Alapon

হীরক রাজার দেশে জামায়াত-শিবির আতঙ্ক!


ইদানিং বাংলাদেশে সরকার বিরোধী কোন ঘটনা কিংবা দূর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথে কোন রকম তদন্ত ছাড়াই সরকারের মন্ত্রীরা অথবা সরকারি দল আ’লীগ ও তার শরীক দলের নেতাদের মুখে সর্বপ্রথম যে কথাটি আসে তা হল, ঘটনার সাথে “জামাত-শিবির জড়িত”। ঘটনা যাই হোক না কেন, জামায়াত-শিবিরের উপরে দোষ চাপিয়ে তারা কিসের ফায়দা নিতে চাচ্ছেন, তা হয়ত তারাই ভালো বলতে পারবেন। ১৬ কোটি জনতার বাংলাদেশে যে দলটির (জামায়াত-শিবিরের) সমর্থক সর্বোচ্চ হলে ৫%। অথচ দেশের সবচেয়ে শক্তিধর রাজনীতিক শক্তি আওয়ামীলীগ সেই জামায়াত-শিবির নিয়ে কেনযে এত আতঙ্কে থাকে তা চিন্তা করাও মুশকিল। রাজনীতিতে বিশেষত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সকল দোষ বিরোধীদের ঘাড়ে চাপানোর পুরানো অভ্যাস আছে। তাই বলে ক্ষমতার একক বিন্দুতে থাকা আওয়ামীলীগ কি কারণে দেশের প্রতিটি ইস্যুতে জামায়াত-শিবিরকে টেনে আনে তা আমার বোধগম্য নয়। যেখানে বিএনপির (মাঝে মাঝে তাদের উপরও যায়) মতো একটি দল অথবা আরও কত রাজনীতিক দল আছে। সেখানে তারা জামায়াত-শিবির বারবার বলতে বলতে জামায়াত-শিবির কোন শক্তির আসনে বসাচ্ছেন তাও ভাবার বিষয়। আসুন কয়েকটা ঘটনা পর্যালোচনা করি। 


ঘটনাক্রম-১ 
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর নির্মম ভাবে নিজ বাসায় খুন গাইবান্ধার সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। ঘটনার পরপরই আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন, ঘটনার দায়ভার চাপিয়ে দিলেন স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের ঘাঁড়ে। আর এই খবর প্রচার করার জন্য একশ্রেণীর দলকানা মিডিয়াতো আছেই। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় জামায়াত-শিবির নেতৃবৃন্দ কে নির্বাচারে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু ঘটনার মাস দেড়েক পর জানাগেল হত্যার সাথে জড়িত ঐ আসনের মহাজোট মনোনিত সাবেক সাংসদ জাতীয় পার্টির নেতা আব্দুল কাদের। মান থাকল তাদের কথার ?




ঘটনাক্রম-২ 
চট্টগ্রামের বহু অপকর্মের নায়ক মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজীম রনি। এই রনি গত ৩১ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ জাহেদ খাঁনকে চড়-থাপ্পর মারেন। রনির মতে জাহেদ খাঁনের অপরাধ সে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নিচ্ছে, এই সুযোগে একজন ছাত্রনেতা হাত তুললেন শিক্ষকের গায়ে! শিক্ষক যদি কোন অপরাধ করে থাকেন তার বিচার করবেন বিভাগীয় মন্ত্রলায় ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। কিন্তু তা না করে অস্ত্র মামলার আসামী রনি নিজেই বিচারক হয়ে গেলেন! 

আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য রনি এবার নিলেন সহজ কৌশল শিক্ষকের শরীরে লাগিয়ে দিলেন ট্যাগ সে “জামাত-শিবিরের” লোক! 

ঘটনাক্রম-৩ 
পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষন,নিপিড়ন এবং সকল প্রকার বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে এই দেশটা স্বাধীন করেছে আপামার মুক্তিকামী জনতা। দেশকে ভালোবেসে আত্মোৎসর্গ করেছেন অগণিত বীর বাঙ্গালী। শুধুমাত্র দেশের জন্য কত মা বোন কে সইতে হয়েছে নির্মম নির্যাতন। পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অজ¯্র মুক্তিযোদ্ধা। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুখে বিজয়ের হাসি নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন বাংলার দামাল সন্তানরা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সেই মুক্তিযোদ্ধারা সবচেয়ে বড় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। সেই সময় শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরী না করে তাদের প্রতি বড় বৈষম্য করা হয়। ফলশ্রুতিতে দেশের স্বাধীনতার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন দেশের আনাচে কানাচে শুধু মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধা। এসব নব্য মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে হারিয়ে গেছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা।


রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাটাগরি অনুযায়ী ২২টির মতো সুবিধা দিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। তবে আলোচিত সুবিধা হলো-“মুক্তিযোদ্ধা কোটা”। বিসিএস সহ বিভিন্ন চাকরীতে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ৩০% কোটার ব্যবস্থা করেছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও কোটার জন্য আজকাল অনেকই সাধারণ ব্যক্তি থেকে হয়ে উঠেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা!

দেশে শিক্ষিত বেকার সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ!। যারা দীর্ঘ শিক্ষা জীবন শেষে পাচ্ছেন না নূন্যতম সম্মানের একটি চাকরী। অথচ সেই দেশে বিভিন্ন কোটায় যোগ্য প্রার্থীর অভাবে কত চাকরীর পদ পূরণ করা যাচ্ছেনা। শিক্ষিত বেকারদের মনে পুঞ্জিভূত এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অনেক ছাত্র আত্মহত্যা করে পৃথিবীকে বিদায় বলেছে। আর যারা নিজেদের শেষ করতে পারেনি,তারা নেমে এসেছে রাজপথে। তারা কোটা পদ্ধতির সংস্কার চায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহ দেশে বিদ্যমান ৫৬ ভাগ কোটা সংস্কার করে ১০ ভাগে নিয়ে আসার জন্য দেশের শিক্ষিত তরুণেরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নামে।


এই শিক্ষিত তরুণদের সমর্থন দিয়ে দেশের টিভি চ্যানেলগুলো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা যৌক্তিক কথা বার্তা এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে তাদের লেখনি তরুণদের মনে আশার আলো দেখায়। আন্দোলন যখন তীব্রভাবে ছড়িয়ে সারাদেশে। তখন মঞ্চে হাজির “মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড” নামক একটি সংগঠন। তারা তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীতে কোটা বিরোধীদের জামায়াত-শিবিরের সমর্থক আখ্যা দিয়ে আন্দোলন ভিন্ন খাতে নেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। 




অবশেষে গত ৮ এপ্রিল সারাদেশে কোটা সংস্কারের লক্ষে গণপদযাত্রা কর্মসূচী ঘোষণা করে আন্দোলনকারীদের সংগঠন, “সাধারণ ছাত্র পরিষদ”। কেন্দ্রীয় ভাবে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কর্মসূচী পালন করার সিদ্ধান্ত হয়। নির্ধারিত সময়ে কর্মসূচী শুরু হয়। বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত হয় ঢাবির টিএসসি সহ আশেপাশের এলাকা। তারা মিছিল নিয়ে ঢাবি ক্যাম্পাস আন্দোলিত করে তুলে। তাদের সাথে একত্মতা প্রকাশ করে আশেপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরীপ্রার্থীরা। তারা পুলিশকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেও পুলিশ ফুল গ্রহণ থেকে নীরব থাকে। 



কিন্তু সন্ধার অন্ধকার নেমে আসার আগে হঠাৎ আন্দোলনকারীদের উপর অর্তকিত হামলা চালায় পুলিশ। পুলিশের হামলার মুখে প্রথমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে তারা পুনরায় একত্রিত হয়ে ইট পাটকেল ছুঁড়ে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। মধ্য রাত পর্যন্ত চলে পুলিশ-শিক্ষার্থী ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এক পর্যায়ে পুলিশ জলকামান সহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যখন ক্যাম্পাসের ভিতর যাওয়ার চেষ্টা করে, তখনই মঞ্চে হাজির বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে বহিরাগত কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে হামলা চালায় তারা। বাইরে পুলিশ ও ভিতরে ছাত্রলীগের হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে আন্দোলনকারীরা। এমনই অবস্থায় কিছু দুস্কৃতিকারী মারাত্মক হামলা চালায় ঢাবির ভিসির বাসভবনে। তছনছ করে দেয় সবকিছু। আতঙ্কে বাসভবন ছাড়তে বাধ্য হন ভিসির পরিবার। 



কিন্তু এই হামলাকারী কারা ? যথারীতি হামলার দায় জামায়াত-শিবিরের কাঁধে দিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন। অথচ ঢাবি ভিসি বললেন ‘যারা হামলা চালিয়েছে,তাদের ঢাবির ছাত্র মনে হয়নি”। বহিরাগতদের নিয়ে মিছিল করলো ছাত্রলীগ, আর সেই বহিরাগতরা ছিল জামায়াত-শিবির! 

এবার আসুন ঘটনার ময়নাতদন্ত করি!
ঘটনাক্রম ১,২ এবং ৩ মিলিয়ে দেখি। প্রথম ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর, দ্বিতীয়টি আবেগ ঘটিত বেদনায়ক এবং তৃতীয়টি বাঁচার তাগিদে অধিকার আদায়ের মঞ্চ বলে আখ্যায়িত করতে পারি। প্রত্যেকটি ঘটনা ধামাচাঁপা দেওয়ার জন্য পুরানো সূত্র বেছে নেই “যত দোষ নন্দ ঘোষের”। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের যেকোন প্রান্তে যেকোন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা খুঁজে বেড়ান। তাকে অনুসারণ করে আওয়ামী লীগ সহ মহাজোট নেতৃবৃন্দ একই সূত্রে চলার চেষ্টা করেন। আর পুলিশ সহ প্রশাসন তারা তো আরও উৎসাহী। কোন রকম তদন্ত ছাড়াই রাজনীতিবীদের মতো বক্তব্য দিয়ে আসামী খুঁজেন।


ফলাফল 
বিরোধী মত,দাবী সহ যেকোন আন্দোলন দমানের উত্তম কৌশল হিসাবে তারা গ্রহণ করেছে “জামায়াত-শিবির” ট্যাগ। যা একবার আন্দোলনকারী শরীরে লাগিয়ে দিতে পারলে আন্দোলন স্তিমিত। কারণ জামায়াত-শিবিরের শরীরে দেশ বিরোধী গন্ধ আছে। আর এই গন্ধ তারা গ্রহণ করেছে পারফিউম হিসাবে। 


ঘটনা ছোট আর বড় নাই। যেখানে লাগাবেন, সেখানে কাজ করবে। সেটা হউক রানা প্লাজা অথবা যৌক্তিক দাবী আদায়ের যেকোন মঞ্চ। ফলাফল দ্রুতই পাওয়া যায় এবং যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। 

সূত্রঃ
১.javascript:nicTemp();
২.javascript:nicTemp();
৩.javascript:nicTemp();
৪.javascript:nicTemp();
৫.javascript:nicTemp();
৬.javascript:nicTemp();
৭.javascript:nicTemp();
৮.javascript:nicTemp();
৯.javascript:nicTemp();
১০.javascript:nicTemp();
১১.javascript:nicTemp();


পঠিত : ১৪৮৯ বার

মন্তব্য: ০