Alapon

যুবসমাজ ও নৈতিকতা :


শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলে, আমি বলবো নৈতিকতা সম্পন্ন যুবসমাজ হল জাতির হৃদপিন্ড। তাই আদর্শ জাতি গঠন করতে হলে আগে জাতির যুবসমাজকে নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষা দিতে হবে। পৃথিবীতে যত জাতি বা সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছে তার বেশির ভাগ জাতি বা সম্প্রদায় নৈতিকতা বিচ্যুতির কারণে। আমরা যদি পূর্বের আদ্ জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করতে চাই দেখা যাবে আদ জাতি ধ্বংসের মূল কারণ ছিল নৈতিক অধঃপতন। তাদের জাতির লোকেরা সমাজের সকল ধরণের নিকৃষ্ট কাজের সাথে তারা জড়িত ছিল। পরবর্তীতে আমরা যদি রোমান সভ্যতার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো তাদের পতনের মূল কারণগুলোর মধ্যে ছিল ভোগবিলাস ও অনৈতিক চরিত্র। আমরা যদি সাম্প্রতিক কালের মোঘল সভ্যতার পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে তাদের ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ ছিল চরম ভোগবিলাস ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়।  পৃথিবীতে আরো  অসংখ্য জাতির ধ্বংসের কারণ পার্যালোচনা করলে দেখা যাবে নৈতিক অধঃপতনের কারণেই তারা ধ্বংসের অতলগর্ভে তলিয়ে গেছে।

তাই আমাদের জাতিসত্তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বা আমাদের এই আধুনিক সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য আমাদের যুব সমাজের নৈতিকতার দিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
আজ আমাদের সমাজে শিক্ষিত জ্ঞানী-গুনীজন, মুক্তমনা বুদ্ধিজীবি সমাজে যারা আছেন তাদের মনটাকে আরও মুক্ত করে, চিন্তার জগৎকে আরও প্রসারিত করে, জ্ঞানের জগৎকে আরও সম্প্রসারিত করে একটু পূর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখলে বুঝতে বাকি থাকবে না যে জাতির যুব সমাজকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়াটা কতটা জরুরি।
আমরা যদি মনটাকে একটু উদার করে দেখি তাহলে দেখতে পাবো নৈতিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো ধর্মীয় শিক্ষা।  আর এই শিক্ষা সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীরা বিভিন্ন কথা বলেছেন।

জন মিল্টন বলেছেন­, "Education is the harmonies development of mind, body and soul."

হারম্যান হর্ন লিখেছেন, "শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে মুক্ত সচেতন মানবসত্তাকে সৃষ্টিকর্তার সাথে উন্নত যোগসূত্র রচনা করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া, যেমনটি প্রমাণিত রয়েছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধীয় পরিবেশে"।
বিশিষ্ট দার্শনিক সক্রেটিস শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, "নিজেকে জানার নামই শিক্ষা"।

আমেরিকান শিক্ষাবিদ জন ডেউয়ে বলেছেন, "প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ ও মৌলিক মেজাজ প্রবণতা বিন্যাস করার প্রক্রিয়াই শিক্ষা"।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবধর্ম’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, "মানুষের অভ্যন্তরীণ সত্তার পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই হচ্ছে শিক্ষা"।
কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেছেন, "মানুষের খুশির বা রূহের উন্নয়নই আসল শিক্ষা"।

তাই, যুব সমাজকে শিক্ষা দেওয়ার পূর্বে সেই শিক্ষার সাথে ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা আছে কি না? একটু পার্যালোচনা করে দেখাটা বড় জরুরী।
এছাড়াও  শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন

যেমন-
জন ডিউই বলেছেন, ‌"শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্মোপলদ্ধি"।
প্লেটোর মত হলো : "শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত"।
প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিসের মতে : "শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার"।

এরিস্টোটল বলেছেন : "শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা"।
শিক্ষাবিদ জন লকের মতে, "শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্বকরণ"।

বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বার্ট বলেছেন : "শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভাবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ ও তার নৈতিক চরিত্রের প্রকাশ।
কিন্ডার গার্টেন পদ্ধতির উদ্ভাবক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফ্রোয়েবেল এর মতে : "শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর, বিশ্বাসযোগ্য ও পবিত্র জীবনের উপলব্ধি"।

কমেনিয়াসের মতে : "শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা"।
পার্কার বলেছেন : "পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্ম প্রকাশের জন্যে যেসব গুণাবলি  নিয়ে শিক্ষার্থী এ পৃথিবীতে আগমন করেছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সেসব গুণাবলির যথাযথ বিকাশ সাধন"।

জীন জ্যাক রুশোর মতে : "সৎ অভ্যাস গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য"।
বার্ট্রান্ড রাসেল এর মন্তব্য হলো :
"…The education system we must aim at producing in the future is one which gives every boy and girl an opportunity for the best that exists".

স্যার পার্সিনান বলেছেন : "শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, চরিত্র গঠন, পরিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রস্তুতি এবং ভালো দেহ, ভালো মন গড়ে তোলা"।
ডা. হাসান জামান বলেছেন, "প্রত্যয় দীপ্ত মহৎ জীবন সাধনায় সঞ্জীবনী শক্তি সঞ্চার করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য"।
ড. খুরশীদ আহমেদের মতে : "স্বকীয় সংস্কৃতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সুনাগরিক তৈরি করা ………এবং জাতির ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন হওয়া উচিত শিক্ষার উদ্দেশ্য"।

আল্লামা ইকবালের মতে : "পূর্ণাঙ্গ মুসলিম তৈরি করাই হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য"।
আমরা উপর্যুক্ত বিষয়গুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করলে দেখতে পাবো বড় বড় সকল মনীষীরা নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। উনারা সকলে প্রায় বলতে চেয়েছেন নৈতিক শিক্ষা ছাড়া আসলে প্রকৃত মানুষ হওয়া বড়ই কঠিন। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া প্রকৃত মনুষত্ববোধ বিকশিত হয় না।

আজকের যুবকেরাই আগামী দিনের জাতির চালকের আসনে আসীন হবে । তাই যুব সমাজকে এখন থেকেই নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। যাতে তারা বড় হয়ে একটি আদর্শ, নৈতিকতা সম্পন্ন সমাজ ব্যবস্থা জাতিকে উপহার দিতে পারে। যেখানে থাকবেনা অসহনীয় পর্যায়ের ঘুষ বা দুর্নীতির সয়লাব।
 আর যুব সমাজের মাঝে এই নৈতিকতা শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে  রাষ্ট্রের পাশাপশি পরিবারকে ও  সর্বোপরি সমাজের সকল প্রকার সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসার প্রয়োজন। আসুন, আমরা আমাদের সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্ধকার, অন্যায়-অবিচার দূর করে একটি নৈতিকতা সম্পন্ন সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি।

মো: আশরাফুল ইসলাম
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পঠিত : ৫৬৭০ বার

মন্তব্য: ০