Alapon

আমাদের দেশের মাসজিদ আর বাহিরের দেশের মাসজিদ! কত্তো পার্থক্য!...


বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য ছিলাম।
.
বাসার সামনে প্রতি রোববার গাড়ি আসত। “আলো আমার আলো, আলোয় ভুবন গড়া” গান শুনলেই দিতাম ছুট। তখন মোবাইল ফোন ছিল না, ফেসবুক ছিল না, ইউটিউব ছিলনা। বই-ই ছিল সবচাইতে বড় বিনোদন।
.
বই বাছাই করতেই অনেক সময় লেগে যেত। যেমন তেমন বই হলে চলবেনা। এমন বই যে বইয়ে টান আছে। যে বই আমাকে নাওয়া খাওয়া ভুলিয়ে দিবে। বাস্তবতা ভুলিয়ে দিয়ে গল্পের রাজ্যে আমাকে টেনে নিয়ে যাবে। যে বই পড়তে কষ্ট করতে হয় না। বই আপনাতেই টান দিয়ে নিয়ে যায়।
.
আবার বই সাইজে ছোট হলেও চলবে না। হতে হবে অনেক বড়। এক সপ্তাহ পরে আবার গাড়ি আসবে। দুদিনে বই শেষ করে ফেললে, বাকি দিনগুলো কাটবে কি করে!
.
ছুটির সময় বাড়ি যেতাম। সাথে থাকতো, কেন্দ্রের গাড়িতে থাকা সবচাইতে মোটা বই। কখনও জেমস হেডলি চেজ, কখনও তলস্তয়, কখনও দস্তভয়স্কি আবার কখনও প্রথম আলো কিংবা পার্থিব।
.
আম্মা বই হাতে দেখলেই বকা দিতেন “এত মোটা বই পড়ে কি হবে? এর চাইতে ক্বুরআন শরীফ পড়লেতো কিছু সওয়াব হত”

আম্মার কথা শুনে বিরক্ত হতাম। মনে হত “কী, সারাক্ষন ঘ্যান ঘ্যান করে! সব সময় কি ক্বুরান পড়তে ইচ্ছে হয়? নাকি ভাল লাগে!”
.
অবাক কান্ড! এখন কেন জানি ঢাউস কোন উপন্যাস ধরতেই ইচ্ছে করেনা। মনে হয় পড়ে কি হবে। “গিয়েছি, খেয়েছি, হাত ধরেছি…”তারপরে বই শেষ। এই বই পড়ে কি লাভ? জানার খাতায় কতটুকুই বা যোগ হবে!
.
এখন বরংচ অন্য উপন্যাস পড়তেই আনন্দ পাই। জীবনোপন্যাস।
.
আলহামদুলিল্লাহ! নতুন কোন জায়গায় গেলে কষ্ট হয় না। যাকে সামনে পাই, তার সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলি। সুযোগ পেলেই জানতে চাই, তার জীবন কাহিনী। তার ভাল লাগা মন্দ লাগা।

মনে হয় একেকটা মানুষ, একেকটা উপন্যাস। কত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, কত টানাপোড়ন! কত ফিরে ফিরে আসা।
.
প্রেম, বিরহ, ট্রাজেডি, কমেডি কিংবা হ্যাপি এন্ডিং…জীবনের গল্প… উপন্যাসের চাইতে কম কিসে!

..

২.

ছোট একটা বই লেখার সুত্র ধরে প্রকাশনা অফিসে বেশ কয়েকবার গেলাম। অনেক নতুন নতুন মানুষের সাথে দেখা হল। চমৎকার সব অভিজ্ঞতা হল।
.
এক নবীন লেখক প্রায় মাসখানেক ধরে এডিটিং এর কাজ করছেন। সে ভাই এক সময় ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে গিয়েছিলেন। দ্বিধা দ্বন্দ্ব সন্দেহ সংশয়…এই অবস্থায় কেটেছে বহুদিন। তারপর আল্লাহ্র রহমতে আবার ফিরে এসেছেন আলোর পথে।
.
বই মেলা সামনে। প্রকাশনা অফিসে নানামুখি ব্যস্ততা। এর মাঝে আমরা দুজন আলাদা করে বসলাম। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, তার জীবন কাহিনী।
.
টানা প্রায় দুদিন, কম করে হলেও ৩-৪ ঘন্টা আমরা কথা বলেছিলাম। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তার জীবন। তিনি বলছিলেন ধর্ম থেকে দূরে সরে আসার কথা। 
.
বললেন “ছোট বেলায় মক্তবে গিয়েছিলাম তিনদিন। তিনদিনই মাইর খেয়ে বাড়ি ফিরতে হল। আমার কোন দোষ ছিল না। পাশের জন দুষ্টামি করছিল, হুজুর গনহারে মাইর দেয়া শুরু করলেন। আমি যতই বলি, আমি কিছু করিনি, কে শুনে কার কথা। এভাবে টানা তিন দিন তুচ্ছ কারনে মাইর হজম করতে হয়েছিল। রাগ করে মক্তব ছেড়েছিলাম। আর কখনও ওদিকে পা বাড়াইনি।

যেখান থেকে আমার ধর্মীয় জ্ঞানের হাতেখড়ি হতে পারত, সেখান থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি ফিরেছিলাম। যদি মক্তবে সঠিক শিক্ষা আর আন্তরিক পরিবেশ পেতাম, হয়তো আমার সংশয়বাদী জীবনে যেতে হত না”
.
নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা ছোটবেলায় মক্তবে যেতাম। এলাকায় আমাদের পরিবারের বিশেষ সুনাম ছিল। তাই মক্তবে মাইর খেতে হয় নি। কিন্ত অন্য ছেলেমেয়েদের মাঝে মাঝে গনহারে পেটানো হত।
.
জুমার নামাজের সময় বেত হাতে একজন দাঁড়িয়ে থাকতেন পেছনে। বাচ্চারা কথা বললে, একটু হইচই করলে সপাং সপাং বেত পড়ত পিঠে। মাঝে মাঝে হাসত একজন, পিঠ দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হত আরেকজনকে।
..

৩.
মাগরীব নামাজে দাঁড়িয়েছিলাম, শেষ রাকাত পাইনি।

ইমামের সালাম শেষে আমি দাঁড়িয়ে শেষ রাকাত পড়ছিলাম। কানে এল ‘ঠাস’ ‘ঠাস’ করে কেউ একজন বাচ্চাদের পেটাচ্ছেন। বুঝতে পারলাম, নামাজের সময় হয়তো বাচ্চাদের কেউ কথা বলেছে কিংবা ছোটাছুটি করেছে। এখন তার শাস্তি পর্ব চলছে।
.
নামাজ শেষে পেছন ফিরে তাকালাম। কোন বাচ্চা নেই। ভয়ে হয়তো সবাই মাসজিদ ছেড়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
.
মাসজিদের আশেপাশে বস্তি এলাকা। বাচ্চাদের বেশিরভাগই গরীব। এই বাচ্চারা নামাজে না এসে এই সময়ে খেলার মাঠে থাকতে পারত। টিভি সেটের সামনে বসে বলিউডের কোন আইটেম সং দেখতে পারত। পারত এমন কোন আড্ডায় যোগ দিতে, যেখানে আগামী দিনের নেশার ভুবনে আমন্ত্রন জানানো হয়।
.
এ যুগে মাসজিদমুখি মানুষ কত কম! তারপরেও বাচ্চাগুলো মাসজিদে আসছে। কিন্ত কি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে? পিঠের উপর ধুম ধাম কয়েকটা কিল? উদ্ধত মুখের এক পশলা গাল মন্দ? 
.
হয়ত তারা বুঝেও উঠতে পারছে না, কি অপরাধ তাদের? বাসায়, এখানে-সেখানে একই কাজ করলে কেউতো বকে না। কেউতো মারে না। তবে এখানে কেন? এ জায়গা কি এমন, একটু আওয়াজ করলেই মার খেতে হয়? তবে এমন জায়গায় না এলেইতো ভাল হয়!
.
বাচ্চাদের মনে হয়তো এমন কিছু খেলা করে। আমরা যারা বড়, আমরা বাচ্চাদের চেয়েও অবুঝ হয়ে যাই। আমরা ভাবিনা, আজ যে বাচ্চাদের আমরা মাসজিদ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছি, কে জানে কাল হয়তো সে ‘ঈমান’ থেকেই ছুটি নিয়ে নিবে। যে বাচ্চাদের আমরা সযত্নে গড়তে পারতাম, তাদেরকে কী অবলিলায় আমরা ফিরিয়ে দিচ্ছি।
.
বাচ্চারা কাঁদা মাটির মত। কাঁদা মাটি দিয়ে যেমন খুশি তেমন হাড়ি বানানো যায়, খেলনা বানানো যায়। আমরা সেই কাঁদা মাটি অযত্নে অবহেলায় ফেলে রাখি। যখন সে কাদা মাটি রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে শক্ত হয়ে যায়, আমরা নেমে পড়ি তাকে ভাংতে। যাতে মনের মত পাত্র বানানো যায়।

বড়দের মন পরিবর্তনে আমাদের কত চেষ্টা, কত সাধনা! একটু সচেতন হয়ে, একটু ভালবেসে তার খানিকটাও যদি বাচ্চাদের পেছনে লাগাতাম। কাঁদা মাটি ঠনঠনে ইট হয়ে যাবার আগেই।
.
আহা! মাসজিদে আসা বাচ্চাদের কেউ যদি আদর করত! কেউ যদি আদর করে ওদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, বুঝিয়ে বলত।

বলত “এই নাও চকলেট। তোমরা রোজ মাসজিদে আসবে। মাসজিদে আসলে চকলেট পাবে। এখানে খুব জোরে কথা বলতে হয় না। সবার অসুবিধা হয়। কথা না বলে, দুষ্টামি না করে যে থাকতে পারবে তাকে অনেক চকলেট দেয়া হবে, আইসক্রিম দেয়া হবে। আর যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, তার জন্য থাকবে বিশেষ পুরুষ্কার”
.
বসে বসে কল্পনা করি। কিন্ত নিজে এমন কিছু করতে সাহস হয় না। যদি “পাছে লোকে কিছু বলে”
..

৪. 
আপা দুলাভাই গতবার হজ্বে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বলছিলেন, সৌদি আরবের গল্প। 
.
আপা বললেন “কিছু জিনিস খুব ভাল লেগেছে। বৃহস্পতিবারে মায়েরা কোলের বাচ্চা নিয়ে মাসজিদে চলে আসেন। দুদিন মাসজিদেই থাকেন। বাচ্চারা ইচ্ছেমত খেলাধুলা করে, ছোটাছুটি করে।

নামাজ শেষে বড়দের সাথে বসে ক্বুরআন পড়ে। হাদিস পড়ে। আবার ক্লান্ত হয়ে মাসজিদেই ঘুমায়। জুমার দিন যেন সাপ্তাহিক ঈদ, সাপ্তাহিক মিলনমেলা। এই দিনটার অপেক্ষায় থাকে ছেলে বুড়ো শিশু বৃদ্ধ...সবাই”
.
আর এখানে? জুমার নামাজে কোন কোন বাবা বাচ্চাকে সাথে নিয়ে আসেন। নতুন পরিবেশে বাচ্চাটা হয়তো কাঁদে, বকবক করে।

নামাজ শেষ না হতেই সবাই সেই বাচ্চার বাবার উপর হামলে পড়েন “বাচ্চাটারে আনলেন ক্যান? ঢং দেখান? ওর কি নামাজ ফরজ হইছে? খামাখা ওর কারনে আমাদেরে এত্তগুলো মানুষের নামাজ নষ্ট হইল। বাচ্চা নিয়ে এত আদিখ্যেতা না দেখালেই পারেন!”
.
নিজের ছেলেটাকে নিয়ে আমি নিজেও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। ইচ্ছে হচ্ছিল, বলি “ভাই, আপনি কি জানেন, মাসজিদে নামাজের মধ্যে হাসান হোসেন রাসুলে্র গায়ে উঠত, খেলা করত?

এটা কি জানেন, নারীরা বাচ্চা নিয়ে মাসজিদে আসত? ছোট বাচ্চা কান্না করছিল বলে, রসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ সংক্ষিপ্ত করেছিলেন। বাচ্চা নিয়ে মাসজিদে আসার কারনে বাচ্চার মাকে তিরস্কার করেন নি । অথচ মাসজিদে আসা নারীদের জন্য ফরজ নয়।“
.
বলতে পারিনি। জানি, বলে কোন লাভ হবে না। মিম্বার থেকেই যখন বাচ্চাদের সাথে না আনতে বলা হয়, যখন তিরষ্কার করা হয়, তখন সাধারন মুসল্লিকে বলে কি লাভ?
.
আপার কথা শুনতে শুনতে আমার চোখ স্বপ্নাতুর হয়ে উঠে। কল্পনায় দেখতে পাই তেমনই একটা পরিবেশ, তেমনই একটা মাসজিদ। যেখানে বাচ্চাদের কেউ বকা দেয় না। মহিলারা অসংকোচে মাসজিদে আসে। পর্দার মধ্যে থেকে দ্বীনের কথা শুনে, জানার জন্য প্রশ্ন করে।
.
আহা! এমন একটা মাসজিদের খুব করে যে স্বপ্ন দেখি! এমন একটা সমাজ কল্পনা করি।

সে স্বপ্ন কি কখনও পুরন হবে?


পঠিত : ১১৯৯ বার

মন্তব্য: ০