চিন্তার সঙ্কীর্ণতা দূর করতে হবে
তারিখঃ ৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১১:১৬
স্বাধীনতার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে এসে অর্জন করেছে উন্নয়নশীল দেশের খেতাব।
রাষ্ট্রের উন্নয়নের পাশাপাশি এখন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল এবং স্মার্ট হলেও চিন্তার ক্ষেত্রে স্মার্ট হতে পারে নি দেশের জনগণ। সমাজে এখনও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছে গৃহবধূ। নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ, ধর্মের দোহাই দিয়ে সংখ্যালগুদের ওপর হামলা, মাদক ও দুর্নীতি, নদী দখল, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য দেওয়া, যত্রতত্র ময়লা ফেলা, ঝাড়ফুঁকের মত কুসংস্কার থেকে বেড়িয়ে আসতে পারি নি আমরা।
এসকল অসামাজিক কর্মকান্ড থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে প্রতিটা নাগরিকের মাঝে সচেতনতা ও চিন্তার বিপ্লব ঘটাতে হবে । চিন্তার বিপ্লব ছাড়া অসামাজিকতা ও হিংস্রতা থেকে মুক্তি আসবে না। সম্প্রীতি ও মানবিক রাষ্ট্র গড়তে চাইলে প্রতিটা নাগরিকের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। চিন্তার সঙ্কীর্ণতা দূর করতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। চিন্তা নায়করাই ঘুণে ধরা সমাজটাকে বদলাতে পারে। আপনার- আমার, আমাদের সকলের নোংড়া মানসিকতার জায়গা থেকে সড়ে আসতে হবে। সাংস্কৃতি চর্চা বাড়াতে হবে। প্রতিটা অপরাধের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে।
দেশের কোথাও কোনো নারী নির্যাতন বা অন্যায়ের শিকার হলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। আজ হয়তো আপনার সামনে অন্যের মেয়ে, অন্যের বোন বা স্ত্রী অন্যায় বা নির্যানতের শিকার হচ্ছে, প্রতিবাদ করছেন না। কাল হয়তো অন্যের সামনে আমার- আপনার, মা, মেয়ে বা স্ত্রী কিংবা বোন নির্যাতন হলে সেও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। বরং এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সেলফোন বের করে নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও ধারণ করবে। কোথাও কোনো অন্যায় - অপ্রীতিকর ঘটনা দেখলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা কিংবা ভিডিও ধারণ করার মানসিতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদে সামিল হতে হবে।
আর আধুনিক যুগে এসেও যদি যৌতুকের জন্য গৃহবধূকে নির্যাতন করা হয়। তাহলে তো ধরে নিতে হবে আমরা পড়ালেখা করে নিজ মননকে আলোকিত করতে পারিনি। শিক্ষা গ্রহণ করেছি শুধু সার্টিফিকেট অর্জন করার জন্য। সুশিক্ষিত হওয়ার জন্য নয়। যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার বিষয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। আমি যৌতুক নিবো না, আমি যৌতুক দিবোও না। খেয়াল রাখবেন আপনার সংসারে অন্যের মেয়ে-বোন যতটুকু ভালো থাকবে। আপনার মেয়ে বা বোনও অন্যের সংসারে ততটুক ভালো থাকবে। কথায় আছে যেমন কর্ম তেমন ফল।
দিন দিন ধর্ষণের পাল্লা ভারী হচ্ছে। নারীকে ধর্ষণ, কিংবা ধর্ষণ করার পর হত্যা কোনটাই কাম্য নয়। ধর্ষিতাকে নিয়ে উপহাস না করে, নির্যাতিতা মেয়েটির পরিবারের পাশে সকলকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে সকলকে সোচ্চার হতে হবে। ধর্ষণকারীরা হচ্ছে এক প্রকার মানসিক বিকারগ্রস্ত। এদের থেকে আমাদের সমাজটাকে নিরাপদ রাখতে হলে
ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে সচেতন পুরুষদের জোড়ালো প্রতিবাদ করতে হবে। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে মানবিক মুল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। নারীকে পণ্য নয় মা, বোন ও মেয়ে হিসেবে ভাবতে হবে।
নারীর প্রতি মানসিক, শারিরীক যে কোন ধরণের সহিংসতা, যৌন হয়রানি দেখলেই প্রতিবাদের আওয়াজ তুলতে হবে।
ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ কিংবা জঙ্গিবাদ যে নামেই বলি না কেন। কোনো ধর্মই অন্যায় ভাবে মানুষ হত্যাকে উৎসাহিত করে না। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করলে ধর্মের ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি হয়। যে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা হয় সে ধর্মের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা জন্মায়। সে ধর্মকে ধর্ম নয় সন্ত্রাসবাদের হাতিয়ার বলেও প্রচার করা হয়।
মুষ্টিমেয় কিছু লোক নিজ স্বার্থে ধর্মকে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। মূলত এরা ধর্মকেও ভালোবাসে না। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকেও নয়। মানুষই যদি না থাকে তাহলে ধর্মের কথা শোনাবে কাকে। আসলে তাদের উদ্দ্যেশ ধর্মের উপকার করা নয়। দেশের তরুণ সমাজকে বিপদগ্রস্ত করা। দেশকে ধংসস্তুপে পরিনত করা। তারা চায় না আমাদের দেশের তরুণরা সম্প্রতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক। দেশকে ভালোবাসুক। দেশের মানুষকে ভালোবাসুক।
জঙ্গিবাদের মোকাবেলা কিংবা বিস্তার রোধে আমাদের তরুণদের সচেতন হতে হবে। জঙ্গি- সন্ত্রাস মুক্ত দেশ গড়ার লড়াইয়ে নিজেকে শামিল করতে হবে। আশপাশের বন্ধু-বান্ধবের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে যাতে কারো বন্ধু-বান্ধব জঙ্গিবাদের জালে জড়িয়ে না পড়ে। পাড়ার কিংবা মহল্লার ছোট ভাইদের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে নিজ পরিবারের ভাই-বোনদের বিষয়ে সচেতন হওয়া। তাদের কোন আচরণ সন্দেহ জনক মনে হলে খোলামেলা কথা বলে বিষয়টি সমাধান করা। বিয়ে-শাদীসহ প্রতিটা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে পরিবারের সকলকে নিয়ে অংশ গ্রহণ করা। সাংস্কৃতির চর্চা করা।
মাদক আর দুর্নীতি হচ্চে একটি সামাজিক ব্যাধি। একজন মাদকাসক্তই একটি পরিবারকে ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। অপরদিকে একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি সমাজটাকে আঙ্গুল বানিয়ে নিজে হয় কলা গাছ। অন্যায় ভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। ডিজিটাল যুগে এসেও এই ব্যাধি দূর হয়নি। এই ব্যধিকে এখনই রোধ করতে রাষ্ট্রকে সময় উপযুগি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সচেতন হতে হবে। দুর্নীতি ও মাদের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। দায়িত্ব নিয়ে নিজ- নিজ পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রকে মাদক ও দুর্নীতি মুক্ত রাখতে হবে। দুর্নীতিবাজ ও মাদক ব্যবসায়ীদের সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে। অমুক দুর্নীতিবাজ, তমুক দুর্নীতিবাজ বললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতি আর মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজটা জোড়ালো করতে হবে।
আমাদের আরো সচেতন ও চিন্তা করতে হবে। যাতে আমার দ্বারা খাদ্যে ভেজাল বা নকল পণ্য দেওয়া না হয়। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে পরিবেশ নোংড়া ও ক্ষতিগ্রস্ত করা না হয়। আপনি আজ খাদ্যে যে ভেজাল মিশ্রণ করছেন। ভেবে দেখেছেন কি সেই ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য খেয়ে আপনার বাবা-মা, স্ত্রী- সন্তান, ভাই-বোন কিংবা অন্যান্য আত্মীয় স্বজন রোগবালাই এর শিকার হচ্ছে কি না। ধরুণ আপনি ফরমালিন দিচ্ছেন মাছে। আপনি মাছ খান না। অপর একজন ফরমালিন দিচ্ছে শাক-সবজীতে। উনি শাক-সবজী খায় না। আপনি শাক-সবজী খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর উনি আপনার মাছ খেয়ে। এভাবে উভয়ে উভয়ের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। পুরো জাতিই এভাবে ফরমালিন খেয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছি। আসুন একটু চিন্তা করি পুরো জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মধ্য দিয়ে আপনি- আমি ও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় রয়ে যাচ্ছি কি না?
যত্রতত্র ময়লা ফেলে নদী ও পরিবেশ দূষণ করে আমরা আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছি। পরিবেশ দূরঘন্ধময় করে তুলছি। বেচে থাকার জন্য আবার নষ্ট পরিবেশের অক্সিজেন গ্রহণ করছি। কি অদ্ভুত অভ্যাস আমাদের। এগুলো থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে।
ভাবতে অভাগ লাগে তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগেও তাবীজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁকের মত কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারিনি আমরা। সমাজের একটি অংশ এখনো ঝাড়ফুঁককে অন্ধের মত বিশ্বাস করে। শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতদের একটি অংশের মাঝে এ কুসংস্কারটি আজও বিদ্যমান রয়েছে। এখনো দেখা গেছে কোনো পরিবারে কেউ অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে গিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে যাচ্ছে। ওষুধ না খায়িয়ে জাফরানের রং আর কাগজ মিশ্রিত পড়া পানি পান করান। এতে রোগ ভালো নয় রোগীর ওপর নিরবে অমানবিক নির্যাতন করা হয়।
আবার অনেককে দেখা গেছে শারীরিক কোনো সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ফার্মেসী থেকে ওষুধ সেবন করছে।
এটার কারণেও স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়তে পাড়ে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। ভাবতে হবে যাতে প্রযুক্তি আর তথ্য বিজ্ঞানের এ যুগে আমরা কুসংস্কার থেকে যোনো বেড়িয়ে আসতে পারি।
পরিশেষে এ কথা বলেতে চাই, চিন্তায় স্মার্ট বা চিন্তার জায়গায় আলোকিত করতে না পারতে সকল অগ্রযাত্রাই পিছিয়ে পড়বে।
মন্তব্য: ০