Alapon

আড়ং বয়কটের পরও কেনো তাদের আউটলেটে কিছু মানুষের ভীড় লেগেই আছে?



কিছুদিন ধরে আমার কাছে ক্রমাগত খবর আসছে যে আমাদের জেলায় আড়ং এর যে বৃহৎ আউটলেট আছে সেখানে ঈদ উপলক্ষে উপচে পড়া ভীড়। শুরুতে বিশ্বাস করতে পারিনি, তবে আঞ্চলিক বিভিন্ন গ্রুপে মানুষের কমেন্ট ও পোস্ট দেখে বুঝতে পারলাম যে ঘটনা সত্য হলেও হতে পারে।

কয়েকদিন আগে দুপুরে আমার আম্মু এক যায়গা থেকে ফেরার পথে দেখেছেন যে আড়ং এর দোকানে আসলেই প্রচুর মানুষ। পরে বিষয়টা নিয়ে আমি কিছুটা অনুসন্ধান শুরু করলাম। সারাদেশ যেখানে এলজি টিভি প্রমোটের কারণে আড়ংকে বয়কট করেছে, সেখানে আড়ং এর শো-রুমে এতো ভীড় কেনো।

আমার ব্যাক্তিগত অনুসন্ধানে যা বেরিয়ে এলো, আমাদের জেলায় আড়ং এর শো-রুম যেই অঞ্চলে সেটা মূলত একটা সো-কল্ড নব্য গড়ে ওঠা অভিজাত এলাকা। এই এলাকায় নতুন নতুন কিছু মাল্টি-স্টোরেড বিল্ডিং ও ফ্ল্যাট কালচার গড়ে ওঠেছে।

সে যায়গায় যারা থাকে তারা মূলত আমাদের বর্তমান সমাজে নতুন গড়ে ওঠা সো-কল্ড পশ্চিমা প্রভাবিত এলিট গোষ্ঠী যারা দ্বীন থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। এদের শুধু নামটাই মুসলিম, আর বাকি সব পশ্চিমা। এদের জিজ্ঞেস করলে এরা ভালো করে কালিমা তাইয়্যেবাটাও বলতে পারবে না। কিছুটা ঢাকার গুলশান ও বনানীতে যেমন কিছু এলিয়েন টাইপের এলিট মানুষের দেখা পাওয়া যায়, এরা ঠিক তেমনি উদ্ভট কিছু মানুষজন। এরা কেউই আমাদের এখানের স্থানীয় মানুষজন না, বরং অধিকাংশই ঢাকা থেকে আসা এখানের বিভিন্ন নতুন গড়ে ওঠা প্রাইভেট কোম্পানির কর্পোরেট চাকুরীজীবী।

এরাই আড়ং এর মূল ক্রেতা। এদের কাছে কাপড় না বরং ব্রান্ডটাই আসল। কারণ ব্রান্ড দিয়ে ফুটানি মারা যায়। তাই এরা আড়ং এ আসে। এদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, এরা অনেকে জানেই না যে বাংলাদেশে ব্র্যাক ও আড়ং এর বিরুদ্ধে বয়কট আন্দোলন চলছে। অনেকে আবার জানলেও সেটাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না।

আড়ং এ দ্বিতীয় বৃহত্তম আরেক শ্রেণীর ক্রেতা হলো গ্রাম থেকে আসা বিভিন্ন প্রবাসীদের স্ত্রী ও আত্মীয় স্বজনরা। কথিত উন্নত লাইফ স্টাইলের আশায় তারা শহরে এসে থাকছেন। নিজের শেকড়কে মুছে ফেলে শহরের পশ্চিমা লাইফ স্টাইলে চলার চেষ্টা ও নিজেদের স্ট্যাটাস বজায় রাখার চেষ্টা করছেন এরা। তো এখানের সবচেয়ে দামী ব্রান্ড থেকে চড়া দামে কিনতে পারলে ফুটানিটা ভালোই মারানো যাবে। তাই কিনছে এরা।

এদের অনেককেই জিজ্ঞেস করলাম যে আড়ং ও ব্রাকের বিরুদ্ধে যে বয়কট আন্দোলন চলছে, এই বিষয়ে এরা জানে কিনা। অবাক করা বিষয় এরা জানেই না। মানে দুনিয়াতে কি হচ্ছে, এই দেশেই একদল মানুষ ক্রমাগত এলজি টিভির মতো নষ্টামির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে - এসব তারা জানেই না।

তৃতীয় শ্রেণীর ক্রেতাদের মধ্যে আছে শহরের কথিত কিছু সংস্কৃতি মনা শাহবাগী টাইপের উদ্ভট মানুষজন, কলেজ ও স্কুলের দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীন পোলাপান ও হিন্দুরা।

মজার ব্যাপার হলো, আড়ং শো-রুমে বোরখা হিজাব পড়া অনেক নারীদেরও দেখলাম। দাঁড়ি-টুপি ওয়ালা অনেক মুসলিম পুরুষদেরও দেখলাম। এদেরকে জিজ্ঞেস করলাম কেনো এখানে কিনতে এলো। তারা অবাক করা কথা বললো, তা হলো যে এই বয়কট আন্দোলনের ব্যাপারে তারা তেমন কিছুই জানে না। অনেকে শুনেছে যে বয়কট আন্দোলন হচ্ছে, তবে কি কারণে হচ্ছে তারা এই বিষয়ে জানে না।

এরপর আমি প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য বিভিন্ন এলাকার নানা যায়গায় খোঁজ নিলাম। যা জানতে পারলাম, সমাজের সাধারণ মানুষজন এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। অনেকেরা জানলেও তাদের ধারণা ভাসা ভাসা। আর যারা ভালো করে জানে, তারা মূলত আমাদের মতো ইয়াং শিক্ষিত ছেলে-পেলে। তারা জেনেও এই বিষয়ে কাউকে সচেতন করছে না।

অনেকে বললো যে সচেতন করছে ব্যাক্তিগতভাবে, তবে তেমন লাভ হচ্ছে না। কারণ মানুষ আসলে জানেই না এলজি টিভি কি!

আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো আমি বিভিন্ন মসজিদে ইমাম ও আলিমদের সাথেও কথা বলেছি। অনেকেই এসব ব্যাপারে একেবারেই জানেন না। আর যেসব ইমাম ও আলিমরা জানেন, তারা মূলত আমাদের বয়েসি তরুণ, যাদের অনলাইন জগতে বিচরণ আছে।

আমাদের ব্র্যাক ও আড়ং বিরোধী আন্দোলনের মূল সমস্যা ছিলো এটাই যে এই আন্দোলনটা শুধুই অনলাইন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো। এটাকে আমরা সমাজের মূল রুট পর্যন্ত নিয়ে যেতে অনেকটাই ব্যার্থ হয়েছি।

আমাদের উচিৎ ছিলো অনলাইনে একদিকে যেমন ভাবে মানুষকে সচেতন করা, পাশাপাশি অফলাইনেও যেসব ভাইরা এসব বিষয়ে জানেন, তারা প্রতি এলাকা ভিত্তিক কয়েকজন মিলে ছোট্ট ছোট্ট গ্রুপ তৈরি করা। রমজানে অনেক অবসর সময় পাওয়া যায়। সে অবসর সময়ে দোকানে দোকানে, চায়ের স্টলে, মসজিদের বারান্দায় বসে সমাজের মূল ধারার মানুষদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা।

বিশেষ করে মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার আলিমদের কাছে গিয়ে তাদেরকে বিষয়টা ডিটেইলস এ বুঝালে তারাই জুমার খুতবায় ও ওয়াজ-মাহফিল ও দ্বীনি হালাকায় মানুষদের সচেতন করে তুলতে পারতো।

হ্যা, আমরা ব্র্যাক ও আড়ংকে পর্যদুস্ত করতে পেরেছি। আগে যেমন বিশাল বড় জনসমাগম হতো তাদের আউটলেটে এখন তেমন নেই। তবে যেসব মানুষ যাচ্ছে, তাদের সংখ্যাটাও কম না। এলাকা ভিত্তিক ক্যাম্পেইন ও আলিমদের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা গেলে আন্দোলন যেই স্যোশাল মোবিলিটি পেতো, সেটাই যথেষ্ট ছিলো আড়ং ও ব্র্যাককে পথে বসাতে।

তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে যদি এদের কার্যক্রমের ব্যাপারে মানুষের মাঝে প্রকৃত সচেতনতা তৈরি করা যেতো, মানুষজন ব্র্যাকের অফিস গুড়িয়ে দিতো। কারণ শহরাঞ্চলের কাপুরুষ আরামপ্রিয়ো মুসলিম আর গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মুসলিমদের মাঝে পার্থক্য আছে। গ্রামের মানুষ ইসলামের প্রশ্নে কতোটা বেপরোয়া পদক্ষেপ নিতে পারে তা আমি পূর্বে দেখেছি, যেটা শহরের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।

আমাদের কৌশলগত কিছুটা ভুল হয়েছে, আশাকরি আমরা এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যত আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ করতে পারবো।

[বিঃদ্রঃ সামাজিক সচেতনতা ও আলিমদের মাধ্যমে সচেতনতা অনেক যায়গায়ই করা হয়েছে, তবে সেটা যথেষ্ট ছিলো না। পুরো দেশের সব অঞ্চল পর্যন্ত সেটা পৌছাতে পারে নি। আর গ্রামাঞ্চলে তো আরো আগে না।]

পঠিত : ১৬০ বার

মন্তব্য: ০