Alapon

সালাফি মতবাদের বিভক্তি ও বিভিন্ন উপধারা



সালাফি কাকে বলে? যদি সহজ ভাষায় বলতে যাই, তাহলে এভাবে বলা যায়, “ সালাফে সালেহিন এর অনুসারী যারা তাদের সালাফি বলে”। সালাফে সালেহিন হলেন ইসলামের প্রথম ৩ যুগের হক্বের উপর অটল নেককার মানুষেরা। তাদের মাঝে রয়েছেন সাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈগণ। তাদের পরবর্তী যেসকল প্রজন্ম উক্ত ৩ যুগের মানুষদের অনুসরণ করবে তারাই সালাফি।

তবে স্বাধীন একটি স্বতন্ত্র মতবাদ হিসেবে সালাফিজমের জন্ম হয় ১৭০০-১৮০০ খিষ্টাব্দের মাঝে জাজিরাতুল আরবের (আরব উপদ্বীপের) নজদ অঞ্চলে শাইখ মোহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদী (রহঃ) এর হাত ধরে। সে সময়ে সারা পৃথিবীর কোথাওই ১০০% বিশুদ্ধ ইসলাম ছিলো না। প্রায় যায়গায় ইসলাম তখন বিভিন্ন আঞ্চলিক রীতি-নীতি ও ভ্রান্ত সুফিজমের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের বিশুদ্ধ স্বকীয় বৈশিষ্ট হারিয়েছিলো। এমন অবস্থায় আরবের নজদ অঞ্চলে আগমন ঘটে শাইখ মোহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ) এর। শির্ক-বেদাত মুক্ত বিশুদ্ধ ইসলামি আক্বীদা ও ইসলামের প্রথম ৩ যুগের সালাফদের অনুসরণের উপরই বেশি জোর দিতেন তিনি।

প্রকৃত ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ ও আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন কায়েমের জন্য লড়াই করাটা তার মানহাজের অন্যতম বৈশিষ্ট ছিলো। তাই দেখা যায় সে সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যারাই লড়াই করেছে, তারাই তাঁর দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। এমনকি সে সময়ে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে অত্যাচারী বৃটিশ ও তাদের দোসর হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে হওয়া বিভিন্ন বিদ্রোহ শাইখ মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। যেমন: সাইয়্যেদ আহমেদ বেরেলভি ও শাহ ইসমাইল দেহলভি (রহঃ) এর নেতৃত্বে পশ্চিম ভারতে বৃটিশ ও অত্যাচারী শিখ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যে জিহাদের সুচনা হয়েছিলো, তা ছিলো শাইখ মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব দ্বারা অনেকাংশেই প্রভাবিত। কারণ সাইয়্যেদ আহমেদ ও শাহ ইসমাইল উভয়েই মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। অন্যদিকে প্রায় কাছাকাছি সময়ে বাংলায় তিতুমিরের বৃটিশ ও অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও হাজী শরিয়তুল্লাহের ফরায়েজি আন্দোলনও শাইখ মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব এর মতবাদ দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত ছিলো।

শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ ইং পর্যন্ত চলা আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চলা মুসলিমদের জিহাদ, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিরুদ্ধে আফগানদের চালানো জিহাদ, ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইরাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে চলা জিহাদ, ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া রাশিয়া-চেচেন যুদ্ধ সহ সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন অত্যাচারী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিরোধ যুদ্ধের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে সালাফি মতবাদ।

তবে বর্তমান সময়ে আমরা সৌদি আরবের সালাফি স্কলারদের দেখি আমেরিকা ও ইজরায়েলের দালালী করতে। বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের হয়ে চাটুকারীতা করতে। মানুষকে শাসক পূঁজা শেখাতে। “আমেরিকা ও ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বললে খারেজি”, “অত্যাচারী দালাল শাসকের বিরুদ্ধে কথা বললে খারেজি”, “শাসক কাফির হোক বা মুশরিক হোক শাসকের আনুগত্য করতে হবে”, “শাসকের কথাকে ওহির উপরে প্রাধাণ্য দিতে হবে”, “সবার উপরে শাসক সত্য তাহার উপরে নাই”, “আমেরিকা ও ইজরায়েলের আনুগত্যের মধ্যেই মুসলিম জাতির কল্যান” – এসব চিন্তাধারা সৌদি আরবের সরকার সমর্থিত সালাফিদের মাঝে দেখা যায়। যার ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিমদের মাঝে সালাফিজমের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

চলুন আমরা দেখে নেই সালাফিজমের বিপ্লবী এই আদর্শের মাঝে কবে থেকে ফাঁটল ধরলো, বর্তমানে সালাফিদের মাঝে বিদ্যমান উপদল সমূহ কি ও কাদের আদর্শ কি।

সালাফিদের বিভিন্ন উপদল

সালাফিদের মাঝে মূলত ৩টি উপদল রয়েছে। যথা: মাদখালী সালাফি, ইখওয়ানি সালাফি, নজদি সালাফি।

১। মাদখালী সালাফি

মূলত উপসাগরীয় যুদ্ধের পর আমেরিকা, ইজরায়েল, সৌদি আরবের দালাল শাসকবর্গ ও উপসাগরীয় দেশের আমেরিকার ও ইজরায়েলের দালাল শাসকবর্গের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সৌদি আরবের তথাকথিত ইসলামিক স্কলার রাবী আল মাদখালী এর মাধ্যমে এক নতুন মতবাদের জন্ম হয় যা মাদখালীজম নামে পরিচিত।

মাদখালীজমের মূল কথা হলো যে আমেরিকা, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইজরায়েলের আনুগত্য করতে হবে। তাদের বিরোধীতা করা যাবে না। তাদের বিরোধীতা করলেই খারেজি। আমেরিকা-ইজরায়েলের নিঃশর্ত আনুগত্য করতে হবে, দাসত্ব করতে হবে। তারা যতোই আগ্রাসন চালাক ও অত্যাচার চালাক তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেয়া যাবে না, দিলেই খারেজি।
আর আমেরিকা ও ইজরায়েল সমর্থিত মুসলিম বিশ্বের দালাল শাসকদের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যাবে না। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বললেই খারেজি। তাদের আনুগত্য করতে হবে। এমনকি শাসক যদি কাফির মুশরিকও হয় শাসকের আনুগত্য করতে হবে। শাসকের কথা ওহির উপরে প্রধান্য পাবে। এক কথায় শাসকের পূঁজা করতে হবে। মাদখালিদের মতে জিহাদ হারাম।

এমনকি কোনো মুসলিম পুরুষের সামনে তার মা-বোনকে কেউ ধর্ষণ করলেও সে প্রতিহত করা দূরে থাক, ন্যুনতম প্রতিবাদও করতে পারবে না। করলেই খারেজি হয়ে যাবে সে। তাই সে সময়ে তার উচিৎ হবে ধর্ষকের আনুগত্য করা। এই ভ্রান্ত মাদখালি মতবাদকেই তারা সালাফি মতবাদ হিসেবে চালিয়ে দিতে চায়।

বর্তমানে আরব রাষ্ট্র সমূহের সরকার সমর্থিত সালাফিরা মূলত মাদখালী। যারা শাসক, আমেরিকা ও ইজরায়েলের পূঁজার করতে জনগণকে উৎসাহিত করে।
বাংলাদেশে কথিত সহিহ আক্বীদার লোক, আহলে হাদিস ও সালাফিদের বড় অংশই মাদখালী। সৌদি অর্থায়নে এই মাদখালী ধর্ম বাংলায় প্রচার হয়।

২। ইখওয়ানী সালাফি

ইখওয়ানী সালাফিরা শাইখ মোহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের সংগ্রামী চিন্তা-চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হলেও তারা মূলত ইখওয়ানুল মুসলিমিন তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের মতবাদ দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত। এক কথায় এই গোষ্ঠী মোহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের চিন্তাধারা দ্বারা যতোটা না প্রভাবিত, তার চেয়ে অধিক প্রভাবিত হাসান আল-বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ, আবুল আলা মৌদুদীর চিন্তাধারা দ্বারা, যাদের প্রত্যেকের চিন্তাচেতনাই পশ্চিমা দর্শন ও চিন্তা-ধারা দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত।
তবে বর্তমান সময়ে তারা হাসান আল-বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ, আবুল আলা মৌদুদীর চিন্তাধারাকেও পুরোপুরি অনুসরণ করে না, বরং মডারেট শায়েখ ইউসুফ আল কারদাওয়ির চিন্তা-চেতনাকেই অত্যাধিক পরিমাণে অনুসরণ করে। তারা মূলত খিলাফাহ বা ইসলামী ইমারাহের বদলে আমেরিকা নির্দেশিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা, পূঁজিবাদ, লিবারেলিজম দ্বারা প্রভাবিত। তারা ইসলামের যে ভার্শনের কথা বলে, তা হলো পশ্চিমা নির্দেশিত সিভিল ডেমোক্রেটিক ইসলাম।

তাদের একাংশের মাঝে আবার পশ্চিমাদের পাশাপাশি ইরানের প্রভাবও রয়েছে। তারা চায় ইরান মডেলের গণতান্ত্রিক কথিত ইসলামী রাষ্ট্র।

৩। নজদী সালাফি

সালাফিদের এই গোষ্ঠীটি হলো প্রকৃত অর্থেই রাসুল (সাঃ), তাঁর সাহাবি, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈগণের প্রকৃত অনুসারী। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে সালাফদের অনুসারি। তারা শির্ক-বেদাতের বিরুদ্ধে যেমন কথা বলে, যেমন তারা পূর্ণাঙ্গ তাওহিদের কথা বলে, তেমনি তারা নববী মানহাজে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহের পথ ধরে প্রকৃত ইসলামি শরিয়াহ শাসিত রাষ্ট্র ইসলামি ইমারাহ গঠনের কথা বলে। এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম ভূ-খন্ডে ইসলামি ইমারাহ গঠনের পর সকল ইমারাহকে একত্রিত করে খিলাফাহ কায়েমের কথা বলে। তারা আমেরিকা ও তার পশ্চিমা ও আঞ্চলিক মিত্রদের বিরুদ্ধে যেমন সোচ্চার, তেমনি ভাবে চীন-রাশিয়া ও তাদের অঞ্চলিক মিত্রদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এক কথায় পৃথিবীর সকল সাম্রাজ্যবাদী, নব্য-উপনিবেশবাদী ও আধিপত্যবাদী কুফুরি শক্তির বিরুদ্ধে তারা। তাছাড়া এসব সাম্রাজ্যবাদী কুফুরি শক্তির দালাল বিভিন্ন মুসলিম ভূখন্ডের উপর জেঁকে বসা তাগুত শাসকদের বিরুদ্ধেও তারা।

অর্থাৎ এক কথায় ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়নে ইচ্ছুক একমাত্র হক কাফেলাই হলেন তারা। আল-কায়েদা ও আল-কায়েদার সমমনা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থানরত ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো এই মতাদর্শের অনুসারী। এককথায় বলা যায়, সাহাবী (রাঃ)গণের সময়কার যেই প্রকৃত ইসলাম, তা কেবল মাত্র এই একটি মতাদর্শের মানুষদের মাঝে আপনি খুঁজে পাবেন। একমাত্র নজদী সালাফিরাই দ্বীনের ক্ষেত্রে কোনো খিয়ানত করে না। আল্লাহর দেয়া প্রতিটা বিধানকে তারা মাথা পেতে নেয়, পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ত্যাগ করে না। তারাই সব কুফুরি শক্তির বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, দুনিয়ার যেই প্রান্তেই মুসলিমরা নির্যাতিত হয়, নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে।

উপরোক্ত আলোচনা ছিলো সালাফি আন্দোলনের তিনটি উপদলের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা যা যেকোনো সাধারণ মানুষই বুঝতে পারবে। যেকোনো মুসলিম তার নিরপেক্ষ মন নিয়ে আলোচনাটি পড়লেই বুঝতে পারবেন যে এখানে কোন দলটি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ও কোন দলটি মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠি

পঠিত : ৭৩৪ বার

মন্তব্য: ০