Alapon

বাংলার মানুষের ইসলাম গ্রহণে সূফিদের ভূমিকা

মুসলমানদের বলা হয়ে থাকে একটি মিশনারি জাতি। আর ইসলাম হচ্ছে একটি শান্তির ধর্ম, সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। এখানে নেই কোন ধনী-গরীবের ভেদাভেদ, সাদা-কালোর পার্থক্য। এজন্য ইসলামের বাইরে নিগৃহীত হওয়া কালো দাস বেলালও এখানে এসে সম্মানিত হয়ে উঠেছিল। সুদূর পারস্যদেশ থেকে এসেও সালমান ফারেসিদের মত ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করে যুদ্ধের ময়দানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফলে শান্তির এ ধর্মটির সন্ধান যারাই পেয়েছে তারাই ব্যাকুল হয়ে উঠেছে অন্যদের মধ্যে তার প্রচার করতে। এজন্য দেখা যায় নবিজির ২৩ বছর নবুওয়াতী জীবনে ইসলাম সুদূর রোম পর্যন্ত পৌছে যায়। যা পরবর্তী খলিফাদের আমলে বিশেষত হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে ইসলাম অর্ধ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ইসলামের গণ্ডি পুরা পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত।

ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু মক্কা থেকে ৫১৬৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমাদের এই বঙ্গদেশে ইসলাম কখন এসেছে বা কাদের মাধ্যমে এসেছে মনের মধ্যে এমন একটি প্রশ্ন জেগে উঠা স্বাভাবিক। এই প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর দেয়া না গেলেও ঐতিহাসিকদের আলোচনা, গ্রন্থ,বিভিন্ন মুদ্রা, প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু জিনিসপত্র থেকে সে প্রশ্নের একটা উত্তর বের করা যায়। যেমন--

এক.
মুহাদ্দিস ইমাম আবাদান মারওয়াযীর গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনু ওয়াহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু নবুওয়াতের ৫ম বছর তথা ৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে হাবশায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করেন। নবুওয়াতের ৭ম বছর অর্থাৎ ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকজন সাহাবী এবং কিছু সংখ্যক তাবেয়ীকে নিয়ে দুটি জাহাজ ভর্তি করে চীনের উদ্দেশ্যে সাগর ফাঁড়ি দেন।[১]
শাইখ যাইনুদ্দীন তার রচিত গ্রন্থ ‘‘তুহফাতুল মুজাহিদীনে’’ লিখেন যে, ভারতের তামিল ভাষার প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে একদল আরব জাহাজে চড়ে মালাবার এসেছিলেন। তাদের প্রভাবে মালাবারের রাজা চেরুমল পেরুমল ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর মক্কায় গিয়ে তিনি কিছুদিন নবিজির সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, একদল আরব বলতে সাহাবী আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনু ওয়াহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাফেলাটিকে বুঝিয়েছেন এবং তার মাধ্যমেই রাজা চেরুমল পেরুমল ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিলেন। [২]

দুই.
দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে হিজরী ১৫ সনে সিন্ধু অভিযান শুরু করেছিলেন যা ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে ( হিজরী ৯০ সনে) মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে বিজয় অর্জিত হয়। আর সিন্ধু বিজয়ের পর মুসলমানরা তার আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হিজরী প্রথম শতক তথা অষ্টম শতাব্দীতে আমাদের এই বঙ্গে ইসলামের আগমন ঘটে।

তিন.
৭৭০-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় পাল বংশের রাজা ধর্মপাল রাজত্ব করেন। এই সময় রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধ বিহার খননকালে একটি আরবী মুদ্রা পাওয়া যায়। যেটি তৈরী হয়েছিল ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন বাগদাদে আব্বাসীয় খলীফা হারুনুর রশিদের শাসন চলছিল।
একই সময়ে কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে অনুরূপ খননকালে আব্বাসীয় যুগের দুটি মুদ্রা পাওয়া যায়। [৩]

প্রাক ইসলাম যুগ থেকেই আরবরা ব্যবসা বাণিজ্যে অভ্যস্ত। তারা ব্যবসা উপলক্ষে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতেন। আর তৎকালীন সময়ে এখনকার মত স্থলপথ বা আকাশপথে চলাচলের সুযোগ ছিল না। স্থলপথে উট বা ঘোড়া নিয়ে এবং জলপথে জাহাজ নিয়ে তারা যাতায়াত করতেন। আরব সাগর থেকে রওয়ানা দিয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে আসাম এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল দিয়ে চীনে যাতায়াত করতেন। ফলে একসাথে দীর্ঘ পথ ফাঁড়ি দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। এজন্য তারা মাঝপথে বিভিন্ন বন্দরে নোঙর করতেন। এক্ষেত্রে তাদের কয়েকটি ঘাঁটি ছিল। যার মধ্যে প্রথম ঘাঁটি ছিল মালাবার। মালাবার হচ্ছে মাদ্রাজ প্রদেশের সমুদ্রতীরবর্তী একটা জেলা। এর পরের ঘাঁটি ছিল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট ও কামরূপ হয়ে চীন দেশে যাতায়াত করতেন। এসব ঘাঁটিতে তারা কিছুদিন জাহাজ নোঙর করে আবার রসদ জোগাড় করে সামনের দিকে যাত্রা করতেন।[৪]

আরবদের চলাচলের প্রথম ঘাঁটি তথা মালাবারের রাজা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং স্বয়ং নবিজির সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছেন, তখন বলা যায় মালাবার ইসলামের শক্ত একটি ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিলেন। আর প্রথম ঘাঁটির প্রভাব দ্বিতীয় ঘাঁটিতে (চট্টগ্রাম) পড়াটা স্বাভাবিক। যেহেতু মালাবারে যারা ছিল তারা ব্যবসা উপলক্ষে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেন। তাই বলা যায় ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে যখন মালাবারে ইসলাম এসেছিল তখনি-ই আমাদের বাংলায়ও ইসলামের আগমন ঘটেছিল।
এই যে তারা কিছুদিন এক এক জায়গায় নোঙর করতেন, সে সময় তারা স্থানীয় মানুষের সাথে মিশতেন, তাদের কথাবার্তা রপ্ত করতেন। তারা এই দীর্ঘ সফরে স্ত্রী পুত্র সাথে আনতেন না। ফলে প্রয়োজন হলে তারা স্থানীয় নারীদের কে বিয়েও করতেন।
বলা হয়ে থাকে যে, আমাদের বর্তমান চট্টগ্রাম নামটিও আরবদের দেয়া এবং এখানের বাকলিয়া, আল করণ এবং শুলকবহর জাতীয় আরবী নাম গুলো তারই চিহ্ন বহন করে।[৫]

মুসলিমরা যেহেতু মিশনারি জাতি, সেহেতু তারা যখন যেখানে যাক না কেন তারা ধর্মের প্রচার টা ভুলে যেতেন না। তারা যেখানে নোঙর করতেন সেখানে মানুষদের কে ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং যাদেরকে বিয়ে করতেন তাদেরকে মুসলিম করেই বিয়ে করতেন। এভাবে ইসলাম ধর্মের প্রচার সবদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর বাংলাদেশের উপকূল দিয়ে যেহেতু তারা বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেছেন, সেহেতু নিঃসন্দেহে বলা যায় তারা বাংলাদেশের উপকূলে নোঙর করেছিলেন এবং মানুষকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। এ হিসেবে বলা যায় নবুওয়াতের প্রথম শতক তথা সপ্তম শতাব্দীতে বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটে।
এছাড়া উপরোক্ত পয়েন্ট গুলোও নির্দেশ করে যে, ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে তথা সপ্তম,অষ্টম শতাব্দীর দিকে এদেশে ইসলাম আগমন করে। তবে সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত কারা কিভাবে ইসলাম প্রচার করেছে তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্যপ্রমাণ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি। যা হয়েছে তা অনুমান নির্ভর। কিন্তু একাদশ শতাব্দী থেকে যারা বাংলায় ইসলাম প্রচার করেছে তাদের কিছু কিছু বর্ণনা বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।

এক্ষেত্রে দুটি শ্রেণির খুঁজ পাওয়া যায়। এক শ্রেণি হচ্ছে, যাদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের প্রসারের সাথে সাথে রাজ্যও শাসন করা। যেমন- ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী। আরেক শ্রেণি হচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য শুধু ইসলাম প্রচার করা। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন হলে কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন, অন্যথায় ইসলাম প্রচারে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতেন এবং এ পথেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সূফিগণ।
সুতরাং বাংলার মানুষদের ইসলাম গ্রহণে সূফিদের ভূমিকা কি ছিল, তাদের সংখ্যা কত, কোন কোন অঞ্চলে এরা এসেছিলেন, কিভাবে তারা মানুষদের মনে ইসলামের বীজ বপন করেছিলেন এসব নিয়ে পরবর্তী পর্ব গুলোতে আলোচনা করা হবে ইনশা-আল্লাহ।

#তথ্যসূত্র
[১][২] বাংলাদেশে ইসলাম : কয়েকটি তথ্যসূত্র, মুহিউদ্দীন খান, মাসিক মদীনা,জানুয়ারি, ১৯৯২, পৃষ্ঠা : ৪
বাংলাদেশে ইসলামের আগমন : এ কে এম নাজির আহমদ, পৃষ্ঠা : ২০-২১
বাংলাদেশে ইসলাম, আব্দুল মান্নান তালিব, পৃষ্ঠা : ৬৪

[৩] বাংলাদেশে ইসলামের আগমন : এ কে এম নাজির আহমদ, পৃষ্ঠা : ২৩
হিস্ট্রি অব দ্যা মুসলিমস বেঙ্গল, ডঃ মুহাম্মদ মোহর আলী, পৃষ্ঠা : ৩৬
বাংলাদেশে ইসলাম, আব্দুল মান্নান তালিব, পৃষ্ঠা : ৬৬
[৪] বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা : ১৪-১৫
[৫] বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা : ১৯

পঠিত : ৩৩৪ বার

মন্তব্য: ১

২০২৩-০৮-০৭ ১৫:২৮

User
Md. Abdul Ohab Babul

সুন্দর উপস্থাপন

submit