Alapon

কলকাতার ডেঙ্গু ও ঢাকার ডেঙ্গু



ডেঙ্গু ভাইরাস শুধু ঢাকা কিংবা কলকাতা নয়। সারা পৃথিবীর বহু বড় বড় শহরের একটি বড় সমস্যার নাম। তবে এই সমস্যা নিয়ে অন্যান্য শহর বেশ চিন্তিত হলেও ঢাকা কতটা চিন্তিত তা মোটেই বোধগম্য নয়। ঢাকায় ডেঙ্গু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং কয়েক শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু সরকার ও সিটি কর্পোরেশনগুলোরে দৃশ্যমান তৎপরতা খুবই কম।

জলবায়ুর বৈশিষ্টগত দিক থেকে ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি নয়। দুই শহরের দূরত্বও বেশি নয়। জনসংখ্যার আধিক্য, নগরায়ণ, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য—দুই শহরেই প্রায় অভিন্ন। কলকাতায় ডেঙ্গু মহামারি আকারে দেখা দিয়েছিল ১৯৬৩ সালে। ওই সময় ডেঙ্গুতে প্রায় ২০০ মানুষ প্রাণ হারান। আর ঢাকায় প্রাদুর্ভাব ১৯৬৫ সালে।

কলকাতার মতো ঢাকায়ও গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ডেঙ্গু বাড়তে শুরু করে। ১৯৯৮ সালে লীগের আমলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ৯০ জন মানুষ মারা যায়। ৯৯ সালেও ১০০ জন মানুষ মারা যায়। ২০০০ সালে ৯৩ জন ও ২০০১ সালে ৪৪ জন মানুষ মারা যায়।

আওয়ামী লীগের আমলে ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নয়ন হয় না। ২০০১ সালে ডেঙ্গুর সিজন শেষে ক্ষমতায় আসে ৪ দলীয় জোট। ২০০২ সালে ঢাকার মেয়র হন সাদেক হোসেন খোকা। সাদেক হোসেনের জন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

ঐ বছর অর্থাৎ ২০০২ সালে ৫৮ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মেয়র খোকার গৃহিত পদক্ষেপ ২০০৩ সাল থেকে সুফল পেতে থাকে। ২০০৩ সালে ১০ জন, ২০০৪ সালে ১৩ জন, ২০০৫ সালে ৪ জন এবং ২০০৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একজনও মানুষও মৃত্যুবরণ করেনি।

ঢাকা যখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল তখন কলকাতা ডেঙ্গুতে জর্জরিত। মেয়র খোকা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ওয়ার্ডভিত্তিক জনগণকে ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কমিটিকে কাজে লাগিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে জানতে চায় কীভাবে মেয়র খোকা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছিল।

২০১০ সাল থেকে এডিশ মশা নিধন ও বিস্তার রোধে আটঘাট বেঁধে নামে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন। উৎপত্তিস্থলে মশা নিধনে তারা বেশি জোর দেয়। জনগণকে সম্পৃক্ত করে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি করে।

বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এডিস মশার বিস্তার রোধ ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতা সাফল্য পেয়েছে। এ কাজে তারা যেভাবে মানুষকে সম্পৃক্ত করেছে, সেটা সবার জন্য শিক্ষণীয়। আমরা এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি।’

ফগার মেশিন দিয়ে মশা না তাড়িয়ে উৎপত্তিস্থলেই মশাকে ধ্বংস ও বংশবিস্তার রোধ—শুরু থেকেই এই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছে কলকাতা। ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ ১৯৮৫ সাল থেকে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তিনি বলছিলেন, ‘ফগার দিয়ে মশা তাড়ালে এক পাড়ার মশা আরেক পাড়ায় যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমরা তাই উৎপত্তিস্থলে মশা নির্মূলের লক্ষ্য ঠিক করি। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এ ছাড়া উপায় নেই।’

কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তিন স্তরের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১০ সালের দিকে এসব কাজের শুরু হয়। এ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন দেবাশীষ বিশ্বাস।

২০১১ সালে মাত্র চার লাখ টাকায় সেই গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের বেশি কিছু করার দরকার ছিল না। গবেষণাগারে কেবল দেখা হতো, লার্ভা থেকে কীভাবে মশা বেড়ে উঠছে। মশককর্মীদেরও এটা দেখানো হতো। তিন হাজার মাঠকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। চোখের সামনে তাঁদের মশার চরিত্র দেখানো হয়েছিল।’

কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন মোট ১৬টি বরো (প্রশাসনিক অঞ্চল) এবং ১৪৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রতিটি বরোতে ৭ থেকে ১২টি করে ওয়ার্ড আছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, চিকিৎসক ও স্থানীয় ব্যক্তিরা আছেন। আছেন ৬ থেকে ১৫ জন মশককর্মী। প্রত্যেক কর্মীর মশা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ আছে। এসব ওয়ার্ড কমিটির কাছে এলাকার সম্ভাব্য ডেঙ্গুর উৎসস্থলের তালিকা আছে। কলকাতায় প্রতিবছর ১০০ দিনের কর্মসূচি আছে। এসব কর্মসূচিতে যুক্ত ব্যক্তিরা ওয়ার্ড পর্যায়ে মশককর্মী হিসেবে কাজ করেন। জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছয় মাসে তাঁরা সার্বক্ষণিক নজরদারি করেন। জুলাইয়ে মশার প্রাদুর্ভাবের মৌসুমে নজরদারি আরও বেড়ে যায়।

মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটির পাশাপাশি প্রতি ওয়ার্ডে আছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে শুধু ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় মোট ২৫০ চিকিৎসক আছেন। পরীক্ষায় কারও ডেঙ্গু ধরা পড়লে সেই তথ্য নির্দিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ডেপুটি মেয়র, সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও প্রধান ভেক্টর কন্ট্রোল কর্মকর্তার মুঠোফোনে চলে যায়।

ওয়ার্ডের কোন কোন বাড়িতে চৌবাচ্চা, কুয়া বা ডোবা আছে—তার হিসাব ওয়ার্ড কার্যালয়ে আছে। এসব বাড়ির কোনটিতে কবে এডিসের লার্ভা মিলেছিল, তারও একটি তথ্যভান্ডার আছে। তিনি বলেন, কারও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেই ওয়ার্ডের মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটির মাঠকর্মীরা ওই বাড়ি ও আশপাশের ৫০টি বাড়িতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। কোথাও লার্ভা পাওয়া গেলে সেখানে লার্ভানাশক দেওয়া হয়। এভাবেই উৎসে মশা নিধন করা হয়।

ওয়ার্ড কমিটির ওপর আছে বরো কমিটি। এখানেও একটি মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এই কমিটিতে একজন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ও চিকিৎসক আছেন। প্রতিটি বরোতে দুটি করে র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম আছে। তাদের একটি করে গাড়ি আছে। তারা শিক্ষাকেন্দ্র, সরকারি অফিস, বিপণিবিতান, থানা, বেসরকারি বড় স্থাপনাসহ নানা স্থানে নজরদারি করে। তারা কোথাও মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল বা নোংরা-আবর্জনা পেলে প্রথমে মালিক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানায়। জায়গাটি তারা পরিষ্কার করে দেয়। কেউ লার্ভা পাওয়ার স্থানের দায় না নিলে জমির দলিল দেখে মালিকানা চিহ্নিত করা হয়। এরপর আবর্জনা পরিষ্কারের খরচ তাঁর আয়কর নথির সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। আয়কর দিতে গেলে তখন তাঁকে জরিমানার অর্থও পরিশোধ করতে হয়।

নির্মাণাধীন ভবন মশার, বিশেষ করে এডিস মশার বড় আশ্রয়স্থল। কেউ ভবন নির্মাণ করতে গেলেই মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটির পক্ষ থেকে তাঁদের একটি নির্দেশিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে নির্মাণাধীন ভবন কীভাবে মশামুক্ত রাখা যাবে, তার নির্দেশনা থাকে। এসব ভবন হঠাৎ পরিদর্শনে যান র‌্যাপিড অ্যাকশন টিমের সদস্যরা। প্রথম দফায় লার্ভা পেলে জরিমানা করা হয় না। পরে পাওয়া গেলে এক লাখ রুপি জরিমানা করা হয়।

আবার বরো কমিটির ওপর আছে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মশকনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় কমিটি। এই কমিটিতে একজন জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ ও তিনজন মশকনিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা আছেন। কমিটির প্রধান হলেন চিফ ভেক্টর কন্ট্রোল কর্মকর্তা। এই কমিটি সার্বিক কাজ তত্ত্বাবধান করে থাকে। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে অনেক আগেই বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু—এই চার ভাষায় সচেতনতামূলক প্রচারপত্র করা হয়েছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারপত্র পরিবারের মধ্যে বিলি করা হয়। আর সপ্তাহে দুই দিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ডেঙ্গুবিরোধী প্রচার করা হয়।

আর এদিকে ২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বিলুপ্ত হয়ে যায়। ঢাকা সিটি দুইভাগ হয়ে যায়। খোকা মেয়র পদ হারিয়ে ফেলে। হাসিনা কয়েক বছর প্রশাসক দিয়ে কর্পোরেশন চালায়। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে ভোট ডাকাতি করে। দক্ষিণে মেয়র হয় সাঈদ খোকন। আর উত্তরে মেয়র হন আনিসুল হক।

এরপর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২০১১ সালে ৬ জন, ২০১২ সালে একজন এবং ২০১৩ সালে দু’জন মারা যায়। আর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ৬ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে ৮ জন, ২০১৮ সালে ২৬ জন, ২০১৯ সালে ১৭৯ জন, ২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় ডেঙ্গুর হিসাব রাখা যায় নি। তারপরও ৭ জনের খবর পাওয়া যায়।

২০২১ সালে ১০৫ জন এবং সবশেষ ২০২২ সালে ২৮১ জনের মারা যান ডেঙ্গুতে। ২০২৩ এখন পর্যন্ত মৃত্যু ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে।

এটা মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আওয়ামী সরকার জনগণের সরকার নয় বলে তারা জনগণ নিয়ে ভাবে না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে মেয়ররা এভাবে ঢাকার মানুষকে বিপদে ফেলে দিতে পারতো না।

পঠিত : ৩৪৭ বার

মন্তব্য: ০