Alapon

বিমানে শিশু : দায়িত্বে অবহেলা নাকি পাচার সিন্ডিকেট!



হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাসপোর্ট-বোর্ডিং পাস ছাড়া বিমানে শিশু ওঠার ঘটনায় দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। বিমানবন্দরের দায়িত্বরত ১০ জনকে ইতিমধ্যে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তাদের মধ্যে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশ, এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক), কুয়েত এয়ারওয়েজ ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং (বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স) প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রয়েছেন। বিমানবন্দরে একজন যাত্রীকে ১৪টি স্তরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে বিমানে আসন নিতে হয়। এই ১৪টি স্তরের কোথাও শিশুটিকে আটকানো হয়নি কেন- এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। এ ঘটনার পর বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়েও বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এর আগেও নানা ঘটনায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। সময়ে সময়ে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয় পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে। কিন্তু সর্বশেষ শিশুটির বিমানে উঠার ঘটনার পর অনেকে বলছেন, এতদিনে আদতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি।

যদিও মূল ফোকাস দায়িত্বে অবহেলার দিকে কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন এটা পাচারকারী কোনো দলের কাজ। একসাথে এতজন মানুষের দায়িত্বে অবহেলা হওয়া প্রায় অসম্ভব। শিশুটিকে কেউ কি কৌশলে পাচার করে দিতে চাইছিলো? যদি তাই হয় তবে অবশ্যই এখানে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত লোকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানে বিমানের ক্রু ও নিরাপত্তা কর্মীরা জড়িত এমন খবর অনেক আগ থকে সর্বজনবিদিত।

এখানে খুব খেয়াল করার বিষয় যদি বিমানে সিট খালি থাকতো অথবা যদি যাত্রীরা কেয়ারফুল না হতো তাহলে কিন্তু বাচ্চাটা কাতারে চলেই যেত। সেখানে কী পরিস্থিতি হতো তা বলা যাচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে, কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক বাচ্চাটি অবৈধ যাত্রী হিসেবে আবিষ্কৃত হয়নি। যাত্রীদের কারণে বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা গেছে। যদি বিষয়টা পাচারজনিত ঘটনা ঘটে থাকে তবে একথা বলা যায় এরকম পাচার আগেও হয়েছে। শুধু ধরা পড়ে নি। এটা খুবই উদ্বেগজনক।

আর যদি এটা দায়িত্ব অবহেলা জনিত ঘটনা ঘটে থাকে তবে এটা আরো বেশি উদ্বেগজনক। এর মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা যে কোনো সময় বিমান হাইজ্যাক, যাত্রীদের জিম্মি করার মতো বড় সড় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানোর অবকাশ থাকবে। একই সাথে বিমানের নিরাপত্তা নিয়েও বেশ শংকার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

এভিয়েশন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা কারণে বাংলাদেশে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। এ ধরনের ঘটনা সামনে এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। বুধবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, শিশুটি বিমান পর্যন্ত যাওয়ার ঘটনায় যাদের গাফিলতি ছিল, গত মঙ্গলবারই প্রত্যেককে সাসপেন্ড করার নির্দেশনা দেয়া হয়। তাদের মধ্যে ১০ জনকে চিহ্নিত করে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এ ছাড়া এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, কীভাবে ইমিগ্রেশন পার হলো সেটা আমারও প্রশ্ন। ধারণা করা হচ্ছে ইমিগ্রেশন করার সময় হয়তো কোনো পরিবারের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল শিশুটি। তারপর ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেও পার হয়ে গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।

বিমানে ওঠা শিশুটির নাম জুনাইদ মোল্লা। বয়স আনুমানিক ১২ বছর। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার বরইহাটি গ্রামের বাঁশবাড়িয়ায় তার বাড়ি। বাবার নাম ইমরান মোল্লা। মা জেসমিন আক্তার। শিশুটি স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।

ফ্লাইটটির সব আসনে যাত্রী ছিল। শিশুটি তখন করিডোরে হাঁটাহাঁটি করছিল। বিষয়টি যাত্রীদের নজরে আসার পর তারা কেবিন ক্রুদের অবহিত করেন। তারা দেখতে পান শিশুটির কাছে এ সময় কোনো টিকিট, পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস নেই। ফ্লাইটে ওই সময় তার কোনো আত্মীয়স্বজন কিংবা কোনো প্রতিবেশীও ছিল না। শিশুটি এ সময় কেবিন ক্রুদের কোনো প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছিল না। প্রথমে তারা ধারণা করছিলেন শিশুটি বোর্ডিং পাস পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু বোর্ডিং মেশিন তল্লাশি করে দেখতে পান এই নামে কোনো বোর্ডিং পাস ইস্যু হয়নি। শিশুটির শরীর তল্লাশি করে তার পকেটে একটি টেলিফোন নম্বর পাওয়া যায়। ওই নম্বরে ফোন করলে তার দাদি ফোন রিসিভ করেন। পরে তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশুটিকে তারা ২ দিন ধরে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। মঙ্গলবার ভোররাতে এ ঘটনার পর ওইদিন শিশুটিকে প্রথমে বিমানবন্দর থানায় নেয়া হয়। পরে তাকে পরিবারের জিম্মায় দেয়া হয়। ঘটনায় এদিন দুপুরে বিমানবন্দরের ডিউটি সিকিউরিটি অফিসার (ডিএসও) খুরশিদা খাতুন বিমানবন্দর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখছেন কীভাবে শিশুটি প্রথমে বিমানবন্দরে প্রবেশ করে ফ্লাইটে উঠেছিল। তারা দেখতে পান, ইমিগ্রেশন, অ্যাভসেক তল্লাশি ও সিকিউরিটি চেক না করে শিশুটি নির্বিঘ্নে ফ্লাইটে উঠে যাচ্ছে। এটি দেখে অবাক হয়ে পড়েন সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনকে বহনকারী ভিভিআইপি ফ্লাইটটি এয়ারপোর্ট ত্যাগ করার মাত্র ১০ ঘণ্টা পর বিমানবন্দরের এমন চিত্র পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

এটি বিমানবন্দরের কোনো আদম পাচার সিন্ডিকেটের কাজ হতে পারে বলেও কেউ কেউ সন্দেহ করছেন। ১২ বছর বয়সী গ্রামের একটি শিশুর পক্ষে কোনোভাবেই বিমানবন্দরের ১৪ স্তর পেরিয়ে ফ্লাইটে ওঠা সম্ভব নয়।

পঠিত : ৩০৯ বার

মন্তব্য: ০