই করা মুসলমানিত্বের লক্ষ্মণ। কেউ যদি তার সংস্কৃতিতে দৃঢ় ভাবে ধরে রাখতে পারে তাহলে তার আত্মপরিচয়হীনতায় ভুগতে হবে না। আত্মপরিচয় শক্ত ভাবে ধরে রাখতে পারলে মানুষের আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায়। পূর্বপুরুষরা এই আত্মপরিচয় ধারণ করার জন্যই রক্ত দিয়ে গুরুত্ব বুঝিয়ে গিয়েছেন। জিল্লতি তারা কখনো বেছে নেয়নি।
সুতরাং উৎসবে উৎসবে গরু জবাই হোক। কোনো প্রকার হীনমন্যতা হৃদয়ে বাসা না বাধুক।
আমাদের পরিচয় বহন করতে হবে আমাদেরই।

গরু জবাই : আমাদের কালচারাল আইডেন্টিটি

পঠিত : ৪৯৩ বার

মন্তব্য: ০