Alapon

নারীবাদ ও নারীর স্বাধীনতা।

তিনি উচ্চ শিক্ষিতা। একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব ভালো ফলাফল করে সে বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হয়েছেন। সবরকম ডিগ্রী যখন ব্যাগে ভরা হয়েছে, তখন তার বয়স ত্রিশ পার হয়েছে। প্রচণ্ড আত্মসম্মান নিয়ে চলেন। সে আত্মসম্মানের কারণেই হয়তো কখনো ঘর বাঁধা হয়ে উঠেনি। কারণ, নারীর সব আত্মসম্মান একজনের সামনেই চূর্ণ হয়। চূর্ণ হতে হয়। যে নারী চিন্তা করে সে তার স্বামীর সাথে অহম দেখিয়ে চলবে, সে কেবল নপুংসকের সাথেই ঘর করতে পারবে। হাঁ, মানুষ মাত্রই আমিত্বের জায়গাটা থাকবে। তবে সে আমিত্ব সবার সামনে লাগামছাড়া হলে হোক, সমস্যা নেই। কিন্তু স্বামীর সামনে একটু বেশি হলেই সব ভেঙ্গে যায়।
.
বাসায় উনাকে খুব বোঝানো হয়েছে। মা বুঝিয়েছে, বাবা বুঝিয়েছে। বোন বুঝিয়েছে। বুঝাতে বাদ থাকেনি পাশের বাড়ির খালাও। কিন্তু তার এক কথাই, “আমি এতো উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে! কোন পুরুষের অধীনে আমি থাকব? নো! নেভার!” 
বাবা-মা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। একসময় তার বয়স চল্লিশ পার হয়েছে। ঢাকায় বড় একটা বাড়িতে একাই থাকেন। সারাদিন ক্লাস, পড়াশুনা নিয়ে বেশ কেটে যায়। একদিন ডাক্তার দেখাবে বলে ছোট বোন তার বাড়িতে আসে। সাথে বাচ্চা একটা মেয়ে। এখনো ফিডার ছাড়তে পারেনি। 
.
বোন অসুস্থ থাকায় ছোট্ট মেয়েটাকে বেশিরভাগ সময় তাকেই দেখতে হয়। ফিডার খাওয়াতে হয়, কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। কাপড় নষ্ট করলে পাল্টে দিতে হয়। অনেকের কাছেই কাজগুলো বিরক্তিকর। তবে অবাক হয়ে তিনি লক্ষ করলেন, এসব করতে তার একটুও খারাপ লাগছে না। কোথা থেকে যেন অদ্ভুত মায়া কাজ করছে শিশুটার প্রতি। ক্লাসে গেলেও বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে। বাবুটা ঘুমিয়েছে তো? খেয়েছে তো? মেয়েটা বিছানায় ঘুমোতে পারে না। বুকের উপর রেখে ঘুম পাড়াতে হয়। চিন্তার ভীড়ে ক্লাস নেয়াতে বিঘ্ন ঘটে। এবার তিনি বিরক্ত হন। আজব তো! বোনের বাচ্চা, নিজের তো আর না। 
.
তবে বিরক্তিটা বেশি দিন উনার বাসায় থাকে না। বোন সুস্থ হয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যায়। উনি চাচ্ছিলেন, যাতে তারা আর কিছুদিন থেকে যায়। কিন্তু পরের বাসায় এতোদিন কে থাকে? হোক না আপন বোন! বোনের মেয়ে চলে যাবার পর হুট করে একদিন উনি ভার্সিটি থেকে রিটায়ার নিয়ে নিলেন। কোথাও কোন খোঁজ নেই। এক মহিলা খোঁজখবর নিতে বাসায় গেলেন। অনেক ডেকেও কোন সাড়া না পাওয়ায় দরজায় কান পেতে শুনলেন, কেউ একজন বাচ্চা-ভোলানো গান গাচ্ছে। ভেতরে যেয়ে যা দেখলেন, তাতে তার পুরো শরীর বরফের মতো হিম হয়ে গেলো- 
এলোমেলো চুলে অগোছালো বেশে সেই প্রফেসর এক পুতুলকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন। কখনো ফিডারে করে দুধ খাওয়াচ্ছেন। পাগলের মতো হাসছেন। অপ্রকৃতিস্থ সে প্রফেসরকে তারপর কোথায় নেয়া হয়েছিলো, তিনি আদৌ সুস্থ হয়েছিলেন কিনা তা জানা যায়নি।
.
কাছাকাছি এমন একটা গল্প শায়খ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহ স্যারের মুখ থেকে শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, “কেউ যখন তার স্বভাবজাত ফিতরাতকে মেরে ফেলতে চায়, সে ফিতরাত কিন্তু মরে যায় না। বরং বিকৃতরূপে প্রকাশ পায়।” উনার ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছিল। বহু আগে তিনি নিজের মাতৃত্বকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা মরে যায়নি। প্রকাশ পেয়েছে অন্যভাবে। বিকৃতরূপে।
.
মহিলা সমাজবিজ্ঞানী এন্নি মোয়ের-এর একটি বই আছে। নাম ‘Brainsex’। সেখানে তিনি নারী-পুরুষের মানসিক ও দৈহিক ভিন্নতা খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছিলেন, “একজন মহিলা যতোবেশি পুরুষের মতো হতে চাইবে, তাকে ততোবেশি নিজের সত্তাবিরোধী হতে হবে। নিজের স্বভাবজাত আচরণের বাইরে যেতে হবে।” আর স্রষ্টা যে ব্লুপ্রিন্ট আমাদের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন, তার বাইরে গিয়ে কেউ কখনো ভালো থাকতে পারেনি। থাকতে পারবেও না।
.
জীবনের কোন এক সময়ে তার মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হবে স্বাভাবিক জীবনের জন্য। নিজের চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বাচ্চাটার মুখে সবচেয়ে সুন্দর ‘মা’ ডাক শোনার জন্য। মন খারাপের রাতে কারো কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে কেঁদে শার্টের কলার ভিজিয়ে দেয়ার জন্য। আজ যারা আস্তবড় লালটিপ কপালে দিয়ে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সব নিয়ম ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলছেন, সংসার নামক বন্দীত্বের শেকল থেকে মুক্ত হবার কথা বলছেন, সেই প্রৌঢ়া নারীদের একটু একান্তে ডেকে জিজ্ঞেস করেই দেখুন না, তাদের সুন্দর সাজানো গোছানো সংসারের জন্য আফসোস হয় কিনা! কারো কোলে বাচ্চা দেখলে নিজের জন্য এমন একটা শিশু পেতে হাহাকার সৃষ্টি হয় কিনা! হয় তারা ক্লান্ত চেহারায় স্বীকার করে নিবে নিজের পরাজয়ের কথা। আর অস্বীকার করলেও তাদের মিথ্যা বলাটা কারো চোখ এড়াবে না। তসলিমা নাসরীনের মতো নারীবাদী(!) মহিলাও সাবেক প্রেমিক রুদ্রের জন্য মাঝে মধ্যে মন খারাপ করা কথা লিখে। প্রেমিককে লেখা চিঠির স্মৃতিচারণ করে-
“আমাকে সকাল বলে ডাকতে তুমি।
কতোকাল ঐ ডাক শুনি না। তুমি কি আকাশ থেকে 
সকাল, আমার সকাল বলে মাঝে মধ্যে ডাকো? 
নাকি আমি ভুল শুনি?” 
.
শাব্দিকভাবে ‘ফেমিনিস্ট’ মানে বোঝানো উচিত তাদেরকে, যারা তাদের নারীসত্তাটাকে সবসময় আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবে। একজন সত্যিকারের নারী হিসেবে বাঁচতে চাইবে। তবে বাস্তবতা একেবারেই উল্টো। আজ তাদের নারীবাদী বলা হয় যারা আসলে নারীত্বটাই বিসর্জন দিতে বলে। যে নারী আজ ঘর সংসারের মায়া ত্যাগ করে বাইরে বেশি বেশি সময় ব্যয় করতে পারে, জানোয়ারূপী পুরুষদের সামনে সাহসী পদক্ষেপে অদেখাকে দেখিয়ে দিতে পারে, পোশাক কিংবা কথা-বার্তায় বা চালচলনে পুরুষদের সাথে পাল্লা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে, তারাই আজ তাদের চোখে নারীবাদী। তারা দাঁড় করিয়েছে নারী-পুরুষের সমতার এক মিথ্যা মূর্তি, যার ধর্মীয়, সামাজিক এমনকি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। মহিলা সমাজবিজ্ঞানী এলিস রসি তাই বলেছেন, “নারী-পুরুষ ভিন্নতাটা বায়োলজিকাল। অন্যদিকে, সমতার যে বুলি ছড়ানো হয়, সেটা পুরোটাই পলিটিকাল।”
.
তাই সত্যিকারের নারীবাদী হতে চাইলে স্রষ্টা আপনাকে যে নারীত্বের সংজ্ঞা দিয়েছেন তাকে আঁকড়ে ধরুন। আসমান ও জমীনের রব আল্লাহ্ তা’আলার চেয়ে আপনাকে আর কে বেশি ভালো চেনে? তিনি কুরআনে প্রথম আপনাদের কী হিসেবে উল্লেখ করেছেন জানেন? কোন কর্মী হিসেবে না। সাহসী চেতনার ধারক হিসেবেও না। বরং আদমের সঙ্গী হিসেবে (বাকারা ২:৩৫)। জান্নাতের মতো নিয়ামতে থেকেও আদম (আ) যাকে মিস করেছিলেন আপনি তারই বংশধর। 
.
একজন নারী হিসেবে তারপরেও মেনে নিতে না পারলে চোখ বন্ধ করে কিছু দৃশ্য কল্পনা করুন তো-
একটা মেয়ে এক গাঁদা ছেলের সামনে বসে বিড়ি ফুঁকছে। আরেকজন বাসভর্তি পুরুষের সাথে কাকঝোলা হয়ে অফিসে যাচ্ছে। সে পুরুষগুলোর হাত সুযোগ পেলেই বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করছে। অন্য একজন জিন্সের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে “প্রাণের উৎসবে” মেতে উঠছে। কেমন লাগছে দৃশ্যগুলো। স্বাভাবিক ঠেকছে? আনন্দে চোখ চকচক করছে? তাহলে আপনার জন্য দুঃসংবাদ। আপনি যে ফিতরাতকে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন, তা একদিন বিকৃত প্রেতাত্মা হয়ে আপনাকে মেরে ফেলবে। ফেলবেই ফেলবে। 
.
নারীর নারীত্ব প্রকাশ পায় যখন কোন এক শিশু তার কাঁধে মাথা দিয়ে নির্ভার হয়ে ঘুমিয়ে যায়। কিংবা কান্নার সময় যখন সে কোলে নিয়ে “বাবু আমার! কাঁদে না, কাঁদে না”- বলে একবার বাচ্চাটিকে ডানে তারপর বামে নিয়ে দোল খাওয়াতে থাকে। সদ্য স্কুলে যাওয়া ছেলেটা যখন লাফ দিয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপ দেয়। যখন শাসনের সুরে স্বামীর ব্যাগে সে টিফিন ক্যারিয়ার ঢুকিয়ে দেয়। বলে, “এগুলো না খেয়ে বাইরে খেলে আমি আর রান্না করব না, দেখে নিও।” যখন স্বামী মুগ্ধ হয়ে গোসল শেষে তাকে চুল আঁচড়াতে দেখে। সামান্য কারণেই যার গাল কখনো রাগে, কখনো বা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ভরা জোছনায় যার গুনগুন করা গানে পৃথিবীতে স্বর্গ নেমে আসে। যে শুধু নিজে স্বপ্ন দেখতে জানে না, পুরো পরিবারকে স্বপ্ন দেখাতে জানে। সে “কোয়ালিটি টাইম”- এর থিওরী দিয়ে নিজের সন্তানদের শৈশবকে ধ্বংস করে না। বরং নিজের পুরো জীবন জুড়েই কাছের মানুষদের কোয়ালিটি টাইম দেয়। আর তাই তার জীবনটাও সন্তানদের কাছ থেকে একটুখানি “কোয়ালিটি টাইম” পাওয়ার আক্ষেপে শেষ হয় না। বরং গভীর ভালোবাসার অশ্রুজলে সে সিক্ত হয়।
.
হাঁ, সবার জীবনের গল্প এক হয় না। কাউকে সংগ্রামের জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়। আবার কাউকে ভোগের পর কিছু জানোয়ার এ নিষ্ঠুর সমাজের মধ্যে ফেলে দেয়। তখন সে জিন্দিকের জীবন বেছে নেয়। বেছে নিতে বাধ্য হয়। যিনি সকল কাজের হিসেব নেন, তিনি অবশ্যই এ অবিচারেরও হিসাব নিবেন। কিন্তু যাদের প্রয়োজন নেই, তারা কেন পশুদের আহ্বানে নিজেদের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিচ্ছেন? নিজের জীবনের সেরা রত্নটি হারিয়ে কীসের পিছনে ছুটছেন? কী পাবেন আপনি? নিজের রবের কাছে না চেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করে কী অর্জন করতে চান? 
.
আন্দোলন করে অধিকার আদায় করা যায়। ভালোবাসা নয়।

পঠিত : ১২৫০ বার

মন্তব্য: ০