Alapon

পরিসংখ্যান, দ্য স্ট্যাটিসটিক্স

 পৃথিবীর স্বৈরাচাররা একই রকম হয়। তারা জনগণের ভালোবাসা পায় না। তাই তাদের নানান ডিগ্রীর, নানান স্বীকৃতির, নানান উপাধির প্রয়োজন হয়। মাংসখেকো ইদি আমিন থেকে শুরু করে আমাদের শেখ হাসিনা অথবা কিম জং উন কেউ  এর বাইরে নয়।




এই দুইটা পত্রিকার নিউজটি দেখুন। যে কয়টি পত্রিকায় এসেছে তারা সবাই হুবুহু একই নিউজ করেছে। 

বাংলাদেশ প্রতিদিন শিরোনাম করেছে “বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত শেখ হাসিনা”। কিন্তু আলোচ্য সংবাদের বিষয়বস্তু এমন শিরোনাম ‘ডিমান্ড’ করে না। কারণ ‘মন্ত্রিসভা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে’ এটা ফলোআপ সংবাদ। ‘কেন’ অভিনন্দন জানিয়েছে? ‘বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত’ হওয়ায়। অর্থাৎ, মনোনীত হওয়ার বিষয়টি আগে ঘটেছে। আর সেই ‘খবর’ পেয়ে মন্ত্রিসভা অভিনন্দন জানিয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘খবর’টি আগে জানেনি। এবং পত্রিকাটি মনে করেছে, তার পাঠক এখনও মূল খবরটি (বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার) জানে না (অন্য সংবাদমাধ্যমও দেয়নি), তাই এটার পাঠক চাহিদা আছে। ফলে আগের ঘটনাকেই শিরোনামে এনেছে। যদি মনে করতো যে, এই খবর আগে থেকে মানুষের জানা, তাহলে উপরের প্রতিবেদনের শিরোনাম করতো ‘বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন’। এবং এটাই সঠিক শিরোনাম।

এখানে একটি প্রশ্ন জাগতেই পারে, প্রচার সংখ্যায় বাংলাদেশের এক নম্বর পত্রিকাটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হওয়া’র খবর রাখেনি কেন? এই খবর পাওয়ার জন্য মন্ত্রিসভার অভিনন্দন জানানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো কেন পত্রিকাটিকে?

এই প্রশ্নটি শুধু বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্য নয়, উপরের উল্লেখ করা সবক’টি সংবাদমাধ্যমের জন্য- যারা ফলোআপ ঘটনার সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে আগের ঘটনাকে নিয়ে শিরোনাম করেছে। কেন এত সংখ্যক সংবাদমাধ্যম এত বড় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সঠিক সময়ে জানতে পারেনি? ((এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, গুগলে ‘দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ এই বাক্যটির সাথে উপরিউক্ত পত্রিকা/পোর্টালগুলোর ওয়েবসাইটের ঠিকানা দিয়ে সার্চ করে কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে ‘ফলোআপ’ ঘটনা জানার আগে এরা কেউই এই বিষয়ে কোনো রিপোর্ট’ প্রকাশ করেনি।))

দ্বিতীয় যে বিষয়টি বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্টে লক্ষ্য করতে বলেছি তা হচ্ছে- যে সংগঠনটির ‘গবেষণা’য় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সেটির পরিচয় হিসেবে লেখা হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গবেষণা সংস্থা দ্য স্ট্যাটিসটিক্স’। অর্থাৎ, সংস্থাটি অনেক বড় এবং পরিচিত (খ্যাতি বলতেই তো ব্যাপক পরিচয় থাকাকে বুঝায়)। এত বড় সংস্থার গবেষণার ফলাফল-- যা নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে-- কেন মন্ত্রিসভার কাছ থেকে জানতে হলো? আসলে তো এর উল্টো হওয়ার কথা ছিল! সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকেই জানার কথা মন্ত্রিসভা বা সরকারের!

আসুন খ্যাতি সম্পন্ন সেই 'দ্য স্ট্যাটিসটিক্স' এর জন্য অনুসন্ধান শুরু করি। শুরু করি খোঁজ, দ্য সার্চ।অনুসন্ধানের শুরুতেই সংবাদটির শিরোনামের অংশ ‘বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী’ লিখে গুগলে সার্চ করলে দেখা যায় সংবাদটি আজ সোমবার মন্ত্রীসভায় আলোচিত হলেও এটি ৪দিন আগেই ‘পায়রা বিডি নিউজ’ নামে একটি নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনদিন আগে ekattornews24.com নামে একটি অনলাইন পোর্টালেও নিউজটি প্রকাশিত হয়। এরপর আজকেই মূলত মন্ত্রীসভায় অভিনন্দন প্রস্তাব আনার পর থেকেই বাংলাদেশের মেইনস্ট্রীম মিডিয়াগুলোতে নিউজটি আসতে শুরু করে। আজ প্রকাশিত পোর্টালগুলোর মধ্যে রয়েছে- চ্যানেল আই অনলাইন, একুশে টিভি অনলাইন, পরিবর্তন, মানবকণ্ঠ ইত্যাদি। তবে মানবকণ্ঠের নিউজটির লিংকে গিয়ে দেখা গেছে তারা নিউজটি সরিয়ে নিয়েছে।

৪ দিন আগে প্রকাশিত পায়রা বিডি নিউজের সংবাদটিতে বলা হয়,
“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। এই তালিকার প্রথমে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। দক্ষ নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলী, মানবিকতা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নসহ ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আলোচনায় থাকার বিষয় বিবেচনা করে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘দ্য স্টাটিস্টিকস ইন্টারন্যাশনাল’ নিজেদের করা এক জরিপ শেষে এই ঘোষণা দেয়।

‘শেখ হাসিনার সম্পর্কে দ্য স্টাটিস্টিকস ইন্টারন্যাশনাল জানায়, ‘২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু। জাতিগত নিধনের শিকার নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা মানবিক এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি শুধু আশ্রয় দিয়ে ক্ষ্যান্ত থাকেননি, বরং মিয়ানমারে তাদের নিজ ভূমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক লড়াই করে গেছেন। এ বিষয়ে তিনি সফল হয়েছেন। বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতায় মিয়ানমার বাধ্য হয়েছে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে। অনেক আন্তর্জাতিক নেতাও এত দ্রুত সময়ে এমন সফলতা পান না। তাই তিনি বিশ্বের স্বনামধন্য মিডিয়ায় নিজ যোগ্যতায় পুরো বছর কাভারেজ ধরে রাখতে পেরেছেন।”

সবগুলো সংবাদেই ‘দ্যা স্ট্যাটিসটিকস ইন্টারন্যাশনাল’ নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়।  অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করে the statistics international বা statistics international নামে ওরকম কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এমন একটি প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নামে ওয়েবসাইট থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ই্ন্টারনেটে এই নামে কোনো ওয়েবসাইটই খুঁজে পায়নি অ্যানালাইসিস বিডি। সার্চ করতে গিয়ে thestatisticsinternational.com/.net/.org নামে thestatistics.com/.net/.org নামে এবং thestatistix.com/.net/.org নামেও কোনো সচল ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি। statistics.net/.org নামে কিংবা statistix.com/.net/.org নামেও ওরকম গবেষণাধর্মী কোনো ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

তবে statistics.com নামে একটি ওয়েবসাইট পাওয়া গেছে। যেটি একটি পরিসংখ্যান শিক্ষা বিষয়ক সাইট। ওয়েবসাইটটির সার্চবক্সে ‘best prime minister’ ‘Prime Minister of Bangladesh’ ‘Sheikh Hasina’ ‘Bangladesh’ ইত্যাদি কীওয়ার্ড সার্চ করে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্যই খুঁজে পায়নি অ্যানালাইসিস বিডি।

এছাড়া গুগলে ‘best prime minister’ ‘best prime minister in the world’ ‘Sheikh Hasina ‍second best prime minister’ ইত্যাদি নানা কীওয়ার্ডে সার্চ করেও সাম্প্রতিক সময়ের এমন কোনো সংবাদের লিংক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিশ্বের সেরা প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে এমন একটি জরিপ অবশ্যই ইন্টারন্যাশনাললিভাবে অনলাইনে আলোচিত একটি সংবাদ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ইংরেজীতে বিভিন্ন কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চে করেও এই সংবাদ কিংবা উক্ত প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব না পাওয়ায় এই সংবাদটি একটি ভুয়া সংবাদ হিসেবেই প্রমাণিত হয়।

যাই হোক সব মিলিয়ে এইটাই দেখা যায় শেখ হাসিনা দুই নম্বর। তার মন্ত্রীসভাও দুই নম্বর। তারা এটাই প্রতিষ্ঠা করলো। 

পঠিত : ৯৯২ বার

মন্তব্য: ০