Alapon

শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতান

আমরা দুই শেরের সাথে খুব পরিচিত। একজন শেরে বাংলা অন্যজন শেরে মহীশূর। আজ শেরে মহীশূর নিয়েই আলোচনা। টিপু সুলতান ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসনকর্তা। তিনি যথারীতি একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেন। তিনি তাঁর শৌর্যবীর্যের কারণে শের-ই-মহীশূর নামে পরিচিত ছিলেন। 

টিপু সুলতানের প্রাসাদ, সোর্সঃ Bengaluru Online

শের-ই-মহীশূর 
টিপু সুলতান ১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর বর্তমান ব্যাঙ্গালোর থেকে ৩৩ কি.মি দূরে "দিভানাহালি " নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। টিপু সুলতানকে ডাকা হতো শের-ই-মহীশূর উপাধিটা ইংরেজদেরই দেয়া। বাবা হায়দার, ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে টিপু নামে এক ফকিরের দোয়ায় এক পুত্রসন্তান লাভ করেন। খুশি হয়ে হায়দার ঐ ফকিরের নামেই ছেলের নাম রাখেন "টিপু"। মুসলিমরা তাকে ইসলামপ্রিয় বীর যোদ্ধা মনে করেন আবার কেউবা অত্যাচারী স্বৈরশাসক বলে অভিহিত করেন। কেউ কেউ আবার টিপু সুলতানকে গাজী এবং পীর বলেও মনে করেন।

টিপুর বাঘপ্রীতি
দক্ষিণ ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসক ছিলেন টিপু সুলতান। পিতা হায়দার আলী মহীশূর রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন। শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রামে কাবেরী নদীর একটি দ্বীপে নির্মিত একটি দূর্গ থেকে রাজ্য শাসন করতেন। ছোটবেলা থেকেই টিপু বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। বাবাই তাঁকে বাঘের গল্প শোনাতেন। 


টিপু সুলতানের তলোয়ারের বাট। সেখানেও ছিল বাঘ। সোর্সঃ Navrang India

কিশোর বয়সে টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। টিপু সুলতানের রাজ্যের প্রতীক ছিলো বাঘ। এই বাঘ ছিলো তাঁর অনুপ্রেরণার মতো। তাঁর রাজ্যের পতাকায় কানাড়ী ভাষায় লেখা ছিলো "বাঘই ঈশ্বর"। তার বিখ্যাত উক্তি ছিল, “শিয়ালের মতো দু'শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু'দিন বেঁচে থাকাও ভালো” 


টিপুর বন্দুকের হাতলেও ছিল বাঘ, সোর্সঃ Atlas Obscura

তাঁল সমস্ত পরিধেয় পোষাক ছিলো হলুদ-কালো রঙে ছাপানো আর বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিলো ডোরা দাগ এবং হাতলে ছিলো খোদাই করা বাঘের মূর্তি। 


টিপু সুলতানের কামানেও ছিল বাঘ, সোর্সঃ Bangalore Tours 

তাঁর ব্যবহৃত রুমালও ছিলো বাঘের মতো ডোরাকাটা। তাঁর রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোষাকে থাকতো বাঘের ছবি। সৈন্যদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারেও আঁকা থাকতো বিভিন্ন আকারের বাঘের প্রতিরূপ কিংবা মূর্তি। এমনকি তিনি তাঁর রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে, বাড়ির মালিকদেরকে বাড়ির দেয়ালে বাঘের ছবি আঁকার নির্দেশ জারি করেছিলেন। তখনও তাঁর বাঘ পোষার বাতিক যায়নি এবং রাজবাড়িতে বেশ কয়েকটি পোষা বাঘ ছিলো। তার কয়েকটি আবার তাঁর ঘরের দরজার সামনে বাঁধা থাকতো।

দ্যা টিপু'স টাইগার
এটা ছিল একটি খেলনা। তিনি তার ইংরেজ বিদ্বেষ থেকে মজা করে এটি বানিয়েছেন। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তাঁর বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে টিপু ও তাঁর বাবা মারাত্মক নাজেহাল হন। এতে মহীশূরের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় অনেক সৈন্য। এমনিতেই তিনি প্রচন্ড ইংরেজ বিরোধী ছিলেন, তদুপরি এই পরাজয়ে তিনি আরো বেশি ইংরেজ বিরোধী ওঠেন। ঘটনাক্রমে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে হেক্টর মুনরোর একমাত্র পুত্র সুন্দরবনের সাগর দ্বীপে বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে টিপুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি এই ধারণা কাজে লাগিয়ে একটি বিচিত্র খেলনা বানিয়েছিলেন, যা সারা দুনিয়ায় "টিপু'স টাইগার" (Tipu's Tiger) নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।

বিখ্যাত টিপু'স টাইগার, সোর্সঃ The Telegraph 

এই খেলনায় দম দিয়ে ছেড়ে দিলে এর সাথে লাগনো একটি অর্গান পাইপ থেকে বাঘের প্রচণ্ড গর্জন আর এক ইংরেজের প্রচণ্ড গোঙানির আওয়াজ বের হতো। পুরো খেলনাটি ছিলো এরকম, একজন ইংরেজ একটি বাঘের থাবার মধ্যে অসহায়ভাবে পড়ে গোঙাচ্ছে আর একটা বাঘ প্রচন্ড আওয়াজ করে সেই ইংরেজের বুকের উপর চেপে গলা কামড়ে ধরতো। তখন ইংরেজটি তার হাত উঠিয়ে চেষ্টা করতো বাঘের মাথাটি এদিক-ওদিক সরিয়ে দিতে। ভিতরকার অর্গান থেকে আরো বেরিয়ে আসতো মহীশূর সুলতানের প্রিয় গজলের সুর। "টিপু'স টাইগার" বানানোর পিছনে একদিকে যেমন ছিলো তাঁর ইংরেজদের প্রতি উষ্মা, তেমনি অন্যদিকে ছিলো প্রচন্ড ব্যঘ্রপ্রীতি।

টিপু সুলতান শাহি মসজিদ 
এটি কলকাতার একটি বিখ্যাত মসজিদ। ১৮৪২ সালে টিপু সুলতানের কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মোহম্মদ এই মসজিদটি নির্মাণ করান। 


টিপু সুলতান শাহী মসজিদ, সোর্সঃ Beautiful Mosques Pictures 

এটি কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ। দেখার জন্য সকল ধর্মের মানুষের জন্য এই মসজিদের দ্বার উন্মুক্ত।  

সাহসী টিপু সুলতান
টিপু সুলতান একবার তার ফরাসি বন্ধুর সাথে সুন্দরবনে শিকারে যান, একটি বাঘের সামনে পড়েন এবং তার বন্দুক কাজ করছিল না। তখন তিনি একটি ছোট্ট ছোড়া দিয়েই বাঘের উপর ঝাপিয়ে পড়েন এবং বাঘটিকে হত্যা করেন। 


শিল্পীর কল্পনায় টিপুর বাঘের সাথে লড়াইয়ের ঘটনা

টিপু সুলতান পরবর্তী জীবনে তার নামের প্রমান রেখেছেন তার কাজের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন বাঘের মতো সাহসী, ক্ষিপ্র এবং তেজী। টিপু সুলতানের চেয়ে একাগ্রচিত্তে আর কেউ মহীশুর রাজ্যকে ব্রিটিশ মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেনি। তার ধ্যানে মনে জাগরণে সবসময় কাজ করতো কিভাবে ব্রিটিশ শাষন থেকে রাজ্যকে বাঁচাবে। 

টিপু সুলতান ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করেছেন তা ছিলো অত্যন্ত আধুনিক মানের এবং ব্যতিক্রমী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম রকেট লাঞ্চার প্রযুক্তি ব্যবহার করেন তিনি। সেই যুদ্ধের একটি চিত্র নাসার মেরিল্যান্ড অফিসে সংরক্ষিত আছে।


টিপু সুলতান সর্বপ্রথম যুদ্ধে রকেট লাঞ্চারের ব্যবহার করেন। সোর্সঃ Dawn

ইংরেজরা টিপুকে কেমন ভয় করে চলতো তার প্রমান মেলে রিচার্ড ওয়েলেসলির কথায়। রিচার্ড ওয়েলেসলি ছিলেন ভারতে ক্রমসম্প্রসারণশীল বৃটিশ সাম্রাজ্যের পরিচালক। ১৭৯৯ সালের ৪ মে ‘মহীশূরের বাঘ’ টিপু সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেয়ে তিনি বলেন “গোটা ভারতবর্ষই এখন আমাদের”। এ কথা শুনেই বোঝা যায়, ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর একটি ছিলেন টিপু সুলতান। ভারতের বেশিরভাগ অংশেই আজও তাকে সেভাবেই দেখা হয়।

১৭৮৬ সালে টিপু সুলতান ৭২ কামানের ২০ টি যুদ্ধ জাহাজ এবং ৬২ কামানের ২০টি রণতরী (frigates) দিয়ে তার নৌবাহীনিকে সুসজ্জিত করেন। ১৭৮৯ সালের ভেতরই টিপু সুলতানের প্রায় সকল জাহাজেই তামার পাটাতনে উন্নীত করা হয়। ১৭৯০ সালে তিনি কামালুদ্দিনকে তার "মীর বাহার" পদে নিযুক্ত করেন এবং জামালাবাদ এবং মাজিদাবাদে সুবিশাল ডকইয়ার্ড নির্মান করেন। 

শাহদাত
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন। টিপুর এক সেনাপতি মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান। ফলে টিপু পরাজিত ও নিহত হন। পরে তার পরিবারের মানুষজনকে ভেলোরের দূর্গে বন্দী করে রাখে ব্রিটিশ শাসকরা। 

টিপু সুলতানের পুরো জীবনটাই যুদ্ধ; যুদ্ধের মাঝে জন্ম, বেড়ে উঠা, যুদ্ধেই মৃত্যু। বাবা হায়দার আলীরও সারা জীবন কেটেছে যুদ্ধে।টিপু সুলতান যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ইংরেজদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন,দেশের স্বাধীনতা আগলে রেখেছেন। কিন্তু তিনি শাহাদাত বরণ করলে শুধু হিন্দুস্থানই নয়,গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন স্বাধীনতার এক অতন্দ্রপ্রহরী হারিয়ে অভিভাবক হারা অবস্থায় পড়ে যায়।

পঠিত : ২৩৫৬ বার

মন্তব্য: ০