Alapon

প্রয়োজন সামাজিক জাগরণ

সর্বশেষ আদম শুমারি অনুযায়ী এ দেশের ৪৯ ভাগ নারী। এদেশের উন্নতিতে নারীদের রয়েছে বিশেষ অবদান। নারীদের অবজ্ঞা করে কখনো জাতীয় উন্নতি সম্ভব নয়। নারীদের বিভিন্ন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হয়, যেতে হয় কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু, নারীরা আজ ঘরে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে সকল জায়গায় অনিরাপদ। চারদিকে আজ নারীদের ওপর চলছে সমষ্টিগত নির্যাতন। নারীরা আজ যেমন তার স্বামীর কাছে নিরাপদ নয়, তেমন করে নিরাপদ নয় তার কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী ও বসদের কাছে। রাস্তাঘাটে বখাটের দ্বারা নারীদের ইভটিজিংসহ নানা অঙ্গভঙ্গি মামুলি ব্যাপার মাত্র।

নারী যেন আজ পুরুষের কাছে শুধু নির্যাতন আর ভোগের বস্তু। নারীরা যে পুরুষের মতো মানুষ তা আজ আমরা অবলীলায় ভুলে গেছি। ‘চাচার হাতে ভাতিজি ধর্ষিত’, ‘রাতের আঁধারে ধর্ষিত হয়ে বখাটেদের হাতে অমুক নারী খুন’, ‘যৌতুকের জন্য গৃহবধূ নির্যাতিত’ এসব খবর আজ যেন প্রতিদিনের পত্রিকার জন্য নির্ধারিত। সারাদেশে আজ নারীদের নিরাপত্তাহীনতার একই চিত্র। এসব চিত্র আজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নারীদের জীবন আজ কতটা দুর্বিষহ! নারীরা আজ কতটুকু অনিরাপদ! নারীদের ওপর এসব নির্যাতন প্রমাণ করে আমরা আজ সামাজিক পচনের একদম দ্বারপ্রান্তে।

সম্প্রতি অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এর এক গবেষণায় দেখা যায়, শহরে চলাচলকারী ৪৭.৫ ভাগ নারী গণপরিবহন, রাস্তা কিংবা উন্মুক্ত জনবহুল এলাকায় চলাফেরা করতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। শহরের ৯৭ ভাগ নারী যৌন হয়রানিকে সহিংসতা মনে করেন। এ ধরনের হয়রানির শিকার ৮১ ভাগ নারী পুলিশের সহায়তা নিতে ভয় পান। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৮৮ ভাগ নারী বলেন, তারা পথচারী, পুরুষযাত্রী এবং ক্রেতাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন।

অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে বাংলাদেশের মানবাধিকার ২০১৬ ও আসেকের পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয় যে, ২০১৬ সালে নারী উত্ত্যক্ত, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, হত্যা ও সালিশের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা পূর্বের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ৭২৪ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর ৩৭ জনকে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করে ৮ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৩৯ জন নারী। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৯৪ জন। অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১৬ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও বখাটের উত্ত্যক্তকরণের শিকার হন ২৪৪ জন নারী।

আরেকটি সংস্থার তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩১ হাজার ৬৬৯টি। এর মধ্যে ২০১০ সালে নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৫,৫৭০টি, ২০১১ সালে ৫,৬১৬টি, ২০১২ সালে ৫,৬৬১টি, ২০১৩ সালে ৪,৭৭৭টি, ২০১৪ সালে ৪,৬৫৪টি ও ২০১৫ সালে ৪,৪৩৬টি।

সূত্রমতে, ২০১০ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৫৯৩টি, গণধর্ষণ হয় ১০৭টি এবং ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড হয় ৬৬টি। ২০১১ সালে ধর্ষণ হয় ৫৩৫টি, গণধর্ষণ ১৬৫টি ও ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড হয় ৯৬টি। ২০১২ সালে ধর্ষণ হয় ৫০৮টি, গণধর্ষণ হয় ১৫৭টি ও হত্যাকাণ্ড হয় ১০৬টি। ২০১৩ সালে ধর্ষণ হয় ৬৯৬টি, গণধর্ষণ হয় ১৮৫ ও ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড হয় ৯৪টি। ২০১৪ সালে ধর্ষণ হয় ৬৬৬টি, গণধর্ষণ হয় ১৭৪টি ও ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড হয় ৯৯টি। ২০১৫ সালে ধর্ষণ হয় ৮০৮টি, গণধর্ষণ হয় ১৯৯টি ও ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড হয় ৮৫টি। এছাড়া ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যাসিডের ঘটনা ঘটে ৩৯৯টি ও নারী অপহরণের ঘটনা ঘটে ১১৪১টি। অন্যদিকে নারী ও শিশু পাচার, পতিতালয়ে বিক্রি, যৌতুকের কারণে হত্যা, বাল্যবিবাহ ও পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ২৮৭৫টি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত চার মাসে দেশে প্রায় দেড় হাজার ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৫৮টি ধর্ষণ, ৫৫টি গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৫টি। ১৫৫৬টি নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে জানুয়ারিতে ঘটে ৫৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ৬২টি, মার্চে ৭১টি ও এপ্রিলে ৬৭টি।

চলতি বছরে ধর্ষণের বিচার না পেয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরে শিশুকন্যাসহ চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে এক বাবা আত্মহত্যা করার পর ধর্ষণের ব্যাপারে স্যোশাল মিডিয়ায় ঝড় শুরু হয়। এরপর বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেল এন্ড রেষ্টুরেন্টে ১১ ঘণ্টা অস্ত্রের মুখে রেখে জোর করে মদপান করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণীকে আপন জুয়েলার্সের বখাটে ছেলের ধর্ষণের ঘটনা যখন সবার সামনে আসে তখন নারীদের এই নিরাপত্তাহীনতার চিত্র দেখে আঁতকে উঠে সবাই। গত সপ্তাহে তোফান নামের বখাটের হাতে বগুড়ার এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর মা ও মেয়ের মাথা ন্যাড়া করার ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। এছাড়া প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললে দেখা যায় সারাদেশে হাজারো নারী নির্যাতনের ঘটনা।

এভাবে চলতে থাকলে এদেশের সামগ্রিক উন্নতি থমকে দাঁড়াবে। নারীরা হারিয়ে ফেলবে তাদের পথচলার গতি। এ থেকে উত্তরণ আজ সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীর ওপর নির্যাতন থামাতে প্রয়োজন নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের যথার্থ ব্যবহার (নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে বলা আছে, নারী নির্যাতনের ঘটনায় ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত ও ১২০ দিনের মধ্যে মামলার কাজ শেষ করতে হবে)।

এছাড়া নারী নির্যাতন বন্ধের জন্য প্রয়োজন সামাজিক জাগরণ। সামাজিক জাগরণ তখনই বাড়বে যখন নারী তার পরিবারে যথাযথ মর্যাদা আর সম্মান পাবে। এর বাইরে নারী নির্যাতন বন্ধের জন্য প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাদের সিম্পোজিয়াম, সেমিনার ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নারীর অধিকার আর সম্মানের কথা উঠে আসলে সকল নাগরিকের কাছে একটি সম্মিলিত ম্যাসেজ পৌঁছাবে।
নারীর প্রতি যখন সবাই শ্রদ্ধাশীল হবে তখন নারী হবে নিরাপদ। নারী নিরাপদ হলে দেশ চলবে উন্নতির মহাসড়কে।

   (সেরা ব্লগার প্রতিযোগিতা'১৮)
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/sub-editorial/2017/08/07/214442.html

পঠিত : ৮১৬ বার

মন্তব্য: ০