Alapon

"তোমাদের মুসলিম মেয়েরা"

একটা ঘটনা মনে পরে গেল। আমাদের জাতির জিল্লতির ঘটনা। যে সময়ের কথা বলছি, তখন বিমান বন্দর ট্রেন স্টেশন থেকে প্রতিদিন ট্রেন ধরে কমলাপুর এসে নটরডেমে ক্লাস ধরতে হত। আমার সাথে আমার এক উপজাতী বন্ধুও আসত। একদিন কথায় কথায় বললাম আচ্ছা তোমাদের হিলট্রাক অঞ্চলগুলোতে তো অনেক উপজাতী আছে, তারা মুসলিম না, কিন্তু একটা উপজাতি আছে তারা পুরোপুরি মুসলিম, তাদের সম্পর্কে কিছু জানো ?

ও এটা মোটেই বিশ্বাস করতে চাইলো না। বলল অসম্ভব, এরকম হতেই পারে না। ও সম্ভবত জানত না যে, মৌলভিবাজারে পাঙন নামের উপজাতীটি পুরোটাই মুসলিম । আমি বললাম তোমাদের ভেতর থেকেও ত কেউ কেউ মুসলিম হয় । ও বলল, “কী সব ফালতু কথা বল। আমাদের ওখানে যদি কেউ মুসলিম হয়, তাহলে তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। আমি বললাম, মানে ? ও বলল, তাকে হত্যা করা হয় । আমি  খুব আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম দেখে ও কিছু কথা বলেছিলো যা আমি কোন দিন ভুলতে পারি
নি।

ও বলেছিলো,
“মুসলিম হবার তো কোন কারণই থাকতে পারে না। তোমরা মুসলিমরা আমাদের কী দিয়েছ ? ওখানে খ্রীষ্টান মিশনারীরা আমাদের নানান ধরণের সাহায্য সহযোগীতা
করে। যদি আমাদের সাথে তোমাদের যুদ্ধ হয় তাহলে স্বাধীন হবার ক্ষেত্রে ভারত এবং ওরাই আমাদের পূর্ণ সহযোগীতা করবে। মুসলিম হবার কোন কারণ আছে? তোমাদের চরিত্রই তো খারাপ। বাংলাদেশের অনেক নামী দামী হোটেলে আমার যাওয়া আসার সুযোগ হয়। সেখানে Prostitute কারা জানো? তোমাদের মুসলিম মেয়েরা। আমাদের পাহাড়ের মেয়েরা কখনও একাজ করে না ।”



ও কথা বলছিলো আর আমার বুকের ভেতর কে যেন শেল বিধিয়ে দিচ্ছিল। শেষের দিকের কথাগুলো আমাকে একেবারেই হকচকিয়ে দিল । আমি তো এভাবে কখনই চিন্তা
করিনি। গোটা জীবন ভেবে এসেছি যারা ওসব কাজ করে তারা সমাজের জঘন্য, নিকৃষ্ট জাহান্নামী শ্রেণীর মানুষ। এদের জন্য কেবল ঘৃণাই অবশিষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু কখনই ভাবিনি যে এরা আমাদেরই ভেতর থেকে কিছু “মুসলিম” মেয়ে। Prostitution গোটা দুনিয়া জুড়েই আছে, কিন্তু ওর মুখে “তোমাদের মুসলিম মেয়েরা” শব্দটা শুনে আমার সমগ্র সত্বার ভেতর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল ।

আমার মুখ দিয়ে আর কিছু বেরুলো না। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম কিন্তু চোখের ভেতর ভেষে উঠল আড়াইশ বছর আগের কিছু চিত্রপট । মুসলিম মেয়েদের এই পরিণতি আজকের নতুন কোন বিষয় নয় । আমাদের মহান (?) পূর্ব পুরুষ, পলাশির খল নায়ক মীর জাফর দুটো বিয়ে করেছিলেন।(বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু সোজা বাংলায় বলতে চাই।) দু’জন বেশ্যার নৃত্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাদের বিয়ে করেছিলেন। এরাও মুসলিম ছিল ।

আপনি বলবেন, এটা তো খুব সাধারণ কথা। মীর জাফর শয়তান ছিলো, সুতরাং শয়তান শয়তানের কাজই করেছে –এটা তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার । আসলে বিষয়টা খুব স্বাভাবিক ছিলো না। মনে রাখতে হবে সে সময় বা তার অব্যবহিত পূর্বে মুসলমানরাই ছিল এই অঞ্চলের শাসক। তাহলে বেশ্যারা জন্মালো কোত্থেকে । এটাও আমাদের মহান (?)পূর্ব পুরুষদেরই কীর্তি। মুসলমানদের পতনের দিনগুলিতে হেরেমের দুর্দিনে হেরেম বেশ্যারা কোথায় যাবে?



এই প্রশ্নের ভেতর অনেক কিছুর জবাব মিলতে পারে ।
মুসলমানদের পতন পরবর্তি যুগে এবং কলকাতার উত্থান যুগের কিছু চিত্র তুলে ধরলে বিষয়টা ক্লিয়ার হবে । এখানে মনে রাখা দরকার ১৭৫৭ সালে পলাশির পতন মানেই কলকাতার পূর্ণ উত্থান নয় । সেকালে কলকাতার পুরোটাই ছিলো একটা বেশ্যাপাড়া । উনবিংশ শতাব্দির প্রারম্ভে ১৮০৬ সালে কলকাতা শহরের এক আদমশুমারিতে দেখা যায় কলকাতা শহরের ৪৪ টি প্রধার রাস্তার ৭৬৩৩ টি বাসগৃহের ৫৫৬ খানা ঘরের মালিকানা ছিল বেশ্যাদের । আশ্চর্যজনক ভাবে ঐ সময় বেশ্যা এবং এর প্রতিপালকদের কোন অভাব হয়নি । বেশ্যা পালন ছিলো গর্বের বিষয় এবং অভিজাত লোকেদের ব্যাপার স্যাপার । এমনকি রবি ঠাকুরের পূর্বপুরুষেরাও বেশ্যা ব্যবসায় জড়িত ছিলেন । ঐ একই আদম শুমারিতে থেকে জানা যায়ঃ “A brothel in 235 and 236 Bow Bazar St. owned by a member of Dwarkanath Tagor’s family. It had 43 rooms for prostitutes and its rental value was Rs. 140/-” (Calcutta: Myths and History, S N Mukherjee, page-101)

কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ রায় বাহাদুরের (1820) “মোকাম কলিকাতা সরকার” হিসাবের খাতায় বৌবাজারের জমির কথা উল্লেখ রয়েছে । সেই জমির ভারাটে কারা ছিলেন ? “...the tenants were from a different community consisting of Anglo-Indians, Jews, Armenians and Baijis (nautch girls, generally Muslim) of Mixed and uncertain birth who settled here from Lucknow and other places in upper India. ...” (page-94)

যা হোক, কলকাতা সে যুগে কিভাবে বেশ্যা-সর্বস্ব শহরে রূপান্তরিত হয়েছিল -তা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয় । আমার আগ্রহ ঐ ইংলিশ কোটেশনের ব্রাকেট দেয়া “nautch girls, generally Muslim” এবং “1820” অংশে । এটা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ব্যাপারটা ঠিক একবিংশ শতাব্দীর ব্যাপার নয়, এবং এর প্রবলতম সূচনার ইতিহাস ভিন্ন কথাই বলে ।

আমাদের “মুসলিম মেয়েদের” অধঃপতনের ইতিহাস কত পুরানা ! আসলে এটা গোটা জাতীর অধঃপতনের ইতিহাস । আমার ধারণা ইতিহাসের প্রকৃত পাঠ মীর জাফরদেরই শুধু দোষী সাব্যস্ত করে না, সিরাজুদ্দৌলাদের মত অন্যান্য শাসকদেরও দোষী সাব্যস্ত করে। সিরাজুদ্দৌলারা আসলে ট্রাজিক হিরো । কিন্তু প্রকৃত ভিলেন সিরাজুদ্দৌলার মত শাসকেরাই । যারা রাজ্যে বেলেল্লাপনা রুখতে পারে না, তারা রাজ্য রুখবে কি করে ? আমি জানি না আমার আগে কেউ সিরাজুদ্দৌলাকে “ভিলেন” বলেছেন কিনা । রাজমহলে দাসী-বাদী স্টাইলের বেশ্যার যারা বাজার বইয়ে দেয় তারাই কি প্রকৃত ভিলেন নয় ? হেরেমে, হারামে, আরামে আরামে কত যে আরাম ! এসব দেখে যদি কোন “মীর জাফরের” মনে ক্ষমতার আশঙ্কা জাগে, তাতে মূল দোষটা ওদের উপর বর্তায় না ।



একটা হাদীস পড়েছিলাম, বাবা মায়ের অপরাধের শাস্তি বংশধরেরাও ভোগ করে।(unquote) আমরাও আমাদের পূর্ব পুরুষদের ঘানি টানছি। আজকে নিষ্পাপ যাদের ফাঁসির রায় হচ্ছে,  তদের দায় আমাদের পূর্ব পুরুষদের উপর বর্তায় না? তাদের চরিত্রহীনতা কী এর জন্য দায়ী নয়? সাতান্ন গেল, দু’শ বছরের বৃটিশ  গেল, সাতচল্লিশ গেল, একাত্তার গেল। আমরা কি আমাদের চরিত্র পরিবর্তন করেছি? করিনি। ফলাফলঃ “মুসলিম বেশ্যা নারী” শব্দগুলো এখনো বেঁচে আছে ।

মনে পড়ে জনাব আমিনুল ইসলাম সাহেবের কয়েকটা কথা,
"'তোমাদের সমস্ত গুনাহর কাফফারা মৃত্যুর দোর-গোড়ায় এসেও আমাদের দিতে হবে, সে আমরা জানি। তোমরা ধ্বংস করবে আমরা গড়ব। তোমরা বিদেশীদের দালালি করবে আর দালাল হিসেবে চিহ্নিত হব আমরা। যুগে যুগে ইসলামের সৈনিকরা সমগ্র জাতির ভুলের মাশুল দিয়েছে তাদের জীবন দিয়ে।"
 
এখনও দিচ্ছে । পাহাড়ের নও মুসলিম ভাইয়েরা দিচ্ছে । “মুসলিম বেশ্যা নারীরা” দিচ্ছে ।

আমরা কি শোধরাবো না ??

পঠিত : ৬৪৫ বার

মন্তব্য: ০